কুয়েতে বর্তমানে শ্রমিক ভিসা বন্ধ। তবুও গত ৩/৪ বছরে লামানা করে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে শর্ত-সাপেক্ষে ভিসা চালু হলে সেই ভিসায় সাত থেকে আট লাখ টাকার বিনিময়ে স্বপ্ন পূরণের আশায় দেশটিতে পাড়ি জমান অদক্ষ ও শিক্ষিত বেকার যুবকরা। দেশটিতে বর্তমানে প্রায় তিন লাখ প্রবাসী রয়েছেন।
দেশটিতে আসা একাধিক তরুণ আলাপচারিতায় নিজেদের স্বল্প প্রবাস-জীবনের গল্প তুলে ধরেন। দেশে থাকাকালীন বেনসন সিগারেট হাতে নিয়ে হালকা কালারের চুলগুলো বাতাসে উড়িয়ে পুরো মহল্লা দাঁপিয়ে বেড়ানো স্মার্ট বয় আজ ক্লিনার!
বেলা ১২টার আগে যার ঘুমই ভাঙত না আজ সে ভোর ৫টায় ঘুম থেকে উঠে কোম্পানির পোশাক পরে ঝাড়ু হাতে সিগন্যালে সিগন্যালে রাস্তার ময়লা পরিষ্কার করছে। ৫০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় চুলগুলো কালার ছাড়াই লাল হয়ে গেছে।
গ্রীষ্মের দাবদাহে ত্বক নষ্ট হয়ে যাবে- এই ভয়ে যে ছেলে বিকেল ছাড়া ঘর থেকে বের হতো না, আজ সে কুয়েতের তীব্র গরমের মধ্যে জিরো সাইজের চুল কেটে রাস্তা পরিষ্কার করছে।
মামা (দালাল) বলেছিল, কোম্পানির ভিসা দেব, ফোরম্যানের কাজ। তোর আন্ডারে থাকবে ২০/২৫ জন। তুই তো বাবা শিক্ষিত, ডিগ্রি নেয়া ছেলে। স্যুট-টাই পরে আট ঘণ্টা ডিউটি করবি। ডিউটি শেষে কিছুটা রেস্ট নিয়ে একটা পার্ট টাইমের কাজে লাগিয়ে দেব। ভিসার টাকা, সেটা তো চলে আসবে দুই বছরের মধ্যেই।
দালাল মামা আরও জানায়, আকামা ফ্রি, থাকার জন্য দেব ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাট তো নয় রাজপ্রাসাদ, রাজার হালে থাকবি। দুই বছর গেলে, কোম্পানি ভালো না লাগলে কোনো এক প্রাইভেট কোম্পানিতে ট্রান্সফার করে দেব? না হলে ছোটখাটো ব্যবসা করবি, বাকালা (মুদি দোকান) খুলে নিবি…, তোর আন্ডারে লোক খাটবে কত!
হাজার স্বপ্নের বাস্তবায়নে ঋণের বোঝা বাবার মাথায় দিয়ে, সদ্যবিবাহিত বোনের গয়না বন্ধক রেখে এদিক-সেদিক থেকে সুদে টাকা এনে দালাল মামার হাতে তুলে দেয়া হয় মোটা অঙ্কের টাকা। টাকা পেয়ে আজ তো কাল ভিসা, আরেকটু অপেক্ষা কর… এই তো হয়ে যাচ্ছে, ভিসা পাওয়ার পর আমাকে তো আর পাত্তাই দিবি না; এভাবে চলতে থাকে দালালের সময়ক্ষেপণ।
অন্যদিকে দিন দিন বাড়ছে সুদের টাকার পরিমাণ, ছোট বোনকে শুনতে হচ্ছে শ্বশুর বাড়ির নানা গঞ্জনা, ‘তোমার ভাই সেই কবে নিয়েছে গয়না, খেয়ে ফেলেছে নাকি? বিদেশ যেতে কী এত সময় লাগে’; নানা কথা…।
বছর খানেক পর মেলে কাঙ্ক্ষিত ভিসা, আহা! কী কালার ভিসার কাগজে, আরবিতে লেখা কোম্পানির নাম, কতই না সুন্দর! মেডিকেল করে বন্ধুবান্ধব নিয়ে শেষবারের মতো পার্টির আয়োজন শেষে স্বপ্নের দেশ কুয়েতে পাড়ি দেয়া।
এয়ারপোর্টে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা, মামার (দালালের) প্রতিনিধির কোনো খোঁজ যে নেই! কল দিলেই বলে, আর একটু অপেক্ষা কর, তোমায় নিতে লোক যাচ্ছে, চিন্তা করো না বাবা…।
অবশেষে দেখা মেলে কোম্পানির প্রতিনিধির। সুসজ্জিত ও শীততাপ নিয়ন্ত্রিত এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়েই মিলবে প্রবাস জীবনের প্রথম ধাক্কা। শুনেছিলাম কুয়েতে অনেক গরম, কিন্তু এত দেখি সরাসরি দোজখ! থাকব কী করে এখানে?
