Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

ফেরত আসা শ্রমিকদের দায় নিচ্ছে না দুই এজেন্সি

malaysia-bangladeshiবাংলাদেশ থেকে ৬২ জন শ্রমিককে মালয়েশিয়ায় কলিং ভিসায় পাঠিয়েছিল ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল ও প্যাসেস অ্যাসোসিয়েটস। সে দেশে সুপার ম্যাক্স গ্লোব নামের একটি কোম্পানিতে ওই শ্রমিকদের কাজ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শ্রমিকরা কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে পৌঁছে দুই দিন অপেক্ষা করার পরও সুপার ম্যাক্স গ্লোব থেকে কেউ তাদের রিসিভ (গ্রহণ) করতে আসেনি। এ অবস্থায় দেশটির ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ ওই শ্রমিকদের দেশে ফেরত পাঠায়। ফেরত আসার পর শ্রমিকদের ব্যাপারে দায় নিতে চাচ্ছে না প্রতিষ্ঠান দুটি। অভিযোগ উঠেছে, ওই প্রতিষ্ঠান দুটি একে অপরকে দায় দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে ১০ অক্টোবর বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে ৬২ জন শ্রমিক মালয়েশিয়া যান। মালয়েশিয়া পৌঁছানোর পর সেখানে তাদের গ্রহণ করার জন্য কোম্পানির পক্ষ থেকে লোক আসার কথা ছিল। কিন্তু কেউ না আসায় তাদের ফেরত পাঠায় দেশটির ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ।

chardike-ad

দেশে ফেরত আসা শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা দেশটিতে পৌঁছানাের পর বিমানবন্দরের ভেতরে ২৪ ঘণ্টা অপেক্ষা করেন। তারা সংশ্লিষ্ট কোম্পানির কাউকে পাননি। পরে দেশটির ইমিগ্রেশন পুলিশ তাদের বিমানবন্দরের একটি কক্ষে আটকে রাখে। সেই কক্ষে তারা এক দিন এক রাত থাকার পর তাদের ফেরত পাঠানো হয়।

এই শ্রমিকদের বেশির ভাগই জায়গা-জমি, দোকান, ঋণ করা টাকা সংগ্রহ করে এজেন্সিগুলোকে দিয়েছিলেন। তাদের স্বপ্ন ছিল, বাড়তি আয় হবে, সংসারে সচ্ছলতা ফিরবে। ঘটেছে উল্টো। কী করে সামনের দিন চলবে সেই চিন্তায় এখন তাদের মাথায় হাত।

এদিকে বেশ কয়েক মাস ধরে মালয়েশিয়ায় ধরপাকড় চলছে। অনেক বাংলাদেশি শ্রমিককে ধরে জেলে রাখা হচ্ছে। কেউ কেউ ছাড়া পেয়ে দেশে চলে আসছেন বা দেশটিতে গা-ঢাকা দিয়ে থাকছেন। এসব খবর প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমেও আসছে। এরই মধ্যে কলিং ভিসা বন্ধের ঘোষণাও আসে দেশটির পক্ষ থেকে। কিন্তু কলিং ভিসা বন্ধের পরও কিছু এজেন্সি লোক পাঠানোর নামে প্রতারণা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

সম্প্রতি ফেরত আসা শ্রমিকদের সঙ্গে এ প্রতারণাই করা হয়েছে। স্বল্প শিক্ষিত ও গ্রামের এসব সহজ-সরল মানুষের অনেকেই এখনো বিষয়টি বুঝে উঠতে পারেননি। তাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, ফেরত আসা শ্রমিকদের দুই বছরের চুক্তিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা এখনো জানতে পারেননি কী কারণে তাদের ফেরত আসতে হলো। আর কী সমস্যা ছিল তাদের কাগজপত্রে।

বিষয়টি জানার জন্য কয়েকজন গতকাল (১৪ অক্টোবর) দুুপুরে বনানীতে থাকা দুই এজেন্সির অফিসে গেলে ফেরত আসা কয়েকজন শ্রমিক তাদের পাসপোর্ট আটকে রেখে দিয়েছে বলে জানান।

দেশে ফেরা বগুড়া সদরের আনোয়ার হােসেন জানান, তিনি মালয়েশিয়া যাওয়ার আগে চট্টগ্রামে ভবন নির্মাণের কাজ করতেন। সেখানে কাজ করে ভালোই টাকা পেতেন। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি মেজ। তার টাকায় বাবা-মা সংসার চালাতেন। জমি-জমা বলতে ভিটে ছাড়া তেমন কিছু নেই। তার পরিবার জমি বিক্রি করে ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালকে সাড়ে তিন লাখ টাকা দেন। আশা ছিল, দেশটিতে গিয়ে তিনি টাকা কামাই করে আবারও জমি কিনবেন। কিন্তু তা আর হলো না।

