Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

ব্যাংক ম্যানেজারের অভিনব জালিয়াতি

kamrulঅস্তিত্বহীন কোম্পানির নামে ঋণ সৃষ্টি ও গ্রাহকের কাছ থেকে কমিশন বাবদ কোটি কোটি টাকা নেওয়ার ঘটনায় দেশজুড়ে এখন আলোচিত ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও তৎকালীন অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী। এই আলোচনার মধ্যেই ব্যাংকটির নতুন একটি বড় জালিয়াতির সন্ধান পাওয়া গেছে। অভিনব পন্থায় গ্রাহকদের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন গাজীপুরের মাওনা শাখার সাবেক ম্যানেজার শেখ কামরুল হোসেন। বিভিন্ন কৌশলে গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য অ্যাকাউন্টে অর্থ স্থানান্তর বা পে-অর্ডারের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা তুলে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে কামরুলের বিরুদ্ধে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন, গ্রাহকদের অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ সরানোর কাজে ব্যবহূত পে-অর্ডারের নমুনা, বিভিন্ন সময়ে প্রধান কার্যালয় থেকে কামরুল হোসেনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ ও ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে জালিয়াতির বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। যদিও এসব অধিকাংশ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন শেখ কামরুল হোসেন। তবে কয়েকটি জালিয়াতির অভিযোগের সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি তিনি।

chardike-ad

শেখ কামরুল হোসেন ফারমার্স ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ শারাফাতের আপন ভগ্নিপতি। ব্যাংকের এই কর্মকর্তা জালিয়াতি করে ঠিক কত টাকা আত্মসাৎ করেছেন, তার সঠিক হিসাব এখনও করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল। তবে ব্যাংকের এই শাখার মোট ২০১ কোটি টাকা ঋণের অর্ধেকের বেশি তিনি জালিয়াতির মাধ্যমে তুলে নিয়েছেন বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত কর্মকর্তারা। তথ্য বিশ্নেষণ করে দেখা গেছে, সেখানে প্রায় ২১ কোটি ৫১ লাখ টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে তুলে নেওয়া হয়েছে। নানা অনিয়মের কারণে এরই মধ্যে শেখ কামরুলকে মাওনা শাখার ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে ওই শাখারই ঋণ আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এই শাখার ৬৬ কোটি টাকার ঋণ এখন খেলাপি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শাখার বিভিন্ন গ্রাহকের হিসাব থেকে জাল-জালিয়াতিসহ নানা অনৈতিক উপায়ে অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে সাবেক শাখা ব্যবস্থাপক শেখ কামরুল হোসেনসহ কয়েকজন সরাসরি জড়িত। শাখার প্রায় প্রতিটি ঋণ হিসাবেই গ্রাহক সম্মতিপত্রের নামে বিপুল পরিমাণ আন্তঃলেনদেন সংঘটিত হয়েছে। তবে এসব লেনদেন গ্রাহকের সম্মতিতে সংঘটিত হয়নি বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অনেকে জানিয়েছেন। এ বিষয়ে শাখা ব্যবস্থাপক শেখ কামরুল হোসেনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় সাধারণ ডায়েরিও করেছেন কয়েকজন গ্রাহক। তবে এসব অনিয়ম এত অভিনব কায়দায় হয়েছে যে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল প্রকৃত আত্মসাতের পরিমাণ এখনও নির্ণয় করতে পারেনি। বহির্নিরীক্ষক দিয়ে প্রতিটি ঋণ হিসাবের ওপর ‘ফাংশনাল অডিট’ করিয়ে গ্রাহকের প্রকৃত দায়দেনা নিরূপণের জন্য ব্যাংকটিকে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

চরম তারল্য সংকট এবং বিভিন্ন অনিয়ম প্রতিরোধে ব্যর্থতার দায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপে গত বছরের ২৭ নভেম্বর ফারমার্স ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও চেয়ারম্যান পদ থেকে মহীউদ্দীন খান আলমগীর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। একই দিন অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতীও ব্যাংক থেকে সরে দাঁড়ান। এরপর ১৯ ডিসেম্বর এ কে এম শামীমকে এমডি থেকে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপরও তারল্য সংকটের কারণে গ্রাহকের আমানত ফেরত দিতে পারছে না ব্যাংকটি।

