Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

সারাবিশ্বে পরীক্ষার সংখ্যা কমছে, বাংলাদেশে বাড়ছে

examবিষয়ভিত্তিক জ্ঞান প্রদানের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলাটা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলেও বর্তমানে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে পরীক্ষায় ভালো ফল। ফলের জন্য সন্তানকে কেবল শ্রেণীকক্ষে পাঠিয়ে নিশ্চিত হতে পারছেন না অভিভাবকরা; তাই তারা ছুটছেন টিউশনের পেছনে। শিক্ষাব্যবস্থায় পরীক্ষার ধরন ও শিক্ষার্থীদের ওপর এর প্রভাব সম্পর্কে জানতে গত বছর এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের কয়েকটি দেশে গবেষণা চালায় জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো।

এর অংশ হিসেবে এ অঞ্চলের নয়টি দেশের বিভিন্ন স্তরের পাঁচ হাজার শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেন গবেষকরা। পরীক্ষায় প্রস্তুতি নিতে শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশকে শ্রেণীকক্ষের বাইরে প্রাইভেট টিউশন গ্রহণ করতে হয় বলে ওঠে আসে তাদের গবেষণায়। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে প্রাইভেট টিউশন গ্রহণের হার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে।

chardike-ad

গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে সম্প্রতি ‘দ্য কালচার অব টেস্টিং : সোসিও কালচারাল ইমপ্যাক্টস অব লার্নিং ইন এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে ইউনেস্কোর ব্যাংকক কার্যালয়। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশে ৯২ শতাংশ শিক্ষার্থীই প্রাইভেট টিউশন গ্রহণ করে; যদিও প্রতিবেশী দেশ ভারতে এই হার ৫০ শতাংশ। প্রাইভেট টিউশন গ্রহণের হার সবচেয়ে কম ফিজিতে। দেশটিতে মাত্র ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ের বাইরে প্রাইভেট টিউশন গ্রহণ করে। অন্য দেশগুলোর মধ্যে প্রাইভেট টিউশন গ্রহণের হার কাজাখস্তান ও ভিয়েতনামে ৭০ শতাংশ, রিপাবলিক অব কোরিয়ায় ৬৮ শতাংশ এবং ফিলিপাইনে ৩৫ শতাংশ। ইউনেস্কোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাইভেট টিউশনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে কোচিং সেন্টারের সংখ্যা খুবই দ্রুতগতিতে বাড়ছে। এক্ষেত্রে শহর ও গ্রামে সবখানেই সমান প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। সন্তানের ভালো ফললাভে পিতা-মাতার উচ্চ প্রত্যাশাকেই এর অন্যতম কারণ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ বিদ্যালয়ের বাইরে কোচিং সেন্টারের ওপর নির্ভরশীল। আবার কোথাও কোথাও বিদ্যালয়ের মধ্যেই প্রাইভেট টিউশনের প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। পরীক্ষায় ভালো করাই মূল উদ্দেশ্য। পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিশ্চিত করতে পিতা-মাতারা সন্তানদের কোচিংয়ে পাঠাচ্ছেন। এদিকে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় পরীক্ষার সংখ্যা অনেক বেশি বলে প্রতিবেদনটিতে উঠে এসেছে। বাংলাদেশের জরিপে অংশ নেয়া ৬২ শতাংশের মধ্যে ৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থীই পরীক্ষা সংখ্যাকে অনেক বেশি বলে মত দিয়েছেন। পরীক্ষার সংখ্যা বিষয়ে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ কমাতে পরীক্ষার সংখ্যা কমিয়ে আনছে। অথচ বাংলাদেশে এ সংখ্যা বাড়ছে। নানা সমালোচনা ও প্রতিবাদ সত্ত্বেও প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা হচ্ছেই।

