Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

শেষ ইচ্ছায় যা বললেন কামারুজ্জামান

kamruzzamanঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ও জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান তার পরিবারের কাছে বলেছেন, আগামী বাংলাদেশে ইসলামি সমাজ কায়েম হবে এটাই তার শেষ ইচ্ছা।

সোমবার রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কামারুজ্জামানের সাথে সাক্ষাৎ শেষে তার বড় ছেলে হাসান ইকবাল ওয়ামি সাংবাদিকদের এ কথা বলেন।

chardike-ad

তাদের আবারও দেখা করতে দেওয়া হবে জানিয়ে ওয়ামী বলেন, ফাঁসির আদেশে তার বাবা বিচলিত নন।

সোমবার কামারুজ্জামানের রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেওয়ার পর সন্ধ্যায় পরিবারের সদস্যরা তার সঙ্গে দেখা করতে যান। সন্ধ্যা পৌনে সাতটা থেকে রাত পৌনে আটটা পর্যন্ত কারাগারের ভেতরে কামারুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করেন তার পরিবারের নয় সদস্য ও পাঁচ জামায়াত নেতা।

পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন কামারুজ্জামানের স্ত্রী নুরুন্নাহার, দুই ছেলে হাসান ইকবাল ওয়ামি ও হাসান ইমাম ওয়াফি, মেয়ে আতিয়া নূর ও ভাগ্নি রোকসানা জেবিন ও চারটি শিশু।

পরে ইকবাল ওয়ামি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, যে অভিযোগে তার বাবার ফাঁসি হয়েছে তা মিথ্যা। এই রায় ভুল ও ভিত্তিহীন।

এই বিচারের কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাসহ সংশ্লিষ্টদের একদিন বিচার হবে- এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, সে বিচারের ভার আল্লাহর কাছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কামারুজ্জামানের মানসিক অবস্থা ভালো আছে। তিনি বিচলিত নন। মনোবল দৃঢ় রয়েছে।

কামারুজ্জামান রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিষয়টি আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে চূড়ান্ত হবে। আইনজীবীরা কামারুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাচ্ছেন বলেও জানান তিনি।

এর আগে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্ত্রী নূরুন্নাহার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সাক্ষাৎ করতে গেলে কামারুজ্জামান তার স্ত্রী নূরুন্নাহার কে বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ঘোষিত রায়ে মৃত্যু হলে তা হবে শাহাদাতের, সম্মানের। তাই এই মৃত্যুকে ভয় না করতে স্ত্রীকে বলেছেন জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। তিনি বলেছেন, ইসলামী আদর্শের রাজনীতি করার কারণে তার ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছে, মানবতাবিরোধী অপরাধে নয়। তিনি পরিবারের সদস্যদেরকে চিন্তা না করে আল্লাহর ওপর ভরসা করতে বলেছেন।

একান্ত সাক্ষাৎকারে নূরুন্নাহার স্বামীর সঙ্গে কথোপকথনের এ সব তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, কামারুজ্জামান তাকে বলেছেন, আমি কোন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যেতে পারতাম। অসুস্থ হয়েও কত মানুষ মারা যায়। ওই সব মৃত্যুতে কোন সম্মান নেই। গৌরব নেই। তবে সরকারের সাজানো বিচারের এই রায়ে যদি মৃত্যু হয় তা হবে মর্যাদার, গৌরবের।

দীর্ঘ সংসার জীবনের স্মৃতিচারণ করে নূরুন্নাহার বলেন, জীবন চলার পথে তার সততা, নিষ্ঠা আমাকে মুগ্ধ করেছে। তিনি কখনও কারও প্রতি অন্যায় অবিচার করতে পারেন আমি বিশ্বাস করি না। সরকার কোন সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে এই রায় দেয়নি বলে দাবি করেন তিনি।

কামারুজ্জামান স্ত্রীকে আরও বলেছেন, দ্বীন কায়েম করতে হলে রক্ত দিতে হয়। ইসলামের ইতিহাসে তা বারবার প্রমাণ হয়েছে। আমরা ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীরা রক্ত দিয়ে যাচ্ছি, রক্ত আরও দেবো। রক্ত দিতে হবে, জীবন দিতে হবে, তা জেনে শুনে বুঝে ইসলামী রাজনীতিতে এসেছেন বলে জানান কামারুজ্জামান। তিনি স্ত্রীকে বলেছেন, আমার মৃত্যুর পর তুমি এই পরিবারের অভিভাবক। সন্তানদের ইসলামী আদর্শে উজ্জীবিত রেখো। চিন্তা করো না, হতাশ হয়ো না, আমার মৃত্যুতে দুঃখ পেয়ো না। ধৈর্য ধরো, শক্ত থেকো। মহান আল্লাহর ওপর আস্থা রেখো। একদিন এই জুলুমের আর অত্যাচারের বিচার হবে।

এর আগে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কামারুজ্জামানের স্ত্রী নূরুন্নাহার ৫ সন্তানসহ পরিবারের ১০ সদস্যকে নিয়ে কেন্দ্রীয় কারাগারে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। প্রায় ৩০ মিনিট সাক্ষাৎ শেষে সবাই এক সঙ্গে বেরিয়ে আসেন। নূরুন্নাহার বলেন- কামারুজ্জামান পরিবারের কাউকে চিন্তা করতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে আদর্শের ওপর অবিচল থাকার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ইনশাআল্লাহ, আমার এই আদর্শ একদিন এদেশের মাটিতে বিজয়ী হবেই হবে।

