Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

সরকারের শেষ সময়ে সংসদে বিল পাসের রেকর্ড

parliamentসরকারের শেষ সময়ে বিল পাসের রেকর্ড করেছে জাতীয় সংসদ। শেষ সময়ে মাত্র ১০ কার্যদিবসের ২২তম অধিবেশনে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিন বাদে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সাতদিনে ১৮টি বিল পাস হয়েছে। কোনো কোনো বিল সন্ধ্যার অধিবেশনে উত্থাপনের পর রাতেই সংশ্লিষ্ট কমিটি বৈঠক করে চূড়ান্ত করেছে। বিনা নোটিশেও বিল উত্থাপনের ঘটনা ঘটেছে।

এ সরকারের আমলে বিগত ২১টি অধিবেশনের কোনোটিতে এতগুলো বিল পাস হয়নি। এমনকি বিকেলে সংসদ অধিবেশনে বিল উত্থাপনের পর রাতেই সংসদীয় কমিটির বৈঠক করে বিল চূড়ান্ত করার নজিরও ছিল না।

chardike-ad

তবে এই অল্প সময়ে এতগুলো বিল পাস হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা তার সমাপনী বক্তব্যে বলেন, মাত্র দশ দিনে ১৮টি বিল পাস করেছি। এত অল্প সময়ে এত বিল কমই পাস হয়েছে।

এ জন্য তিনি বিরোধী দল জাতীয় পার্টিকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, প্রতিটি বিল তারা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পড়েছেন। মতামত দিয়েছেন। এবার বিলে অনেক বিষয়ের সঙ্গে সামাজিক বিষয় নিয়েও বিল পাস হয়েছে। অনেকে প্রশংসা করেছেন। কোনো খুঁত তারা খুঁজে পাচ্ছেন না।

কোন অধিবেশনে কতটি বিল পাস: সংসদ সচিবালয়ের আইন শাখা-১ থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দশম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন ২০১৪ সালের ২৮ জানুয়ারি শুরু হয়। এ অধিবেশনে দুটি, দ্বিতীয় অধিবেশনে ছয়টি, তৃতীয় অধিবেশনে পাঁচটি, চতুর্থ অধিবেশনে ছয়টি, পঞ্চম অধিবেশনে আটটি, ষষ্ঠ অধিবেশনে পাঁচটি, সপ্তম অধিবেশনে ছয়টি, অষ্টম অধিবেশনে ১০টি, নবম অধিবেশনে ৯টি, দশম অধিবেশনে ১৪টি, একাদশ অধিবেশনে ১৬টি, ১২তম অধিবেশনে ছয়টি, ১৩তম অধিবেশনে পাঁচটি, ১৪তম অধিবেশনে ১০টি, ১৫তম অধিবেশনে দুটি, ১৬তম অধিবেশনে সাতটি, ১৭তম অধিবেশনে দুটি, ১৮তম অধিবেশনে তিনটি, ১৯তম অধিবেশনে ১৫টি, ২০তম অধিবেশনে পাঁচটি, ২১তম অধিবেশনে ১৪টি বিল পাস হয়। অধিবেশনগুলোতে মোট ১৫৬টি বিল পাস হয়।

বিলের কারণে প্রশ্নোত্তর টেবিলে, জনগুরুত্বসম্পন্ন বক্তব্য স্থগিত: ২২তম অধিবেশনের বিলগুলো পাসের কারণে শেষ দিন মন্ত্রীদের প্রশ্নোত্তর পর্ব দেয়া হয় টেবিলে। কোনো কোনো কার্যদিবসে ৭১ বিধির জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বক্তব্য স্থগিত করা হয়। ফলে এমপিরা জরুরি জনগুরুত্বসম্পন্ন বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণের আওতায় নোটিশগুলো সংসদে উত্থাপন করতে পারেননি।

অধিবেশনের কার্যতালিকায় না থাকা সত্ত্বেও মাত্র ১০ মিনিটের নোটিশে বিল উত্থাপিত হতে দেখা গেছে। স্বল্প সময়ের এ অধিবেশনে বিল উত্থাপন ও পাসের জন্য তাড়াহুড়া করেছে সরকার। গত কয়েক দিনের অধিবেশনের তথ্যের ভিত্তিতে এমন মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা।

প্রথা ভেঙে বিল উত্থাপন, রাতেই চূড়ান্ত: প্রথা ভেঙে চলতি অধিবেশনেই আল হাইআতুল উলয়ালিল-জাম আতিল কওমিয়া বাংলাদেশের অধীন কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসের (তাকমিল) সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রির (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান প্রদান-সংক্রান্ত আইন-২০১৮ সংসদে উত্থাপিত হয়েছে। স্পিকারের বিশেষ ক্ষমতা বলে বিলটি উত্থাপনের দিন বিরোধী দলের এমপিরা প্রতিবাদ করলেও তা ধোপে টিকেটি। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী তার বিশেষ ক্ষমতাবলে বিলটি উত্থাপনের পর বুধবার তা পাস হয়।

১৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় কমিউনিটি ক্লিনিক সহায়তা ট্রাস্ট বিল-২০১৮ সংসদের অধিবেশনে উত্থাপনের পর রাতেই স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ২৪তম বৈঠকে চূড়ান্ত করে।