আমাদের দেশের ৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থী শ্রেণীকক্ষের ভেতরে সপ্তাহে সাত ঘণ্টার বেশি সময় পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য ব্যয় করে, যা এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। আর ৪৮ শতাংশ শিক্ষার্থী পরীক্ষা প্রস্তুতির জন্য শ্রেণীকক্ষের বাইরে সপ্তাহে সাত ঘণ্টার বেশি সময় ব্যয় করে। বাংলাদেশের ৮২ শতাংশ পিতা-মাতাই ভালো ফল অর্জন উদযাপন করেন। এক্ষেত্রে বাসায় সুস্বাদু খাবার রান্না, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের মাঝে মিষ্টি বিতরণ ও সন্তানকে উপহার দেয়া হয়। দেখা যায়, কোচিং সেন্টারগুলোও বিষয়টিতে ক্রেডিট নিয়ে থাকে। পরীক্ষায় ভালো ফল উদযাপন ও খারাপ ফল দেখে রাগ ও ক্ষোভ দেখানো কোনটিই শিক্ষার্থীর জন্য মঙ্গলজনক নয় বলে মন্তব্য করেছেন এমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, অতি উদযাপনের মাধ্যমে পরবর্তী পরীক্ষায়ও ভালো ফল লাভের আরেকটি চাপ সৃষ্টি হয়। রাগ-ক্ষোভ প্রকাশের ফলে সন্তান হতাশ হয়। অনেক সময় তা মেনে না নিতে পেরে কেউ কেউ আত্মহত্যার পথও বেছে নেয়। তাই এগুলো নিয়ে বাড়াবাড়ি না করে ছেলেমেয়েরা ঠিকমতো শিখছে কিনা, সে বিষয়ে আমাদের নজর দিতে হবে।

শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘কোচিং সেন্টার বন্ধে উচ্চ আদালত কোচিং গাইড, নোটবই বেআইনি ঘোষণা করেছেন। আমাদের হাতে আইন প্রয়োগ করার ক্ষমতা নেই। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আইনগতভাবে কোচিং গ্রহণযোগ্য নয়, তারপরও কোচিং গাইড, নোটবই চলছে, বন্ধ করার চেষ্টাও চলছে।’ রাজধানী ঢাকায় এ ধরনের কোচিং ব্যবসার পেছনে কত অর্থ ঢালা হয়? গোটা দেশে কত অর্থ যায় এ নিষিদ্ধ ব্যবসায়? এটি কি আসলেই নিষিদ্ধ ব্যবসা? সরকারি ডাক্তাররা যখন হাসপাতালে ঠিকমতো চিকিৎসা না করে কিংবা হাসপাতালের রোগীদের নিজ ক্লিনিকে পাঠিয়ে থাকেন, তখন একজন শিক্ষক পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের অর্থের বিনিময়ে পড়াতে পারবেন না কেন? শুধু তাই নয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গাদাগাদি করে শিক্ষার্থীদের বসতে হয়, সেখানে সব শিক্ষার্থী ক্লাসের পড়া ঠিকমতো বুঝতে পারে না। তাছাড়া সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কন্ট্যাক্ট আওয়ার বা ক্লাসরুম ঘণ্টা কম হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত বা প্রয়োজনমতো প্র্যাকটিস করতে পারে না। তাই তাদের অতিরিক্ত ঘণ্টা শিক্ষকের বাসায় বা কোনো কোচিং সেন্টারে কাটাতে হয়।

রাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি বিভাগেই লাখ লাখ টাকার ঘুষ লেনদেন হয়, শিক্ষা বিভাগও এ থেকে মুক্ত নয়। উচ্চশিক্ষিত লোকজন মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে কোনো নাগরিকের প্রাপ্য কাজ করে থাকেন। তাদের পেছনে দুদক নেই, আইন নেই, সমালোচনাও নেই; যেন ঘুষের বিনিময়ে কাজ করাটাই স্বাভাবিক। অথচ শিক্ষকদের মধ্যে কেউ কেউ অতিরিক্ত শ্রম দিয়ে কিছু অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন করছেন, এটিকে নিষিদ্ধ ব্যবসা বলা কতটা সঠিক, তাও ভেবে দেখার সময় এসেছে। তবে এটির একটি সুষ্ঠু সমাধান দরকার, কারণ একদল অভিভাবক মাসে দশ হাজার বা তারও বেশি অর্থ খরচ করে বাচ্চাদের কোচিং করাবেন, আর বিদ্যা ও ফল কিনে নেবেন; আর যারা পারবেন না, তাদের মধ্যে যে বিরাট বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে- আমরা তা মেনে নিতে পারি না। আবার শিক্ষকরা প্রাইভেট কোচিং যে একেবারে বন্ধ করে শুধু ক্লাসরুমে পাঠদান করবেন, এটি আদর্শের কথা; কিন্তু আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শ্রেণীকক্ষ ব্যবস্থাপনা, সর্বোপরি পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাপনা সেই আদর্শের ধারেকাছেও নেই। কাজেই কোচিং বন্ধ করতে হবে, আইন করা হয়েছে; কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না এসব বাস্তব কারণগুলোর জন্য- এটি আমাদের বুঝতে হবে।

