ওমানে জীবিকার তাগিদে বসবাস করেন প্রায় ৮ লাখের মতো প্রবাসী বাংলাদেশি। এর মধ্যে লক্ষাধিক প্রবাসী বিভিন্ন কারণে দেশটিতে অবৈধের তালিকায় পড়েছেন। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির মধ্যে সীমাহীন ভোগান্তিতে রয়েছেন তারা। কাজ নেই, খেতেও পারছেন না। পাশে নেই বাংলাদেশ দূতাবাস। ত্রাণের জন্য সরকার থেকে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হলেও তা পাচ্ছে না বলে অভিযোগ জানিয়েছেন প্রবাসীরা।
দূতাবাসের দেওয়া নম্বরে যোগাযোগ করেও হয়রানির শিকার হচ্ছেন প্রবাসীরা। শতাধিক ওমানপ্রবাসী দূতাবাসের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করেছেন। ইবরি থেকে মুন্না নামে এক প্রবাসী আমাদের বলেন, ‘তিনদিন যাবত অনাহারে আছি, শুনেছি দূতাবাস থেকে অনুদান দেওয়া হচ্ছে, তাই দূতাবাসের ৯২১২৮১৯৮ নম্বরে কল দিয়েছিলাম, টিটু নামে এক লোক কল রিসিভ করে বললেন দূতাবাস থেকে ত্রাণ দেওয়া হয় না’।
মাস্কাটের আল-হিল থেকে ইব্রাহিম নামে আরেক প্রবাসী বলেন, ‘দূতাবাসের দেওয়া ৫টি নম্বরেই কল দিয়েছি, এক নম্বরে কল দিলে বলে আরেক নম্বরে কল দিতে, এভাবে ৪টিতেই কল দিয়েছি। তারা ঠিক মতো কথাই বলে না। টিটু চৌধুরী নামে এক লোক বললেন দূতাবাসে কোনো সরকারি অনুদান আসেনি’।
মাস্কাট থেকে প্রবাসী ওসমান গনী বলেন, দূতাবাসের সবগুলো নম্বরে কল দিয়েছি। কেউ রিসিভ করে না। মাসুদ নামে একজন বলেন, দূতাবাসের ৯৯৪১৩১৩২ নম্বারে কল দিলাম, একজন রিসিভ করে অন্য আরেকজনের ৭৯১৫৮৬৮৮ নম্বর দিলেন, তারপর অন্যজন ফোন রিসিভ করে আমার কথা শুনছিলেন, এমতাবস্থায় হঠাৎ ফোন রেখে দিলেন তিনি, এরপর কয়েকবার কল রিসিভ করে কথাই বলেননি, কল রিসিভ করে চুপ করে থাকেন, পরবর্তীতে আর কলও রিসিভ করেননি’।
এ ব্যাপারে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সেলিম রেজার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘ওমানের অসহায় প্রবাসীদের জন্য সরকারি বাজেট দূতাবাসে পাঠানো হয়েছে। দেশটির বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে এই অনুদান অসহায়দের হাতে পৌঁছে দেওয়া হবে’। দূতাবাসের বিরুদ্ধে প্রবাসীদের অভিযোগের ব্যাপারে তাকে অবহিত করা হলে সকল অভিযোগ তার মেইলে দিতে বলেন।
সরকারি অনুদান দূতাবাসে পৌঁছেছে এটা রাষ্ট্রদূত নিশ্চিত করলেও দূতাবাসের ৯২১২৮১৯৮ থেকে টিটু চৌধুরী নামে দূতাবাসের এক ব্যক্তি সম্পূর্ণ অস্বীকার করছেন। এমতাবস্থায় ওমানের কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব জানান, ‘দূতাবাসের উচিত ছিল এই মুহূর্তে কমিউনিটির সবাইকে নিয়ে কাজ করার, কিন্তু তারা এটা না করে তাদের (দূতাবাসের) নিজস্ব কিছু লোক দিয়ে ত্রাণ বিতরণের কাজ করছেন। যা সুষ্ঠুভাবে বণ্টন না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এখানে কারচুপি হওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। দূতাবাস কাদেরকে অনুদান দিচ্ছে এটা আমি নিজেও জানি না। আমি দীর্ঘ ৪০ বছর যাবত ওমানে, এই দেশের প্রতিটি অঞ্চলে আমার পরিচিত লোক আছে, আমি খোঁজ নিয়ে কারো থেকেই শুনিনি তারা সরকারের অনুদান পেয়েছে’।
রাজধানী মাস্কাটসহ সালালাহ, সোহার, ইবরি, নেজুয়া ও বারকাসহ ওমানের সব অঞ্চলেই বসবাস বাংলাদেশিদের। যারা বৈধভাবে ওমানে আছেন, তারাও যে স্বস্তিতে আছেন, তা নয়। খেতে পারলেও উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অন্যান্য সুবিধা ভোগ করতে পারছেন না তারা। তবে বিপদ বেশি অবৈধদের। ইতোমধ্যেই গত এক সপ্তাহে দেশটিতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৩ জন প্রবাসী বাংলাদেশি।