আনোয়ার বলেন, ‘২৪ ঘণ্টা বিমানবন্দরের ভেতরে ছিলাম। সেখানে তারা এক বেলা কিছু খাবার দিছিল। পরে আমাদের একটা রুমে বন্দী করা হইছিল। এক দিন এক রাত আছিলাম। মাত্র এক বেলা খাওয়াইয়া দেশে পাঠায় দিছে।’

আনোয়ার জানান, সেই রাত আর দিনের কথা মনে হলে তার গা শিউরে ওঠে। বন্দী থাকাকালীন ভেবেছিলেন আর হয়তো কখনোই দেশে ফিরতে পারবেন না। স্বজনদের মুখ দেখতে পাবেন না।

বগুড়ার আনোয়ারের মতোই কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ার নাসিরও গিয়েছিলেন মালয়েশিয়ায়। মালয়েশিয়ায় পাড়ি দেওয়ার আগে রিপন এলাকায় একটি খাদ্য উৎপাদনকারী কোম্পানির ডিলার হিসেবে কাজ করতেন। তার দুই সন্তানের কথা চিন্তা করে তিনি বিদেশ যান।

রিপন জানান, তাকে মালয়েশিয়ার সুপার ম্যাক্স কোম্পানিতে চাকরি দেওয়া হবে। সেখানে তিনি আট ঘণ্টা কাজের পাশাপাশি আরও ছয় ঘণ্টা করে ওভারটাইম করতে পারবেন। সব মিলে মূল বেতনে এক হাজার রিঙ্গিতের সাথে ওভারটাইমের টাকাও তাকে দেওয়া হবে। এই স্বপ্নে বিভাের হয়ে তিনি বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পরে মালয়েশিয়ায় যান ঠিকই কিন্তু সেখানকার বিমানবন্দর আর অতিক্রম করতে পারেননি।

কেন বিদেশ গেলেন আর কেনই বা ফিরে এলেন—এমন প্রশ্নের জবাবে রিপন বলেন, ‘শুনলাম এজেন্সির সাথে নাকি কোম্পানির ঝামেলা আছিল। কিন্তু সেসব তারা আমাদের বলে নাই। আর এজেন্সিরে তো ধইরা সকলে যাইতাছে। তাই আমিও গেছিলাম। বিদেশ যাওয়ার তো আর কোনো বিকল্প পথ দেখি না।’

এমনই আরেকজন ভুক্তভোগী হচ্ছেন নাসির। তিনি জানান, তার এলাকার এক ব্যক্তির মাধ্যমে তিনি মালয়েশিয়া যাওয়ার তথ্য পান। পরে তাকে ম্যানেজ করে হাতে ৫০-৬০ হাজার দিয়েছিলেন। বাকি সব টাকাও তার মাধ্যমে তিনি এজেন্সিকে দেন। তবে এজেন্সির মালিক স্বপনের সাথে তার কখনোই দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি।

দেশে ফেরার পর তিনি ওই এজেন্সির অফিসের সাথে যােগাযােগ করতে গেলে তারা তার পাসপোর্ট রেখে দিয়ে জানিয়েছে, সামনের সপ্তাহে নাকি তারা তাকে আবারও সে দেশ পাঠাবে। কিন্তু বিষয়টি যাচাই-বাছাই করার মতো তেমন জ্ঞান বা শক্তিও নেই নাসিরের। কারণ তিনি গ্রামের স্বল্প শিক্ষিত মানুষ।

নাসির মালয়েশিয়ার ভাষা ও সেখানে কী কাজ করবেন—কিছুই জানতেন না। তারপরও তারা তাকে সে দেশের কোম্পানিতে চাকরির জন্য পাঠিয়েছিল। ভাগ্য ভালো যে মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন পুলিশের হাতে তারা আটক হওয়ার পরও দেশে ফিরতে পেরেছেন।

নাসির জানান, রাজধানীর বনানীর এলাকার কবরস্থানের পূর্ব পাশের ২২ নম্বর রােডের ১১ নম্বর বাসায় তাদের মেডিকেলের জন্য নেওয়া হয়েছিল। সেখানেই তাকে পাঠায় এজেন্সির অফিস। কিন্তু তিনি এজেন্সির ম্যানেজার আদিল সরদারের নাম বলতে পারলেও সংশ্লিষ্ট কারো ফােন নম্বর দিতে পারেননি।

