Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

স্বপ্ন অধরা

shipon-emdad
লেখক ও এমদাদ

সারা রাত ডিউটি করে এসে ঘুমিয়েছিলাম। কাশেম ভাইয়ের অনবরত কলে ঘুম ভেঙে গেল। কলব্যাক করে জিজ্ঞেস করলাম কি ব্যাপার বারবার কল দিচ্ছেন কেন? তিনি ফোনের ওপাশ থেকে জবাব দিলেন খুবই খারাপ সংবাদ। এ কথা শুনে আমি নড়েচড়ে বিছানায় উঠে বসলাম। আমার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল জলধারা বয়ে যাচ্ছে।

আজকাল খারাপ সংবাদ শুনলেই কেন জানি ভয় লাগে। সব সময় একটা উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠায় থাকি। জানতে চাইলাম খারাপ সংবাদটা কি? কাশেম ভাই বললেন আজ এমদাদ দেশে চলে যাচ্ছে। কোম্পানি তাঁকে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আমি অবিশ্বাসের স্বরে বললাম, কি বলছেন এই সব! গতকালই তো ওর সঙ্গে কথা বললাম। দেশে যাওয়ার কথা তো এমদাদ কিছু বলল না।

chardike-ad

কাশেম ভাই বললেন, আজ সকালেই কোম্পানির এইচআর এমদাদকে ডেকে জানিয়েছে বিকেল সাড়ে তিনটার তোমার ফ্লাইট। তোমাকে দুই ঘণ্টা সময় দেওয়া হলো বাসায় গিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আসতে। আমি আর কথা বাড়ালাম না। জানতে চাইলাম এমদাদ এখন কই? কাশেম ভাই জানালেন, এমদাদ এখন সিকিউরিটি গেটে ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করছে। লাইনটা কেটে দিয়ে একটি গেঞ্জি গায়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি করে লিফটে নিচে নেমে গেলাম।

নিচে গিয়ে দেখি এমদাদ সিকিউরিটির সঙ্গে কী নিয়ে জানি আলাপ করছে। আমাকে দেখে সিকিউরিটির সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে একপাশে চলে এল। আমার চোখে চোখ পড়তেই তাঁর মুখে ম্লান হাসি ফুটে উঠল। আমি কি বলব ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। গতকালই তিনি আমাকে তাঁর স্বপ্নের কথা বলেছেন। আর আজ সেই স্বপ্নগুলো অধরা রেখেই তাঁকে চলে যেতে হচ্ছে।

এমদাদই আগে বললেন, ভাই চলে যাচ্ছি, দোয়া কইরেন। এই কথা বলে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। ভেবেছিলাম তিনি কেঁদে দেবেন। কিন্তু না তিনি মানসিকভাবে খুবই শক্ত একজন মানুষ। আমাকে অবাক করে দিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, আমি চলে যাচ্ছি কিন্তু আপনার মুখ এত ভার কেন। দেখে তো মনে হচ্ছে আমি না আপনিই চলে যাচ্ছেন।

আমি কিছু বললাম না। কারণ আমি জানি স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা কত ভয়াবহ। প্রত্যেক প্রবাসীর কিছু নির্দিষ্ট স্বপ্ন থাকে আর সেই স্বপ্ন পূরণ না হলে তাঁরা যে যন্ত্রণা পান তা প্রকাশ করার মতো ভাষা পৃথিবীতে আজও আবিষ্কৃত হয়নি।