মাওনা শাখার অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকটির বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক এহসান খসরু বলেন, তিনি এ বিষয়ে কিছু জানেন না। তার কাছে কোনো রিপোর্ট আসেনি। অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে শেখ কামরুল হোসেনকে শাখার ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব থেকে সরানোর বিষয়টি উল্লেখ করার পর তিনি বলেন, ‘অনেক শাখার বিষয়ে পদক্ষেপ চলমান রয়েছে। সে তালিকায় মাওনা শাখা আছে কি-না, আমার স্মরণ নেই।’ আর ফারমার্স ব্যাংকের উপদেষ্টা প্রদীপ কুমার দত্ত বলেন, এসব অপারেশনাল বিষয় তিনি দেখেন না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি ফৌজদারি অপরাধ। দ্রুত অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষও এর দায় এড়াতে পারে না বলে মনে করেন তিনি।

যেভাবে অর্থ আত্মসাৎ: অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফারমার্স ব্যাংকের মাওনা শাখার গ্রাহক ইসলাম ব্রাদার্সের নামে ২০১৬ সালে পাঁচ কোটি ৫৫ লাখ টাকার নগদ ঋণসীমা অনুমোদন করে প্রধান কার্যালয়। তৎকালীন শাখা ব্যবস্থাপক কামরুল হোসেন তহবিল সংকটের কারণ দেখিয়ে গ্রাহককে কয়েক দফায় মাত্র এক কোটি ৫১ লাখ টাকা দেন। আর গোপনে বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করে বাকি টাকা তুলে নেন। ইসলাম ব্রাদার্স বিভিন্ন সময়ে অ্যাকাউন্টের স্টেটমেন্ট তুলতে চাইলেও তা দেওয়া হয়নি। তবে গত ২৬ নভেম্বর মাওনা শাখা থেকে ওই প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়, ইসলাম ব্রাদার্সের কাছে সাত কোটি ৫৮ লাখ ১৩ হাজার টাকা পাওনা। এরপর ইসলাম ব্রাদার্স অ্যাকাউন্টের স্টেটমেন্ট তুলে জানতে পারে, তার হিসাব থেকে ম্যানেজার কামরুলের মালিকানাধীন এফএস ট্রেডিং, এমএ এন্টারপ্রাইজ, মায়ের দোয়া পোলট্রি, ডলফিন ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, নাজমুল আলম ব্রিকস, মোল্লা ফিশারিজ ও ইমতিয়াজ আহমেদের হিসাবে চার কোটি ৪৯ লাখ টাকা স্থানান্তর হয়েছে। যদিও এসব অর্থ স্থানান্তরে ইসলাম ব্রাদার্স কোনো আবেদন করেনি। জানতে চাইলে শেখ কামরুল বলেন, এফএস ট্রেডিং একসময় তার ছিল। তবে এখন এটা অন্য আরেকজন চালায়। গ্রাহকের সম্মতি ছাড়া তার সময়ে কোনো টাকা স্থানান্তর হয়নি বলে তিনি দাবি করেন।

আরেক গ্রাহক কর্ণফুলী কনজ্যুমার ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২২ অক্টোবর ৮০ লাখ টাকার ঋণ মঞ্জুর করে প্রধান কার্যালয়। সব প্রক্রিয়া শেষে গত ৫ ডিসেম্বর গ্রাহক ঋণের টাকা তুলতে গেলে শাখা থেকে জানানো হয়, প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশে আপাতত ঋণ বিতরণ বন্ধ আছে। তবে গ্রাহক জানতে পারেন, স্বাক্ষরবিহীন এক আবেদনের বিপরীতে তার হিসাব থেকে তিনটি অ্যাকাউন্টে ৭৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা স্থানান্তর করে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক শাখা ব্যবস্থাপক শেখ কামরুল বলেন, তার জানামতে গ্রাহকের আবেদন ছাড়া কোনো অর্থ স্থানান্তর হয়নি। তৎকালীন অপারেশন ম্যানেজার মাহবুব আহমেদের জোর সুপারিশে গোমতি ঔষধালয়কে ১৭ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করে প্রধান কার্যালয়। প্রতিষ্ঠানটিকে দেওয়া ২২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা এখন খেলাপি। এ অনিয়ম কীভাবে হলো- জানতে চাইলে শেখ কামরুল বলেন, ‘আসলে মাহবুব আহমেদ বা আমি কিছুই না। সবকিছু হয়েছে ওপরের নির্দেশে।’ এভাবে তিনি দায়িত্ব এড়িয়ে যান।

