১২ হাজার ৩৮৯ ফুট উঁচু পর্বতের পাদদেশেই জঙ্গলটির অবস্থান। চারদিকে যেন গাছের সমুদ্র। অবশ্য গাছের সমুদ্রই নাম এর। যত গহিন, ততই নিঃশব্দের মাত্রা। ভেতরে দুই একটা ট্রেইল (চলার পথ) দেখা যায়। আরো গহিনে গেলে মাথায় ধাক্কা লাগতে পারে ঝুলন্ত কঙ্কালের। হাঁটতে গেলে দুই একটা মাথার খুলি পায়ে বাধা অস্বাভাবিক নয়। জঙ্গলের কোনো এক দিকে চোখে পড়বে সাইন বোর্ড। যেখানে জাপানি ও ইংরেজি ভাষায় লেখা ‘বাবা-মা’র দেয়া মহামূল্যবান উপহার আপনার জীবন। দয়া করে একবার তাদের কথা ভাবুন। ছোট ভাইবোন আর সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে প্লিজ……। আপনার সমস্যার কথা তাদের খুলে বলুন’।
জঙ্গলটির নাম আওকিগাহারা। এটি সুইসাইড জঙ্গল নামে পরিচিত। এই জঙ্গলটি আত্মহত্যার অভয়ারণ্য। নীরবে-নিভৃতে বিষণ্ন মানুষগুলো বৃক্ষে ঝুলে পড়ে কবর দেয় তাদের হতাশা। সমাজ বঞ্চিত হয়ে চাপা কষ্টের সমাধি গড়ে আওকিগাহারার সবুজ সমুদ্রে। জাপানে ‘সুইসাইড হটস্পট’ নামেও পরিচিত এটি। প্রতি বছর অন্তত ১০০ ঝুলন্ত কঙ্কাল উদ্ধার করা হয় এখান থেকে। আর অনাবিষ্কৃত কঙ্কালের সংখ্যা থেকে যায় অজানাই।
আওকিগাহারা এতই ঘন, খুব সহজেই হারিয়ে যাওয়া যায় চিরসবুজ গাছগাছালির মাঝে। যে হারাবে তাকে দেখা যাবে না আর কখনোই। তবে বিষণ্ন মানুষগুলো আত্মহত্যার জন্য কেন যে এই জঙ্গল বেছে নেয় তা রহস্যের জালেই আবৃত রয়ে গেছে। তবে প্রথম আত্মহত্যকারী একটি উপন্যাসে অনুপ্রাণিত হয়ে এই জঙ্গলে এসেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। এমনকি এই জঙ্গল নিয়ে ৩০ বছর ধরে গবেষণা করছেন যিনি, সেই আজুসা হেইয়ানো পর্যন্ত জানতে পারেননি এই প্রবণতার কারণ।
এই কাজ করতে গিয়ে প্রায়ই তাকে আত্মহত্যাকারীর মৃতদেহ খুঁজে বের করতে হয়েছে। মাঝে-মধ্যে আত্মহত্যাকারীর সঙ্গে দেখাও হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি জানতে পারেনি আত্মহত্যার জন্য এই জঙ্গল বেছে নেয়ার সঠিক কারণ।
গত ২০ বছরে হেইয়ানো একাই এই জঙ্গল থেকে উদ্ধার করেছেন শতাধিক কঙ্কাল ও মৃতদেহ। মধ্যবয়সী এই ভূ-তাত্ত্বিক তার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন জঙ্গলে তথ্যচিত্র নির্মাণ দলের সঙ্গে। আত্মহত্যাকারীরা কেন আওকিগাহারা বেছে নেয়, হেইয়ানো এর কোনো সুনির্দিষ্ট উত্তর দিতে না পারলেও, তিনি খুলে বলেছেন না ফেরার উদ্দেশ্য নিয়ে জঙ্গলে আসা বিষণ্ন ও বেপরোয়া মানুষের আচরণ সম্পর্কে অর্জিত তার অন্তর্জ্ঞান। তথ্যচিত্রনির্মাতাদের তিনি বলেছেন, গাছের মাঝে রেখে যাওয়া ক্লু-ই বলে দেয় মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে আত্মহত্যাকারীর মনের অবস্থা। অনেক সময় মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে আত্মহত্যাকারীর বাঁচার ইচ্ছা জাগে।
হেইয়ানো জঙ্গলের এক পাশে পড়ে থাকা একটি গাড়ি দেখিয়ে বলেন, ‘এই গাড়িটি কয়েক মাস ধরে পড়ে আছে। আমার ধারণা, গাড়ির মালিক এখান দিয়েই জঙ্গলে প্রবেশ করেছেন এবং তিনি আর ফিরে আসেননি। বিষণ্নতার কারণেই তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে আমার ধারণা’।
জঙ্গলের আরো গহিনে হেইয়ানো আত্মহত্যা না করার অনুরোধ সংবলিত একটি সাইন বোর্ড দেখালেন। সাইনবোর্ডটি যেখানে লটকানো সেখানে একটি পাবলিক ট্রেইল এসে বেষ্টনীতে শেষ হয়েছে। এই স্থানটিই ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন বা না ফেরার স্থান’_বললেন আজুসা হেইয়ানো। আত্মহত্যা প্রতিরোধ সংঘের টানানো সাইনবোর্ডটিতে আত্মহত্যা না করার করুণ ও হৃদয়স্পর্শী অনুরোধ জানানো হয়েছে। অধিকাংশ মানুষই সাইনবোর্ডের এই করুণ আবেদনকে তোয়াক্কা না করলেও, কিছু আত্মহত্যাকারী এই আবেদন দেখে তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে।
আত্নহত্যার সংখ্যা: ২০০২ সালে এই বনে ৭৮ টি মৃতদেহ পাওয়া যায়। এর আগের রেকর্ড ছিল ৭২ টি, ১৯৮৮ সালে। ২০০৩ সালে এই সংখ্যা ১০০ জনে উন্নীত হয়, ২০০৪ এ গিয়ে দাঁড়ায় ১০৮ জনে। এর পর থেকে স্থানীয় প্রশাসন মৃতের সংখ্যা প্রকাশ করা বন্ধ করে দেয়। ২০১০ সালে ২৪৭ জন এই বনে গিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালায় যাদের মধ্যে ৫৭ জন মারা যায়। এই আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় মার্চ মাসে। এদের বেশিরভাগ হয় ফাঁসিতে ঝুলে কিংবা মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ সেবনে মারা যায়।