এখন পর্যন্ত করোনার প্রাদুর্ভাবে ওমানে মারা গেছেন তিনজন। আক্রান্ত ৪৫৭ জন, ওমানে আক্রান্তদের মধ্যে অধিকাংশই প্রবাসী বলে জানিয়েছেন দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী। যে কারণে লকডাউন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দিন পার হচ্ছে। অবৈধ যে বাংলাদেশিরা দেশটিতে বসবাস করেন, মূলত সমস্যা পড়েছেন এ কারণেই। কাজহীন অলস সময় পার করছেন অধিকাংশ প্রবাসী। হাত খালি থাকায় খাবার সংকটসহ নানা বিপদে আছেন তারা।
মুঠোফোনে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে রাষ্ট্রদূত মো. গোলাম সরওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো সাড়া মেলেনি। ওমান প্রবাসীদের এই বিপদের মুহূর্তে দূতাবাসের পক্ষ থেকে কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে এ ব্যাপারে দূতালয় প্রধান মো নাহিদ ইসলামের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি দূতাবাসের পক্ষ থেকে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে এমন কিছু ছবি ও ভিডিও দেন, এছাড়া কোনো কথা বলেননি। ওমানে কতজন প্রবাসীকে দূতাবাসের পক্ষ থেকে অনুদান দেওয়া হয়েছে এবং আগামীতে আরও কতজনকে দেওয়া হবে, এ ব্যাপারে জানতে চাইলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।
ওমানের আব্দুল্লাহ (ছদ্মনাম) নামে একজন প্রবাসী, যিনি দীর্ঘ ৩৫ বছর যাবত ওমানে আছেন এবং ওমানের বাংলাদেশ কমিউনিটির একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি, তিনি বলেন, ‘দূতাবাসের পক্ষ থেকে যা দেওয়া হচ্ছে, তার দাম বাংলাদেশি টাকায় ৬ টাকার বেশি হবে না। এই খাবার দিয়ে একজন প্রবাসী এক সপ্তাহ খেতে পারবে কিনা সন্দেহ।
তিনি বলেন, যে সকল প্রবাসী বিপদে আছেন, তাদের তালিকা করে কিছু অনুদান দিয়েছে ওমানের বাংলাদেশ সোশ্যাল ক্লাব। তবে বিপদে থাকা প্রবাসীদের অভিযোগ অনেকেই ক্লাবের অনুদান পায়নি।
এ ব্যাপারে ক্লাবের প্রেসিডেন্ট সিরাজুল হকের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘প্রয়োজন আরও বেশি, এত কম দিয়ে কি হবে? ওমানে বর্তমান পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ, আট লাখ প্রবাসীর মাঝে হাতেগোনা হয়তো ৫ শতাংশ প্রবাসী সচ্ছল আছেন। বাকি সবাই কোনো না কোনো ভাবে খাদ্য সঙ্কটে আছেন। এমতাবস্থায় ক্লাবের পক্ষ থেকে আমরা প্রথমে ১০০০ প্রবাসীর হাতে এক মাসের খাবার দিয়েছি এবং পরে ব্যক্তিগতভাবে আরও ২০০ প্রবাসীকে অনুদান দিয়েছি, যা অসহায় মানুষের তুলনায় খুবই কম’।
তিনি আরও বলেন, ‘ওমানে এমনিতেই গত ৩ বছর যাবত ব্যবসা মন্দা যাচ্ছে সবার, হাতেগোনা কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী ব্যতীত বেশিরভাগ ব্যবসায়ী গত তিন বছর যাবত হ্যান্ড টু মাউথ এমন অবস্থায়। ওমানে শুধুমাত্র শ্রমিকরাই খাদ্য সঙ্কটে আছে ব্যাপারটা এমন নয়। অনেক ব্যবসায়ী এখন খাদ্য সঙ্কটে’।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষথেকে দূতাবাসের মাধ্যমে অনুদান দেওয়া হচ্ছে, এ ব্যাপারে কতটুকু জানেন এমন প্রশ্ন করলে সিরাজুল হক বলেন, ‘আমাদের ক্লাবের অনুদান দেওয়ার সময় দূতাবাসকে সবকিছু জানালেও দূতাবাস থেকে কিভাবে অনুদান দেওয়া হচ্ছে এ ব্যাপারে আমাদের কিছুই জানানো হয়নি’।