বেসরকারি খাতের অধিকাংশ ব্যাংকের কাছে ঋণ দেয়ার মতো পর্যাপ্ত টাকা নেই। তারা অর্থ সংগ্রহে অসম প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে বেড়ে যাচ্ছে ব্যাংকের খরচ। এবার খরচ সামলাতে ব্যাংকগুলো ঋণের সুদহারও বাড়াচ্ছে। এতে বিপাকে পড়ছেন ব্যবসায়ীরা।
ব্যাংক খাত সংশি্লষ্টরা বলছেন, গত বছরের এ সময়ে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা অলস পড়েছিল। অথচ এবার ঋণ দেয়ার টাকা নেই। দেশে কী এমন ঘটেছে যে তারল্য সংকটে পড়বে ব্যাংক। সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন- এত টাকা যাচ্ছে কোথায়? তাদের মতে, অধিক সতর্ক হওয়ার বিকল্প নেই। কারণ টাকা সোজা পথে কোথাও যাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বাঁকা পথে যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি। কেউ বলছেন, সরকারি ব্যাংকগুলো ‘লুটে খাওয়া’ শেষ। এবার টার্গেট বেসরকারি ব্যাংক। এছাড়া আমদানির আড়ালে অর্থ পাচারের ঘটনাও ঘটে থাকতে পারে। যেজন্য ঋণ নেয়া হয়েছে তা ব্যবহার হচ্ছে ভিন্ন খাতে। অর্থাৎ নির্বাচনী খরচ মেটাতে নগদ টাকা তুলে নেয়া হতে পারে। এর বাইরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমেও বিপুল অংকের অর্থ ব্যাংক থেকে বের করা হয়েছে। তা না হলে হঠাত নগদ অর্থের সংকট হতো না।
সিনিয়র ব্যাংকার শফিকুর রহমান বলেন, পুঁজিবাজারে টাকা যাচ্ছে না। আবাসন খাতেও টাকা যাওয়ার লক্ষণ নেই। তাহলে এত টাকা যাচ্ছে কোথায়? তিনি বলেন, আকস্মিকভাবে বেসরকারি খাতে অর্থ সংকট দেখে মনে হচ্ছে ব্যাংকের টাকা ভিন্ন খাতে যাচ্ছে। বিশেষ করে আমদানির আড়ালে অর্থ পাচার, নির্বাচনী বছর হওয়ায় অনেকে ব্যাংক থেকে নগদ টাকা তুলে রাখার সম্ভাবনাও রয়েছে। এছাড়া সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে বিপুল অংকের অর্থ ব্যাংক থেকে বের করেছে সরকার।
সূত্র জানায়, বেশ কিছু ব্যাংক নতুন করে ব্যবসায়ীদের ঋণ দিচ্ছে না। প্রায় সব ব্যাংকই বাড়িয়েছে সুদের হার। এমনকি কিছু ব্যাংকের ক্ষেত্রে গ্রাহকদের দেয়া ঋণের টাকা ফিরিয়ে নেয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
সংশি্লষ্ট সূত্র জানায়, ডিসেম্বর শেষে পুরো ব্যাংক খাতে অলস অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। অথচ গত কয়েক বছর ধরে উদ্বৃত্ত তারল্য ছিল এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি। বার্ষিক হিসাবে ডিসেম্বরে আমানতে ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও ঋণ বেড়েছে প্রায় সাড়ে ১৯ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদার বিপরীতে কয়েকটি ব্যাংকের কাছে চলতি অর্থবছরে এ পর্যন্ত ১৩০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর বিপরীতে তুলে নেয়া হয়েছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। এসব কারণে নগদ টাকার টানাটানি চলছে।
কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, কয়েক মাস আগেও ব্যাংকগুলো বড় গ্রাহকদের সিঙ্গেল ডিজিট সুদে ঋণ দিত, যা এখন ডাবল ডিজিট করে ফেলছে। একই ভাবে বেড়েছে ভোক্তা ও গৃহঋণের সুদহারও।
বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, ‘ঋণের সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় আমরা খুবই উদ্বিগ্ন। আমরা চাই ঋণের সুদের হার সহনীয় থাকুক। এক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক মিলে যৌথভাবে নির্দেশনা দিতে পারে। নইলে ব্যবসার খরচ বেড়ে যাবে এবং পণ্যের দাম বাড়বে। এতে মূল্যস্ফীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’
সূত্র জানায়, গত ২ মাসে ২ থেকে ৩ শতাংশ সুদ বাড়িয়েছে অনেক ব্যাংক। এখন ৯ শতাংশ সুদে মেয়াদি আমানত নিচ্ছে। আমানতের সঙ্গে বাড়ছে ঋণের সুদহারও। ফেব্রুয়ারিতে এক বছর বা তার বেশি মেয়াদি আমানতে সাড়ে ৮ শতাংশ সুদ দিচ্ছে মার্কেন্টাইল ব্যাংক। ডিসেম্বরেও সর্বোচ্চ সাড়ে ৭ শতাংশ সুদে এ ধরনের আমানত নিয়েছিল ব্যাংকটি। অক্টোবরে এক্ষেত্রে মার্কেন্টাইলের সর্বোচ্চ সুদ ছিল সাড়ে ৫ শতাংশ। ৪ মাসের ব্যবধানে মেয়াদি আমানতে তিন শতাংশ সুদ বাড়ানো হয়েছে।
নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলো ৯ শতাংশ সুদে আমানত নিচ্ছে। সমস্যাগ্রস্ত ফারমার্স ব্যাংক আমানত সংগ্রহে সুদ দিচ্ছে সাড়ে ১০ শতাংশ। জনতা ব্যাংক দুই দফায় সুদ বাড়িয়ে এখন ৬ শতাংশ সুদে আমানত নিচ্ছে। শিল্প খাতের মেয়াদি ঋণে সুদহার বেড়ে হয়েছে ১১ শতাংশ। এ অবস্থায় সঞ্চয়কারীরা উত্সাহিত হলেও চাপে পড়ছেন ব্যবসায়ীরা।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহ-সভাপতি ও বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকটি ব্যাংক। কিছু দিনের মধ্যে সব ব্যাংক সুদের হার বাড়িয়ে দেবে। মনে হচ্ছে সুদের হার আবার ১৭-১৮ শতাংশের দিকে যাচ্ছে। তাহলে ব্যবসা করব কিভাবে। ব্যাংকগুলোর দুর্নীতির মাশুল কেন সাধারণ মানুষ দেবে। তিনি বলেন, সব সরকার ব্যাংক মালিকদের ব্যাপারে উদার। তারা যা চাইবে তা পাবে। এভাবে ঋণের সুদের হার বাড়ালে বিনিয়োগ মুখ থুবড়ে পড়বে বলে মনে করেন তিনি।
ব্যাংকাররা বলছেন, ব্যাংকের আমানতের বিপরীতে ঋণ বিতরণের সীমা কমিয়ে দেয়ার কারণে সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। এছাড়া সুদের হার কম হওয়ায় ব্যাংকে আমানত কমে যাওয়া, ডলার বিক্রি করে ব্যাংক থেকে অর্থ তুলে নেয়া ও সাম্প্রতিক সময়ে বেসরকারি খাতের কয়েকটি ব্যাংকের কেলেঙ্কারিও এর জন্য দায়ী।
পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুল হালিম চৌধুরী বলেন, আমানতের সুদ বাড়াতে গিয়ে ঋণের সুদও বাড়াতে হচ্ছে। তা না হলে আমানত পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, আমানতের এত সংকট যে অনেক ব্যাংক ঋণ বিতরণ করতে পারছে না। কারণ ব্যাংকের হাতে টাকা নেই। তিনি বলেন, সব ব্যাংকের ঋণের সুদের হার ডাবল ডিজিটে অবস্থান করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকগুলোতে ২০১১-১৩ সাল পর্যন্ত ঋণের গড় সুদের হার ছিল ১২ থেকে ১৪ শতাংশের মধ্যে। ২০১৭ সালে তা ১০ শতাংশের নিচে নেমে যায়। সর্বশেষ ডিসেম্বরে ঋণের সুদের গড় হার দঁাড়ায় ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০১৭ সালের প্রথম ১১ মাসেই (জানুয়ারি-নভেম্বর) ১ লাখ ১১ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ হয়েছে। যদিও এ সময়ে ব্যাংকগুলোতে আমানত বেড়েছে ৭২ হাজার ৫৩১ কোটি টাকা। অর্থাত্ আমানতের চেয়ে দেড় গুণের বেশি ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এতে ব্যাংক টাকা শূন্য হয়ে যায়। এদিকে আমদানির বিল পরিশোধ করতে প্রতিদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কিনছে ব্যাংকগুলো। তাতে ডলারের দাম বাড়ছে।
প্রিমিয়ার ব্যাংকের পরিচালক ও এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশর (ইএবি) প্রেসিডেন্ট আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা পালন করতে গিয়ে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। এডি রেশিও (আমানত ঋণের অনুপাত) কমানোর কারণে বাজারে আমানত সংগ্রহের প্রতিযোগিতা বেড়েছে। ফলে আমানতের সুদের হার বাড়াতে হয়েছে। এখন আমানতের পাশাপাশি ঋণের সুদহারও বাড়াতে হচ্ছে সঙ্গত কারণে। তবে এতে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন এ ব্যবসায়ী।
এদিকে ঋণ বিতরণ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বেশি হওয়ায় ঋণসীমা কমিয়ে লাগাম টেনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন সীমা মানতে ব্যাংকগুলোকে কড়া নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকাররা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নির্দেশনার কারণে অনেক ব্যাংক নতুন ঋণ দেয়ার সক্ষমতা হারিয়েছে। অনেকে নির্ধারিত ঋণসীমার মধ্যে আসতে দেয়া ঋণও ফেরত আনছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা পালন করতে গিয়ে সবাই আমানত সংগ্রহে জোর দিয়েছে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান বলেন, এডি রেশিও কমানোর কারণে সংকট বেড়েছে। ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার বাড়িয়েছে। ফলে ঋণের সুদহারও বাড়ছে। কারণ ব্যাংক লোকসান দিয়ে ব্যবসা করবে না।
সৌজন্যে- যুগান্তর