ফেরত আসা ফেনীর আবুল হাসান জানান, তারা সবাই কলিং ভিসায় গিয়েছিলেন। তাদের বলা হয়েছিল সেখানে গেলে এক হাজার রিঙ্গিতে তারা কাজ করবেন। আর তাদের কলিং ভিসার মেয়াদ নভেম্বর পর্যন্ত থাকলেও আগেই তাদের ফেরত পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা এত টাকা-পয়সা খরচ করে গেলাম, এর দায়ভার ক্যাথারসিসকে নিতে হবে।’

ফেরত আসা এই শ্রমিকরা এজেন্সির ঠিকভাবে নাম ও নম্বর দিতে না পারলেও অনুসন্ধান করে বের করা হয় দুই এজেন্সির নাম ও ঠিকানা। পরে রবিবার সন্ধ্যায় তার একটি এজেন্সি ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালে যাওয়া হয়। বনানীর কে ব্লকের ২২ নম্বর রােডের ১১ নম্বর বাসায় ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের অফিস।

আরও খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় জি টু জি চুক্তির অধীনে শ্রমিক পাঠানাে ১০ এজেন্সির এটি একটি। প্রতিষ্ঠানটির ভেতরে ঢুকতেই লাল মিয়া নামের একজন ছুটে এলেন। জানতে চাইলেন, নিজে বিদেশ যাব নাকি কাউকে বিদেশ পাঠাব। পরে ‘না’-সূচক জবাব শুনে তিনি কিছুটা দমে গেলেন। জানতে চাইলাম প্রতিষ্ঠান কোন কোন দেশে লোক পাঠায়। তিনি জানান, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ। তবে এখন ভুটানও পাঠাচ্ছে। ভুটান যেতে কত লাগবে এবং কোন ভিসায় পাঠাতে পারবেন? এ প্রশ্নে তিনি জানান, ভুটান যেতে দুই লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ হবে আর হোটেল ভিসায় তিনি পাঠানোর ব্যবস্থা করে দেবেন। ভুটানে গেলে ১৮০০ ডলারে কাজের সুুযোগ করে দেবে এজেন্সি।

প্রতিষ্ঠানটির অফিসে গিয়ে ম্যানেজার আদিল সরদারের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, তারা বর্তমানে মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানো বন্ধ রেখেছেন। ভিসা চালু হলে আবার পাঠাবেন। তবে সময় লাগবে আরও দুই থেকে তিন মাস।

একটি সূত্র বলছে, হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের এক কর্মকর্তার সঙ্গে সখ্য রয়েছে ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের। তারা তাদের টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করে কুয়ালালামপুর বিমানবন্দর পর্যন্ত এই ৬২ ব্যক্তিকে পাঠায়। কিন্তু তাদের ভিসা সমস্যার কারণে তাদের আবারও দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

বিষয়টি জানতে ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক ও বায়রার সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন স্বপনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাকে ফােনে পাওয়া যায়নি। এরপর তার প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকেও পাওয়া যায়নি।

প্যাসেস অ্যাসোসিয়েটসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আরিফ আলমকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা আসলে পাঠাইনি। অন্য দুই প্রতিষ্ঠান পাঠিয়েছে। এ বিষয়ে আমি আপনার সাথে পরে কথা বলব।’ পরে আরিফ আলমকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।

প্রান্তিক ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরিজমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাকিব মোস্তফা বলেন, ‘আমরা এসব শ্রমিকদের পাঠাইনি। দুই এজেন্সির (ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল ও প্যাসেস অ্যাসোসিয়েটস) মাধ্যমে অটো হয়ে আসা ভিসাগুলো আমরা প্রসেসিং করেছি মাত্র। আসলে তারাই এসব শ্রমিক পাঠানাের কাজ পেয়েছিল।’

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) অর্থ সম্পাদক শওকত হোসেন সিকদার বলেন, ‘কলিং ভিসা এখনো আসতেছে। কিন্তু কোনো মেডিকেল হচ্ছে না। কোনো বই (চাহিদাপত্র) পাঠানো হচ্ছে না। সেগুলোই এখনো আসছে। চলতি মাসেও শ্রমিক মালয়েশিয়ায় যাচ্ছে। ওইটা কোম্পানির সঙ্গে এজেন্সির একটি ঝামেলা ছিল। দেশটির কোম্পানির সাথে একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। তবে সেটা মীমাংসাও হয়ে গেছে। এরই মধ্যে আবার কলিং ভিসার মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে। এ কারণে তাদের ফেরত আসতে হয়েছে। তবে দুই এজেন্সি দ্রুত তাদের ভিসাগুলো নবায়ন করে আবারও পাঠাবে।’

সৌজন্যে- প্রিয়.কম