Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

এই ‘গ্যারাইম্মা’ মানুষগুলোই বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে রেখেছে

fahadতলে তলে ঢাকার শিক্ষিত সমাজের একটা অংশ কতখানি ভোগবাদী, স্বার্থপর আর কূপমণ্ডূক হয়ে উঠেছে, তার বড় দৃষ্টান্ত স্থাপন করল রাজধানীর ‘ভালো’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলে পরিচিত ছাত্রীদের একটি কলেজ। গ্রাম থেকে আসা মেধাবীদের ‘গ্যারাইম্মা’ আখ্যা দিয়ে তাদেরকে ভর্তি করা হবে না বলে অভিভাবক ও ছাত্র-ছাত্রীদের প্রথমে জানিয়ে দেয় কলেজ কর্তৃপক্ষ। পরে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়ার ফলে নতুন করে বলা হয়েছে যে, ঢাকার বাইরে থেকে আসা ছাত্রীদের কলেজটির বসুন্ধরা ক্যাম্পাসে পড়তে হবে, মূল ক্যাম্পাসে নয়!

অথচ দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখেন। প্রধানমন্ত্রী নিজেও গ্রামের মানুষ। এই ‘গ্যারাইম্মা’ মানুষগুলোকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ কীভাবে সোনার বাংলা হবে, আমরা বুঝতে পারি না। মেধা তালিকার ভিত্তিতে কলেজে স্টুডেন্ট ভর্তি করার সিদ্ধান্ত দিয়েছে শিক্ষাবোর্ড। এখানে গ্রাম-শহর এর মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করার চেষ্টা সরকারকে চ্যালেঞ্জ করার শামিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশগুলোই বোর্ডগুলো বাস্তবায়িত করে। তাহলে রাজধানীর এই এলিট কলেজ কি এই রাষ্ট্রের বাইরের কোনো প্রতিষ্ঠান?

chardike-ad

কী উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কোন শক্তির ভরসায় রাজধানীর একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এইভাবে রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তকে বাতিল করে দিতে পারে? আমাদের শিক্ষা সচিব, শিক্ষামন্ত্রী, ঢাকার বড় বড় রাজনীতিবিদ, লেখক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরা কোথায়? নাকি তারাও সবাই শতভাগ ‘শহুরে’ হয়ে গেছেন? অথচ আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও গ্রামের মানুষ ছিলেন। গ্রামকে তিনি সবার উপরে স্থান দিয়েছিলেন। গ্রাম অগ্রসর না হলে, বাংলাদেশ অগ্রসর হবে না, এটা তিনি জানতেন এবং মানতেন। বঙ্গবন্ধু সরকার প্রণীত পঞ্চবার্ষিকী উন্নয়ন পরিকল্পনার মূল ভাবনায় ছিল গ্রাম-বাংলা। বাংলাদেশ মানেই গ্রাম-বাংলা। গ্রাম-বাংলাকে অবহেলা করা মানে বাংলাদেশকেই অবহেলা করা। আর এখানে তো গ্রামের ছেলে-মেয়েরা কোনো কোটা দাবি করছে না। ওরা নিজেদের যোগ্যতা বলে, মেধার শক্তিতে শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে এসেছিল। তবু কেন তাদের আটকে রাখার চেষ্টা?

শুধু এ জাতীয় কলেজ কেন, বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কয়েকটি বিভাগও গ্রাম থেকে আসা ছেলে-মেয়েদের সাথে এমন ন্যাক্কারজনক আচরণ করে। গ্রামের ‘আনস্মার্ট’ ছেলে-মেয়েগুলো যেন কোনোভাবেই সে বিভাগগুলোতে ভর্তি হতে না পারে এজন্য সদা তৎপর থাকে সেসব বিভাগের শিক্ষকদের একটা অংশ। যে ছেলে-মেয়েগুলোর পোশাকআশাক স্মার্ট, সুন্দর, শহুরে উচ্চারণে কথা বলে, তাদেরকেই এই স্বার্থপর শিক্ষকগুলো পছন্দ করে, নানা সুযোগ দেয়। অন্যদিকে ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করার সুবাদে গ্রামের যেসব শিক্ষার্থী সেসব ‘এলিট’ বিভাগে ভর্তি হয়ে যায়, তাদেরকে নানাভাবে কর্নারড করে রাখা হয়। এরপরেও গ্রামের ছেলে-মেয়েগুলোকে আটকে রাখা যায় না। এরা ঠিকই নিজের মেধা ও শ্রমের শক্তিতে দেশের নানা দায়িত্বশীল ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ খুঁজে নেয়। জীবিকার সন্ধানে মরিয়া গ্রামের ছেলে-মেয়েগুলোই বিজ্ঞানী, সাংবাদিক, পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট, কৃষি কর্মকর্তা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বাংলাদেশকে টিকিয়ে রাখে, এগিয়ে নিয়ে যায়। পোল্ট্রি ফার্ম করে, মৎস্য খামার দিয়ে এসব গ্রামের ছেলে-মেয়েগুলোই বাংলাদেশের অর্থনীতিকে নতুন শক্তিতে বলীয়ান করে।