বিভিন্ন ঋণ হিসাব থেকে পে-অর্ডারের বিপরীতে এফএস ট্রেডিং নামে একটি প্রতিষ্ঠানের হিসাবে কোটি কোটি টাকা জমা হওয়ার তথ্য হাতে এসেছে। যেসব হিসাব থেকে এফএস ট্রেডিংয়ের নামে পে-অর্ডার ইস্যু হয়েছে, সেসব হিসাবে আবার প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদিত সীমার চেয়ে অনেক বেশি ঋণ সৃষ্টি হয়েছে। দেখা গেছে, রানা অটো ব্রিকসের হিসাব থেকে দুটি পে-অর্ডারের বিপরীতে এফএস ট্রেডিংয়ের হিসাবে এক কোটি ৪৫ লাখ টাকা গেছে। এই রানা অটোর নামে প্রধান কার্যালয় থেকে অনুমোদিত ঋণসীমা ১২ কোটি ৭১ লাখ টাকা হলেও তার নামে ঋণ সৃষ্টি হয় ১৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। সানিমান ইলেকট্রনিকসের হিসাব থেকে এফএস ট্রেডিংয়ের হিসাবে গেছে ২৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা। প্রতিষ্ঠানটির অনুমোদিত ছয় কোটি টাকা সীমার বিপরীতে সাত কোটি ১৩ লাখ টাকা ঋণ সৃষ্টি হয়েছে।

বিডিসাইন থেকে দুটি পে-অর্ডারের বিপরীতে ৭৫ লাখ টাকা এফএস ট্রেডিংয়ের নামে ইস্যু হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির দুই কোটি টাকার বিপরীতে তিন কোটি ৬৫ লাখ টাকা ঋণ সৃষ্টি হয়েছে। তুষার এন্টারপ্রাইজ থেকে ৬৬ লাখ ও ২৫ লাখ টাকার পে-অর্ডার ইস্যু হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির তিন কোটি টাকা সীমার বিপরীতে তিন কোটি ৪৪ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। এভাবে বিভিন্ন হিসাব থেকে এফএস ট্রেডিংয়ের হিসাবে পাঁচ কোটি ১৭ লাখ ২৫ হাজার টাকা যাওয়ার তথ্য এসেছে।

জানতে চাইলে শেখ কামরুল হোসেন বলেন, ‘এফএস ট্রেডিংয়ের হিসাবে কীভাবে টাকা গেছে, আমি তা জানি না।’ অনিয়ম করে ব্যক্তিগত নামে গ্রাহককে ঋণের চেক দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি আসলে অসহায় ছিলাম। অডিট কমিটির শীর্ষস্থানীয় এক কর্মকর্তার নির্দেশে একজনকে একটি চেক দিয়েছি।’ টাকা না নিলে কেন চেক দিলেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা বেসরকারি ব্যাংক। চাকরি রক্ষায় তখন অনেক কিছু করতে হয়েছে।’

ব্যাংক কর্মকর্তার জালিয়াতির শিকার চারজন গ্রাহকের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়েছে। প্রত্যেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তাদের অগোচরে অভিনব কায়দায় শাখা ব্যবস্থাপকসহ কয়েকজন মিলে ঋণের টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ভুয়া আবেদন তৈরি করে অন্য অ্যাকাউন্টে অর্থ স্থানান্তর বা পে-অর্ডার ইস্যু করে ঋণের টাকা তুলে নিয়েছেন তারা। কোনো ক্ষেত্রেই তাদের কারও প্রকৃত স্বাক্ষর নেই। গ্রাহকরা আরও জানান, বিষয়টি জানার পর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় গিয়েও কোনো সমাধান পাননি।

ব্যবস্থা নেয়নি ব্যাংক : এ অনিয়মের বিষয়ে বেশ আগে থেকে ফারমার্স ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জানলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। শুধু দায়সারাভাবে কয়েক দফা শেখ কামরুল হোসেনসহ কয়েকজনকে শোকজ করা হয়েছে। সর্বশেষ গত বছরের ১৫ নভেম্বর শোকজ নোটিশে বলা হয়, ব্যাংকের নিয়মনীতি না মেনে প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদিত সীমার চেয়ে ৪০ কোটি ১৪ লাখ টাকা বেশি ঋণ দেওয়া অন্যায়। একই দিন শাখার তৎকালীন অপারেশন ম্যানেজার মাহবুব আহমেদকেও শোকজ নোটিশ দিয়ে বলা হয়, তার সুপারিশে গোমতি ঔষধালয়কে ১৭ কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটির কাছে পাওনা ২২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা এখন খেলাপি। সুপারিশকারী ও শাখার অপারেশন ম্যানেজার হিসেবে এ দায় তিনি এড়াতে পারেন না। এই শোকজের বিষয়ে জানতে চাইলে শেখ কামরুল বলেন, ‘আগের এমডির অনেক অনৈতিক কথা না শোনার কারণে ওই সব শোকজ করা হয়েছিল।’

দুদককে চিঠি : মাওনা শাখার ওপর ফাংশনাল অডিট করানোর পাশাপাশি কামরুল হোসেনসহ দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান বরাবর একটি চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর মানি লন্ডারিংয়ের আলামত পাওয়ায় এ বিষয়ে অধিকতর তদন্তের জন্য প্রতিবেদনটি দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ)।

সূত্র- সমকাল