এমদাদ নির্ধারিত স্মোকিং এরিয়ায় গিয়ে একটি সিগারেট ধরিয়ে মুখভর্তি করে ধোঁয়া ছাড়ছেন আর মোবাইলে কার সঙ্গে যেন কথা বলছেন। আমি পাশেই দাঁড়িয়ে তাঁকে পর্যবেক্ষণ করছি। গতকালই এমদাদ আমাকে বলেছিলেন, ওমর ভাই যত টাকা লোন করে এখানে এসেছিলাম, লোনের সেই টাকা মাত্র পরিশোধ করলাম। এখন বাবার চিকিৎসা করাতে হবে। বাবা কত দিন যাবৎ ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। নামাজ পড়তে গিয়ে পিচ্ছিল রাস্তায় পা পিছলে পড়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছিলেন। প্রথম ভেবেছিলাম, পা মচকিয়েছে তাই ঝাড়ফুঁক করা হয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে অবস্থা খারাপ। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। আমার কাছে টাকা ছিল না বলে এত দিন হাসপাতালে নিয়ে যেতে তোড়জোড় করিনি। চিন্তা করছি এই মাসের বেতন পেলেই বাবার চিকিৎসা করাব আর আগামী মাসে মায়ের চিকিৎসা। মা আজকাল চোখে কম দেখেন তাই তাকে চোখের ডাক্তার দেখাতে হবে।

তার কথা শুনে আমি জবাবে বলেছিলাম সবকিছু আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তার করার কিছু নেই। এমদাদ আরও বলেছিলেন, মা বাবার চিকিৎসার পর বাড়িতে সুন্দর করে ঘর করব। ঘরটা করা হলেই বাড়িতে গিয়ে বিয়ে করব। এমদাদের গলা খাঁকারিতে কল্পনা জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে এলাম। এমদাদ বললেন, ভাই আপনি এত মন খারাপ করে আছেন কেন! আমি অপ্রস্তুতভাবে জবাব দিলাম কই নাতো। তারপর নীরবতা! দুজনের কারও মুখে কথা নাই।

আমিই বললাম, ভাই হঠাৎ করে পাঠিয়ে দেওয়ার কারণ কি? এমদাদ জবাব দেন, কারণ তো অবশ্যই আছে তবে আপনাকে বলা যাবে না। আপনি এমনিই জেনে যাবেন। তবে সবচেয়ে খারাপ লাগল কোম্পানি আমাকে সুযোগ দিল না। হঠাৎ ডেকে পাঠিয়ে দিচ্ছে। দুই দিন আগে বললেও বাড়ির জন্য কিছু কেনাকাটা করতে পারতাম। এখন কিছু যে কিনব তার কোনো সুযোগ নেই। যেভাবে খালি হাতে এসেছিলাম সেভাবে খালি হাতেই ফিরে যাচ্ছি। মা বাবার জন্য কিছুই করতে পারলাম না। আমি তাঁর কাঁধে চাপ দিয়ে বললাম, তাতে সমস্যা নেই এখন দিতে পারেননি অন্য সময় দেবেন।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এমদাদ বললেন, ভাই আজ যাই গাড়ি চলে এসেছে। আশা করি নিয়মিত যোগাযোগ রাখবেন। বহু কষ্টে নিজেকে সংযত রেখে তাঁকে বিদায় দিলাম।

আমি ভাবতেই পারছি না স্বপ্নভঙ্গের পর এমদাদ এমন হাসিখুশি ভাবে আমার কাছ থেকে বিদায় নেবেন। কবি বলেছেন, মানুষ নাকি স্বপ্নই দেখে তা ভঙ্গের জন্য। তবুও তাঁরা স্বপ্ন দেখেন। দীর্ঘ আড়াই বছর এমদাদ আমাদের সঙ্গে ছিলেন। এত দিন পাশাপাশি থাকাতে তাঁর প্রতি এক ধরনের মায়া তৈরি হয়েছিল। জীবন মানেই নাকি মায়া। যাঁরা এই মায়া ত্যাগ করতে পারেন তাঁরাই মহামানব হয়ে ওঠেন। আমি মহামানব নই, সাধারণ একজন মানুষ। তাই মায়া ত্যাগ করতে কষ্ট হলো। নিজের অজান্তেই দুই চোখ বেয়ে এক ফোঁটা গরম পানি গড়িয়ে পড়ল।

লিখেছেন: এম ওমর ফারুকী (শিপন), সিঙ্গাপুর প্রবাসী। সৌজন্যে: প্রথম আলো