২২তম অধিবেশনে পাস হলো যেসব বিল: চলতি সংসদে পাস হওয়া বিলগুলো- ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল-২০১৮, সড়ক পরিবহন বিল-২০১৮, আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশের অধীন কওমি মাদরাসাসমূহের দাওয়াতে হাদিসের (তাকমিল) সনদ মাস্টার্স ডিগ্রির (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান (কওমি মাদরাসা) বিল-২০১৮, জাতীয় পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমি বিল-২০১৮, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন বিল-২০১৮, বস্ত্র বিল-২০১৮, হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট বিল-২০১৮, বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বিল-২০১৮, বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ড (সংশোধন) বিল-২০১৮, যৌতুক নিরোধ বিল-২০১৮, সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় বিল-২০১৮, সার ব্যবস্থাপনা (সংশোধন) বিল-২০১৮, কৃষি বিপণন বিল-২০১৮, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বিল-২০১৮ এবং শেষ দিন বৃহস্পতিবার জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ বিল-২০১৮, পণ্য উৎপাদনশীল রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠান শ্রমিক (চাকরি শর্তাবলি) বিল ২০১৮, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট বিল-২০১৮ এবং কমিউনিটি ক্লিনিক সহায়তা ট্রাস্ট বিল-২০১৮ পাস হয়। প্রতিটি বিল পাসে গড় ২০-২৫ মিনিট সময় ব্যয় হয় বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া বলেন, এতে দোষের কিছু দেখি না। বেশি বিল পাস হলেও যথাযথ আইন অনুসরণ করেই বিলগুলো পাস হয়েছে।

আওয়ামী লীগের একাধিক বর্ষীয়ান নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সামনে নির্বাচন থাকায় সরকার অনেককে খুশি করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য কওমি মাদরাসা ও সড়ক পরিবহন-সংক্রান্ত বিল দুটি পাস করেছে।

সংসদের একাধিক কর্মকর্তা জানান, আগামীতে সরকার যদি ক্ষমতায় আসে বিএনপি বিরোধী দল হিসেবে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। ওই সময় অনেক বিল পাস করা কঠিন হবে। কারণ চরম বিরোধিতার মধ্যে পড়তে হবে তাদের। এ জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা বিলের মতো আইন পাস করেছে।

বিল পাস নিয়ে টিআইবি যা বলে: ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী এমপিদের প্রধান কাজ আইন প্রণয়ন করা হলেও মাত্র সাত শতাংশ সময় ব্যয় হয়েছে আইন প্রণয়ন কাজে। সংসদে একটি বিল পাস হতে গড়ে ‘মাত্র’ ৩৫ মিনিট সময় লাগে। বিলের খসড়ায় জনমত যাচাই-বাছাইয়ের সব প্রস্তাব নাকচ হওয়ায় আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহণের চর্চা এখনও সীমিত। এ কারণে ভুলেভরা অনেক বিল পাস হয়।

বিষেজ্ঞরা যা বললেন: এ বিষয়ে সংসদবিষয়ক গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন বলেন, এখন সংসদে পাস হওয়া অনেক বিলেই এক ধারার সঙ্গে অন্য ধারার অসঙ্গতি দেখা যায়। আবার অনেক বানান ভুল ও যথোপযুক্ত শব্দের পরিবর্তে অন্য শব্দ দেখা যায়। তড়িঘড়ি করে বিলগুলো পাসের ফলে এ ধরনের ভুল হয়। এ ছাড়া আইন পাসে এমপিদের অংশগ্রহণ কম হওয়ায় ভুলের অন্যতম কারণ।

কমিউনিটি ক্লিনিক সহায়তা ট্রাস্ট বিল-২০১৮ বৃহস্পতিবার পাস হয়। এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির এমপি ফখরুল ইমাম সংসদে বলেন, ‘এ বিলটি ১৮ সেপ্টেম্বর সংসদে উত্থাপন হয়। সেদিন রাতেই সংসদীয় কমিটি এটি ‘পরীক্ষা নিরীক্ষা’ করে পরদিন সংসদে উত্থাপন করে। বৃহস্পতিবার তা পাস হয়। আমরা এটি দেখার জন্য মাত্র একদিন সময় পেয়েছি। তাই এ বিলটি পাস না করে জনমত যাচাইয়ের জন্য ফেরত পাঠানোর দাবি করছি।’ কিন্তু তার এ দাবি আমলে নেয়া হয়নি।

এ বিষয়ে সংসদের প্রধান হুইপ আ স ম ফিরোজ বলেন, সংসদ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে। আইনগুলোও জনগণের জন্য। এ জন্য বিলগুলো পাস করা হয়েছে। দ্রুত বিল পাস হওয়ায় আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।

অংশীজনের আপত্তি সত্ত্বেও যে গুরুত্বপূর্ণ বিল পাস: এ অধিবেশনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিল পাস হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সাংবাদিকদের দাবি উপেক্ষা করে পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। বিলটি পাসের আগে সম্পাদক পরিষদের সঙ্গে বৈঠক করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। এ জন্য এ বিলটি প্রত্যাখ্যান করেছে সম্পাদক পরিষদ।

সংগঠনটি এক বিবৃতিতে বলেছে, প্রতিবাদ-বিক্ষোভ এবং সাংবাদিক ও গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্বেগ পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে। বিলটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুতর হুমকি। বিলটি পাসের আগে আবার সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠকের কথা থাকলেও তা করা হয়নি।

এ ছাড়া পাস করা হয় সড়ক পরিবহন বিল, কওমি মাদরাসাগুলোর দাবির প্রেক্ষিতে ‘কওমি মাদরাসাগুলোর দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান আইন এ অধিবেশনে পাস হয়েছে। অবশ্য কওমির বিলটি পাস হওয়ায় সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে মিছিল করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

প্রসঙ্গত, সামনে মাত্র একটি অধিবেশনই বর্তমান সরকারের। ১৪ অক্টোবর আরেকটি অধিবেশন বসার কথা রয়েছে। সেই অধিবেশনের মাধ্যমেই ইতিটানা হবে বর্তমান সংসদের। এ জন্য তাড়াহুড়ো করে বিল পাস করা হচ্ছে।

সৌজন্যে- জাগো নিউজ