কোম্পানির ফোরম্যান গাড়ি থেকে সোজা নিয়ে গেল ব্র্যাকে। সেখানে ঢুকতেই দ্বিতীয় ধাক্কা। কোথায় রাজপ্রাসাদ? ছোট এক রুমে তার মতো ১৫-২০ জন দলাদলি করে বসে আছে। সবার সিট আলাদা আলাদা। একজনের ওপরে আরেকজন ঘুমায়। আমি তো ভাই দেশে একা ঘর ছাড়া ঘুমাতাম না? কী করে ঘুমাব এখানে? মাথায় ঘুরপাক খায় নতুন চিন্তা, থাকার যদি এ অবস্থা হয় তাহলে খাবার-দাবারের কী ব্যবস্থা?
করিম ভাই, অনেক পুরনো লোক। দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে কাজ করেন এখানে। কোনো প্রমোশন নাই, কোম্পানির দালাল ধরে কাজ পাইছেন সিগন্যালে। আছেন ভালোই, কিন্তু নতুন লোক আসায় কোম্পানি থেকে আগের মতো সুবিধা আদায় করে নিতে পারেন না। তবে নতুনদের উপর বেশ মাতব্বরির সুযোগ পান, তিনি তো এখানকার মুরুব্বি!
দীর্ঘ তিন মাস পার হয়েছে ওই তরুণের। আকামা লাগছে না, ডিউটি হচ্ছে না, খাবারের টাকা নাই, দালাল মামা ফোন উঠাচ্ছে না, কী যে বিপদ? সবাই বলে, এটা নাকি আকদ হুকুমার ভিসা! এ ভিসায় নাকি ক্লিনার কোম্পানি ছাড়া আর কোথাও কাজ করা যায় না। তাহলে মামা যে বলেছিল! দুই বছর পর ভালো কোম্পানিতে ট্রান্সফার… সব মিলিয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ে দেশের স্মার্ট বয়টি।
আজ সে পরিস্থিতির শিকার, হাতে ঝাড়ু আর ময়লা উঠানোর বেলচা নিয়ে সিগন্যালে সিগন্যালে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেশে চলে গেলে বাবার ঋণের টাকা কীভাবে শোধ করবে? ‘শুনেছি গয়নার জন্য প্রায় বাড়িতে এসে কান্নাকাটি করে প্রিয় বোনটি, এদিকে আবার বছর শেষের পথে, আবার আকামা লাগাতে লাখ টাকা লাগবে, না হলে ভালো কোম্পানিতে যাওয়া হবে না।’ এসব চিন্তায় ভারি হয়ে ওঠে মাথা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৬ সালের পর যারা ফ্রি ভিসায় কুয়েতে প্রবেশ করেছেন তারা আকামা ও কাজের সংকটে পড়বেন। কারণ বাংলাদেশি কিছু দালাল ফ্রি ভিসাগুলো সাত থেকে আট লাখ টাকায় বিক্রি করছেন। স্থানীয় কুয়েতিরা সেটা জেনে গেছেন। এ কারণে তারাও অধিক লাভের চিন্তা করছেন। আগে যেখানে ফ্রি ভিসায় দুই বছরের আকামা লাগাতে সাড়ে তিনশ দিনার থেকে সর্বোচ্চ পাঁচশ দিনার নেয়া হতো, এখন কুয়েতিরা সেটা ছয়শ থেকে এক হাজার দিনার পর্যন্ত রাখছেন। এত টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে সরাসরি বলে দিচ্ছে, ‘রিলিজ নিয়ে নাও’। অন্যদিকে নতুন নতুন শ্রমিক আসায় কমেছে শ্রমের মজুরি। স্থানীয় আইনে ফ্রি ভিসায় কাজ করা অবৈধ। এ কারণে পুলিশি ঝামেলারও আতঙ্ক থাকে।
তারা বলছেন, গত দুই বছরে কুয়েতে অগণিত শিক্ষিত বা কম শিক্ষিত তরুণ-যুবক এসেছেন, সম্পূর্ণ তথ্য না জেনে। মূলত দালালরা সম্পূর্ণ তথ্য না দিয়ে তাদের ফ্রি ভিসার কথা বলে এ দেশে পাঠাচ্ছেন। দালালরা বাংলাদেশে বলে বেড়াচ্ছেন যে, এখানে ফ্রি ভিসার অনেক সুবিধা। কিন্তু তারা এটা জানে না যে, কুয়েতে ফ্রি ভিসা বলতে কিছু নাই, সব কিছুই মিথ্যা। এ ভিসায় কাজ করা সম্পূর্ণ অবৈধ।
লেখক- সাদেক রিপন, কুয়েত থেকে
সৌজন্যে- জাগো নিউজ