Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

আপনাদের ভালোবাসাই পারে ছোট্ট এই মামনির কাছে তার বাবাটাকে ফিরিয়ে দিতে

rajib-mirসময়টা ২০০৫ অথবা ২০০৬। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকে গেছে ততোদিনে। মাষ্টার্স পরীক্ষা শেষ। একটি জাতীয় দৈনিকের ষ্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করছি। চট্টগ্রাম শহরে বাসা। তবে ক্যাম্পাসের মায়া কাটাতে পারিনি। রেলওয়ে ষ্টেশন, কাটাপাহাড়, ঝর্ণা, গোল পুুকুর আর সবুজ বনারণ্যের টানে মাঝে মধ্যেই ক্যাম্পাসে চলে যেতাম। জোৎস্না রাতে গোলপুকুরের পাড়ে, খেলার মাঠে কিংবা ফরেষ্ট্রির পাহাড় চুড়ায় ঘাসের উপর শুয়ে বসে বাঁশের বাঁশির সুরে সুরে লালন কিংবা নজরুলের গানে আসর জমতো।

এমনই এক আড্ডার টানে সারাদিনের পরিশ্রম শেষে ম্যাক্সিযোগে ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলাম। রাত তখন ১০টা ছুঁই ছুঁই। ম্যাক্সির মধ্যেই পানির তৃষ্ণা লাগতে শুরু করলো। তারপর প্রচন্ড বুকে ব্যথা। এরপর আর কিছু মনে নেই। পরদিন সকালে নিজেকে উদ্ধার করলাম চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বেডে। রাতভর হাসপাতালে আমার সঙ্গে ছিলো বন্ধু জাগরণ চাকমা ও আনিসুজ্জামান। তবে গল্পের এখানেই শেষ নয়। ম্যাক্সি থেকে কিভাবে আমাকে চমেক হাসপাতালে আনা হয় সেই গল্পটা দুই বন্ধুর কাছ থেকে শুনি। আমি অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর ম্যাক্সির চালক ও কয়েকজন যাত্রী মিলে আমাকে বিশ্বদ্যিালয়ের মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যায়। একজন ডাক্তার থাকলেও তিনি চিকিৎসা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। এমনকি এম্বুলেন্স থাকতেও চমেকে পাঠাতে রাজী হননি তিনি। মেক্সিটাও ততক্ষণে চলে গেছে। কার কাছ থেকে খবর পেয়ে আলো-অন্ধকারের মধ্যে হাসপাতালে ছুটে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত তরুন এক শিক্ষক। জরুরি ভিত্তিতে একটি এম্বুলেন্স যোগাড় করে দেয়ার জন্য কর্তব্যরত ডাক্তারের সঙ্গে রীতিমতো ঝগড়া শুরু করে দেন। শেষ পর্যন্ত এই বলে হুমকিও দেন – ‘আমাদের জাহিদের’ কিছু হলে তার সব দায়ভার কিন্তু আপনাকে বহন করতে হবে। বেচারা ডাক্তার কোন উপায়ন্তর না দেখে নিজের গাড়ী দিয়েই আমাকে চট্টগ্রাম শহরে পাঠিয়ে দিয়েছেন।

chardike-ad

দুরন্ত সেইসব দিনগুলিতে যাবতীয় আড্ডা-গানের মধ্যমনি ছিলেন একজনই। গানে, কবিতায়, কথায় কথায় রাত ভোর হয়ে যেতো। তবু আড্ডা চলতো। গত এক দশকে যারাই এই মানুষটির সংস্পর্শে এসেছেন, তাদের প্রায় সবার জীবনেই এরকম ছোট-বড় কিছুনা কিছু গল্প আছে। তারা জানেন, কী কর্মচঞ্চল, প্রাণোচ্ছল এই মানুষটি। নানান কারণে তিনি আলোচিত-সমালোচিত। ভুলে অথবা ভুলের শিকার হয়ে গত দু’টি বছর জীবনের চরম দুর্দশার মধ্যে কাটিয়েছেন্। তবে এতটুকুন দমে যেতে যান নি। এমন দু:খের মাঝেও মুখে সারাক্ষণ সেই ট্রেডমার্ক হাসিটা লেগে থাকতো। বইমেলা, কবিতা পাঠের আসর, দাবী আদায়ে আন্দোলনের মঞ্চ, ইফতার পার্টি, বিয়ে, জন্মদিন সব জায়গাতেই ছিলো তার সরব উপস্থিতি। কাগজ-কলম হাতে নিলেই বের হয়ে আসতো ঝরঝরে গদ্য কিংবা অর্থপূর্ণ পদ্যমালা। অথচ সেই প্রাণচাঞ্চল্য এখন ম্লান হয়ে মিলিয়ে যাবার উপক্রম!