আর খাঁটি শহুরে ছেলে-মেয়েদের কত শতাংশ দেশ গড়ার কাজে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছে সেটি এখন গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ছেলে-মেয়েদের অধিকাংশের টার্গেট থাকে নির্দিষ্ট সময় পড়ে ইউরোপ-আমেরিকায় পাড়ি জমানো। এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যাবসায়ীর সন্তানেরা ইংরেজি ভালো শিখলেও নিজের দেশে থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। বয়স হয়ে গেলেই এরা নিজের টাকায়, একটা অংশ বৃত্তি পেয়ে বিদেশে চলে যায়। অনেকে ছোটবেলা থেকেই বিদেশে বড় হয়। এরা নিজেরা ভালো থাকলেও দেশের কাজে খুব একটা আসে না।

আর মাদ্রাসা থেকে আসা স্টুডেন্টগুলোর বিড়ম্বনা, অপমান যেন আকাশকে ছুঁতে চায়। টুপি দাঁড়ি দেখলেই এক শ্রেণির শিক্ষক এমন আচরণ করেন যেন, এই মাদ্রাসার ছাত্ররা মনে হয়ে এলিয়েন। কীভাবে এত দূর আসল, এ নিয়ে দুনিয়ার প্রশ্ন করা হয়। সনদ জাল কি না, মাদ্রাসায় কেন পড়েছ? মাদ্রাসায় জঙ্গি ছিল কি না? বিভাগে ভর্তি হয়ে আবার জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পরবা না তো? ইত্যাদি নানা প্রশ্নে মাদ্রাসার ছেলেগুলোকে হীনমন্যতার সাগরে ফেলে দেয়া হয়। মাদ্রাসায় পড়লেই যদি মানুষ জঙ্গি হয়, তাহলে রাষ্ট্র মাদ্রাসা ব্যবস্থা রেখেছে কেন? গুলশানের হলি আর্টিজানে ভয়াবহ জঙ্গি হামলায় কিন্তু একজনও মাদ্রাসায় পড়া বা গ্রামের ছেলে-মেয়ে ছিল না। সেই হামলার প্রতিটি জঙ্গি ইংলিশ মিডিয়াম থেকে পাস করা হলিউডি ফ্যাশনের শহুরে নাগরিক ছিল।

সরকার হাজার হাজার কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে সারাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করছে। দেশের কিছু ‘ভালো’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইনকাম এত বেশি যে, এরা নিজেদের সরকারি হতে দিতে চায় না। এমপিওভুক্ত হয়েই থাকতে এদের অগ্রাধিকার। এর কারণ কী? সরকারি হয়ে গেলে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে ইচ্ছেমত অর্থ আদায় করতে পারবে না। প্রাইভেট পড়ানোর নামে সেসব ‘ভালো’ স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের লাগামহীন ইনকামের মহোৎসব চলছে। অথচ গ্রামের শিক্ষকদের একটা বড় অংশ এমপিওভুক্তির সুযোগ পর্যন্ত পায় না। এরা নামেমাত্র স্কুলের শিক্ষক হিসেবে দুই একটা টিউশনি করে কোনোমতে দিনাতিপাত করে।

বৈষম্যে ভরা বাংলাদেশে গ্রামের ছেলে-মেয়েরা নানা বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে শহরে আসে পড়তে। ‘শিক্ষিত’ মানুষ গিজগিজ করে শহরে। শহরে এসে আমাদের ছেলে-মেয়েরা যখন শিক্ষিত মানুষের কৌশলী বাধার মুখে পড়ে তখন আমাদের মনে শঙ্কা জাগে। এই শঙ্কা সোনার বাংলাকে ঘিরে। এভাবে বৈষম্য নিয়ে বড় হলে, বাংলাদেশ শুধু কিছু মানুষের টাকা কামাবার মেশিন হয়েই টিকে থাকবে। সবার জন্য সোনার বাংলা হবে না।

লেখক: শেখ আদনান ফাহাদ, সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সৌজন্যে ঢাকাটাইমস