প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পেলেও সেই তুলনায় কর্মসংস্থান না হওয়ায় দেশে বেড়েই চলছে বেকারের সংখ্যা। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী দেশে ১৫ বছরের বেশি বয়সী কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ৯১ লাখ।
এর মধ্যে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৮০ হাজার। আর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এই সংখ্যা ছিল ২৬ লাখ। এক্ষেত্রে এক বছরে বেকার বেড়েছে ৮০ হাজার। উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেশি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পরিচালিত সর্বশেষ ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। মঙ্গলবার রাজধানীর পরিসংখ্যান ভবনে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের শ্রমশক্তি জপির প্রকাশ করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন, পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
বিশেষ অতিথি ছিলেন অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান, সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম, আইএমইডি সচিব মো. মফিজুল ইসলাম।
সভাপতিত্ব করেন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিব সুরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী। বক্তব্য দেন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মো. আমীর হোসেন। অনুষ্ঠানে জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন প্রকল্প পরিচালক কবির উদ্দিন আহমদ।
জরিপে দেখা যায়, জাতীয় বেকারত্বের গড় হার অপরিবর্তিত রয়েছে। এ হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ। উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেশি। অর্থাৎ মোট বেকারত্বের ১১ দশমিক ২ শতাংশ উচ্চ শিক্ষিত।
বেকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে নারী ও পুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান। এছাড়া অর্থনীতির রূপান্তরের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দেশের কৃষি খাতে কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা কমেছে, বিপরীতে বাড়ছে শিল্প ও সেবা খাতের শ্রম শক্তির সংখ্যা।
দেশের মোট শ্রমশক্তির ৫৬ শতাংশ কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে নিয়োজিত রয়েছে, যা সংখ্যায় ৬ কোটি ৮০ লাখ। শ্রম শক্তির বাইরে রয়েছে ৪ কোটি ৫৫ লাখ মানুষ। জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘গত এক বছরে দেশে নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে ৩৭ লাখ।
এর মধ্যে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে ১৩ লাখ। মজুরি ছাড়াই কাজ করতেন (আনপেইড) এমন ১৪ লাখ মানুষ মজুরিভিত্তিক (পেইড) কর্মসংস্থানে যুক্ত হয়েছেন। আর প্রবাসের শ্রমবাজারে যোগ দিয়েছেন ১০ লাখ মানুষ।
তার আগের অর্থবছরে নতুন কর্মসংস্থান হয়েছিল ১৪ লাখ। এ হিসেবে গত বছরে কর্মসংস্থান কমেছে ১ লাখ।’ এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘কর্মসংস্থান কমার কোনো কারণ নেই। তবে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ স্থবির রয়েছে।
কিন্তু তার পরও তো কিছুটা বিনিয়োগ হচ্ছে। কিন্তু বেকার সংখ্যা বাড়াটা স্বাভাবিক। কেননা প্রতিবছর ২০ লাখ মানুষ কর্মের বাজারে প্রবেশ করছে। সে তুলনায় কর্মসংস্থান হচ্ছে না।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘৬ কোটি ৩৬ লাখ শ্রমশক্তির মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৪ কোটি ৩৫ লাখ। আর নারীর সংখ্যা ২ কোটির মতো। ২০১৫-১৬ সালের জরিপে ৬ কোটি ২১ লাখ শ্রমশক্তির মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ছিল ৪ কোটি ৩১ লাখ।
আর নারীর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৯১ লাখ। এ হিসেবে ২ বছরে শ্রমশক্তিতে নারীর হার বেড়েছে প্রায় ৯ লাখ। আর শ্রম বাজারে নারীর অংশগ্রহণ দিন দিন বাড়ছে। ২০১৩ সালে ছিল ১ কোটি ৮২ লাখ।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে বেড়ে ১ কোটি ৯১ লাখ হয়। গত অর্থবছরে সেটি আরও বেড়ে দাঁড়ায় ২ কোটিতে।’ জরিপে দেখা যায়, ধীরে ধীরে শ্রমের রূপান্তর ঘটছে। এক সময় কৃষিনির্ভরতা থেকে বর্তমানে সেবা ও শিল্পের দিকে যাচ্ছে কর্মসংস্থান।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে কৃষি খাতে নিয়োজিত ছিল ২ কোটি ৫৪ লাখ মানুষ। সেখান থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কমে গিয়ে শ্রমিকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৪৭ লাখ। অন্যদিকে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সেবা খাতে।
গত অর্থবছরে সেবা খাতে কর্মসংস্থান হয়েছে ২ কোটি ৩৭ লাখ। তার আগের অর্থবছর এ সংখ্যা ছিল ২ কোটি ২০ লাখ। এছাড়া শিল্প খাতে গত অর্থবছরে নিয়োজিত ছিল ১ কোটি ২৪ লাখ, তার আগের অর্থবছরে এর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২২ লাখ।
প্রতিবেদন বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মোস্তফা কে. মুজেরি বলেন, ‘যে হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে সেই হারে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। এজন্য শুধু প্রবৃদ্ধি বাড়ালেই হবে না। কর্মসংস্থানের দিকেও বিশেষ নজর দিতে হবে। যাতে প্রবৃদ্ধির সঙ্গে কর্মসংস্থানের সংযোগ ঘটে।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘দেশে মোট কর্মসংস্থানের ৮৫ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতের। প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের সংখ্যা মাত্র ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ। মোট কর্মসংস্থানের এক-তৃতীয়াংশ মানুষের আনুষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা নেই।
প্রায় ১ কোটি ৫৭ লাখ কর্মজীবী মানুষের সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত। ১ কোটি ৮৭ লাখ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরুনো মানুষ। বাকিটা উচ্চ শিক্ষিত।
অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি রূপান্তর প্রক্রিয়ার মধ্যে যাচ্ছে। এর প্রতিফলন শ্রমশক্তি জরিপে দেখা যাচ্ছে। কৃষি খাত থেকে মানুষ আস্তে আস্তে শিল্প ও সেবা খাতের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ফলে এই দুই খাতে মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ছে।’
প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, জরিপে নারীর সত্যিকার ক্ষমতায়নের চিত্র উঠে এসেছে। শ্রমশক্তিতে পুরুষের তুলনায় নারীর অংশগ্রহণের হার বাড়ছে। এটা গর্ব করার মতো বিষয়।