সে সময় পাশে বসা পুত্র হাসান ইকবাল বলেন, আব্বা কারাগারে সুস্থ, স্বাভাবিক ও শক্ত আছেন। তিনি বলেন, আব্বার মতো শক্ত মানুষ আমি দেখিনি। কামারুজ্জামানের পরিবারের সদস্যরা গতকাল সকাল ১০টা ৩৮ মিনিট থেকে বেলা ১১টা আট মিনিট পর্যন্ত ভেতরে ছিলেন। তারা কিছু শুকনো খাবার এবং শীতের কাপড় নিয়ে যান। কামারুজ্জামানের স্ত্রী নুরুন্নাহার ছাড়াও তার চার ছেলে হাসান ইকবাল, আহমেদ হাসান, ইকরাম হাসান ও হাসান ঈমাম, মেয়ে আফিয়া নূর, ভাই নাজিরুজ্জামান ও আবদুল্লাহ আল মাহাদী, বোন মোহসীনা বেগম ও ভাগনে আবদুল আলিম এ সময় সঙ্গে ছিলেন। স্ত্রী বলেন, কামারুজ্জামান তাদের ধৈর্য ধারণ করতে বলেছেন। তিনি দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন। তিনি শক্ত আছেন। নীতি-আদর্শের প্রতি অবিচল আছেন।

রায় প্রসঙ্গে কামারুজ্জামান বলেছেন, আমি কোন অপরাধী নই। প্রমাণের ভিত্তিতে নয়, রূপকথার ভিত্তিতে রায় দেয়া হয়েছে। এটি একটি রূপকথার গল্প। এটি ন্যায়ভ্রষ্ট রায়। আমার ওপর যারা জুলুম করেছে তাদের বিচার একদিন হবে। রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি হাতে পেলে ৩০ দিনের মধ্যে রিভিউ করা হবে। সেভাবেই আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি বলে জানান নূরুন্নাহার।

কামারুজ্জামানের পুত্র হাসান ইকবাল বলেন, মঙ্গলবার সকালে পিতার সঙ্গে দেখা করার জন্য গাজীপুর কারা কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয়। এ সময় কারা কর্তৃপক্ষ বলেছে, আজ ছুটির দিন, তাই দেখা করার কোন বিধান নেই। এর কিছুক্ষণ পর জানতে পারি, আমার পিতাকে গাজীপুর কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, সরকার তড়িঘড়ি করে আমার পিতাকে হত্যা করতে চাইছে।

কামারুজ্জামানের আইনজীবী শিশির বলেন, নিয়মিত সাক্ষাৎকারের অংশ হিসেবে পরিবারের সদস্যরা তার সঙ্গে দেখা করেছেন। কারাগারে কামারুজ্জামানের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে এই আইনজীবী দাবি করেন, তিনি সুস্থ ও স্বাভাবিক আছেন। তিনি বলেছেন, আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে রিভিউয়ের জন্য আবেদন করবেন।

এদিকে কামারুজ্জামান প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন না বলে জানিয়েছেন তার ঘনিষ্ঠ জনেরা। তারা বলেন, এখনও রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি প্রকাশ হয়নি। মামলার রিভিউ হয়নি। রিভিউ নিষ্পত্তি হওয়ার পর বিষয়টি বিবেচনার দাবি রাখে। তারা বলেন, সরকার যেখানে রায়ের রিভিউ আবেদনের সুযোগ দিচ্ছে না, পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি প্রকাশ করার অপেক্ষা রাখছে না- সেখানে কিভাবে প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন।

এর আগে মঙ্গলবার দুপুর সোয়া ১২টায় কড়া পুলিশ পাহারায় কামারুজ্জামানকে নিয়ে একটি প্রিজন ভ্যান কেন্দ্রীয় কারাগারের উদ্দেশে রওনা হয়। গত ৯ই মে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।

এরপর ফাঁসির আদেশ থেকে খালাস চেয়ে আপিল করেন কামারুজ্জামান। গত সোমবার আপিল বিভাগের সিনিয়র বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহার নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বিভাগ চূড়ান্ত রায়ে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে। এরপর বিকালে রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করতে রায়ের সার্টিফাইড কপি চেয়ে আবেদন করে আসামিপক্ষ। একই সঙ্গে রিভিউ করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর বরাবর একটি নোটিশ পাঠানো হয়েছে। এই মামলার এডভোকেট অন রেকর্ড জয়নুল আবেদীন এ আবেদন করেন।

তবে সরকার পক্ষের প্রধান আইনজীবী এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম রিভিউ অর্থাৎ রায় পর্যালোচনার সুযোগ নেই বলে মত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এটি একটি বিশেষ আইন, এখানে রিভিউ করার কোন সুযোগ নেই। তবে আসামিপক্ষের আইনজীবী এডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেছেন, রিভিউ করা যাবে। তিনি বলেন, সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আমাদের রিভিউ করার সুযোগ রয়েছে। পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি পেলে আমরা রিভিউ আবেদন করবো।

গত বছর আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডাদেশের পরও সরকার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- রিভিউ’র সুযোগ নেই। তবে আসামি পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক ৩০ দিনের মধ্যে রিভিউ আবেদন করা যাবে বলে জানিয়েছিলেন এবং তা করেছিলেনও। তবে শেষ পর্যন্ত আবেদনটি খারিজ করে দেয় আপিল বিভাগ।