rajibএতোক্ষণ ধরে যার কথা বলছি, তিনি আর কেউ নন; আমাদের সকলের প্রিয় রাজীব মীর। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক সহযোগী অধ্যাপক এবং সাবেক চেয়ার মীর মোশাররফ হোসেন রাজীব। যিনি এখন রাজধানী ঢাকার একটি হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় কাতরাচ্ছে। লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত। হাসপাতাল থেকে ঘুরে এসে স্নেহভাজন রাকিব হাসান জানালো, স্যারের শারিরীক অবস্থা খুব ভালো না। পেটে পানি জমে গেছে। ডাক্তারগণ বলেছেন মিডল স্টেজে আছেন উনি। এর আগে জরুরি ভিত্তিতে ১২ ব্যাগ রক্তও দিতে হয়েছে। স্যারের বোন জানিয়েছেন, যতদ্রুত সম্ভব তাকে ভারতে নিয়ে যাবার চেষ্টা করা হচ্ছে। তার যথাযথ চিকিৎসার জন্য ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা প্রয়োজন। দীর্ঘ সময় কর্মহীন থাকায় তার একার পক্ষে পুরো চিকিৎসার ভার বয়ে যাওয়া কোন মতেই সম্ভব না।

সম্প্রতি তিনি বিয়ে করে সংসারী হয়েছিলেন। তাদের কোলজুড়ে এক ফুটফুটে রাজকন্যাও এসেছে। ভাবীর হাতের মেহেদি এখনো শুকায়নি! ছো্ট্ট বাবুটা এখনো ভালো করে বাবা ডাকা শুরু করেনি! এর মধ্যেই কি সবকিছু শেষ হয়ে যাবে? থেমে যাবে এই উজ্জ্বল, উত্তাল প্রাণোচ্ছল জীবনানন্দ?

সবশেষ তার সঙ্গে দেখা হয়েছিলো ২০১৪ তে। জার্মানিতে চলে আসার কয়েকদির আগে। গাজীপুরের রাঙ্গামাটি রিসোর্টের সুইমিং পুলে স্নান করতে করতে কতো কথা! নানান পোজে ছবি তুলতে তুলতে কতো শতো প্ল্যান-পরিকল্পনার গল্প হয়েছিলো! সবকিছু এখন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। নিজেকে অপরাধী ভাবতে ইচ্ছা করছে। সবশেষ তার সঙ্গে কথা হয়েছিলো, কয়েক মাস আগে। ‘জাহিদ, আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও! ‘ এই ছিলো আমাদের কথোপকথনের শেষ বাক্য!

প্রিয় রাজীব মীর! আমাদের ভাই, বন্ধু, শিক্ষক, সহকর্মী এবং সর্বোপরি একজন হৃদয়বান মানুষ। এভাবে অকালেই চলে যাবে তরতাজা একটি প্রাণ? কীভাবে আমরা চুপ করে বসে থাকতে পারি? আমাদের কিছুই কি করার নেই? রাজীব মীরের বর্তমান অবস্থায় আমরা যে কেউ পৌছাতে পারি! জীবনের এই খেলাঘরে কে কতোক্ষণ, সেটা তো কারোরই জানা নেই। সেইসব হিসাব-নিকাশ পরে করা যাবে। এখন আসুন, সবাই মিলে আমাদের সবটুকুন ভালোবাসা নিয়ে প্রিয় এই মানুষটির পাশে দাঁড়াই। অন্য বন্ধুদেরকেও জানাই। আল্লাহর অসীম করুনা আর আমাদের সকলের দোয়া এবং ভালোবাসাই পারে ছোট্ট এই রাজকন্যার কাছে তার বাবাটাকে ফিরিয়ে দিতে!

জাহিদ আল আমীন, ফ্রাইবুর্গ, জার্মানি