দ্বাদশ শ্রেণী, যা বিশ্বের বহু দেশেই মাধ্যমিক শিক্ষা বলা হয়; আমাদের দেশে তা উচ্চমাধ্যমিক এবং এই বারো বছরের শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করতে একজন শিক্ষার্থীকে চারটি পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়। পরীক্ষা অর্থাৎ অ্যাসেসমেন্টে সমস্যা ছিল না, যদি সেটি ‘জেনুইন’ হতো- যার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থীর সুপ্ত প্রতিভা আবিষ্কার করা যেত। তা তো হচ্ছে না! নির্দিষ্ট ধাঁচের কিছু প্রশ্নের ওপর প্রস্তুতি নিলেই একজন শিক্ষার্থী আমাদের এই পাতানো অ্যাসেসমেন্টে অনেক উঁচু স্কোর করতে পারে যা জীবনের আসল পরীক্ষার কথা বলে না। একটি বিষয়ে একজন শিক্ষার্থীর যে জ্ঞান অর্জন করার কথা, তা পরিমাপ করার জন্য এই প্রচলিত অ্যাসেসমেন্ট সিস্টেম ব্যর্থ হচ্ছে। আবার এই অ্যাসেসমেন্টের ফলের ওপর ভিত্তি করেই উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হওয়ার শর্ত, চাকরি পাওয়ার শর্ত পূরণ করা হয়। উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হওয়া যায়, চাকরিও পাওয়া যায়- কারণ সর্বত্রই যেন এক অজানা ফাঁকা এবং বড় এক ধরনের গ্যাপ রয়ে গেছে। আর তাই চাকরি প্রাপ্তির পরেও একজন উচ্চশিক্ষিত কর্মকর্তা কাক্সিক্ষত সেবা প্রদান করতে পারেন না তার দেশকে; সেবা গ্রহীতাকে।

টিভির পর্দায় দেখলাম- ভারতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে মিউজিক প্রতিযোগিতা। তাতে বাংলাদের স্টেজ মাতানো শিল্পী মাঈনুল আহসান নোবেল অংশগ্রহণ করছে। সে বলছে, পড়াশোনার প্রতি তার খুব একটা মনোযোগ নেই; তাই পরিবারের সবাই এখনও তাকে বকাঝকা করে। সে এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে গোটা ভারতবর্ষে নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পৌঁছে গেছে, সবাই তাকে চেনে। তার গানও অদ্ভুত। সে প্রাতিষ্ঠানিক এ ধরাবাঁধা লেখাপড়া দিয়ে কী করবে- এ বিষয়টি আমরা এখনও বুঝতে পারছি না অর্থাৎ শুধু একাডেমিক বিষয়ে ভালো করা এবং পরীক্ষাকেন্দ্রিক লেখাপড়া ও ফল জীবনের সাফল্যের কথা খুব একটা বলে না।

বছর দু’য়েক আগে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান মারসারের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে যে অসামঞ্জস্য; তাতে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টিতে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২৫ থেকে ৫৪ বছর বয়সীদের ৮২ শতাংশ কর্মে নিয়োজিত থাকলেও এর মধ্যে মাত্র ৬ দশমিক ৩ শতাংশ উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন। বাকিদের মধ্যে ৫৩ শতাংশ আধা বা মাঝারি দক্ষ ও ৪০ দশমিক ৭ শতাংশ অদক্ষ। আমাদের দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি করতে হবে, সেখানে শুধু একাডেমিকের ভালো ফল বুঝায় না। আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতি সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপ্তি নিশ্চিত করলেও জ্ঞানের গভীরতা তৈরিতে খুব একটা সামর্থ্য দেখাতে পারে না। তাদের পড়াশোনার চর্চা, অনুশীলন মার্ক স্কিমনির্ভর, যাতে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ থাকে প্রশ্নের কোনো অংশের উত্তর কেমন হলে কত নম্বর পাবে একজন পরীক্ষার্থী। মার্কস্কিম চর্চা করে আশানুরূপ ফল পাওয়া সহজ। বিদ্যালয়ের বাইরে বাকি সময়টুকু মার্কস্কিম চর্চা করতেই ব্যয় হয়। পাঠ্যবইয়ের বা সিলেবাসের বাইরে তাদের ইচ্ছে থাকলেও অন্যকিছু পড়ার সুয়োগ তাদের নেই; ফলে প্রকৃত সৃজনশীলতার চর্চার জায়গাটি আমরা সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি। সবশেষে মনে রাখতে হবে, শ্রেণীকক্ষে আমরা যদি সুশিক্ষক না দিতে পারি; তাহলে শিক্ষা সংক্রান্ত অন্যান্য আয়োজন বৃথা যাওয়ার শামিল।

লেখক- মাছুম বিল্লাহ, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত, সাবেক ক্যাডেট কলেজ শিক্ষক