
রাজধানীতে ছিনতাইয়ের এমন অনেক ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে রাতে ও ভোরে চলাচল করতে মানুষ ভয় পাচ্ছেন। ঘটছে চুরি ও ডাকাতির ঘটনা। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার ঢাকার কেরানীগঞ্জে ব্যাংকে ডাকাতির চেষ্টা হয়। পুলিশ ও ঢাকার আদালত–সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার ৫০টি থানা এলাকায় গত ১ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪০ দিনে অন্তত ৩৪ জন ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে মামলা করেছেন। এ সময় একজন ছিনতাইকারীর হাতে নিহত হয়েছেন। গুরুতর জখম হয়েছেন আরও চারজন।
সব মিলিয়ে গত ৫ আগস্ট থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাড়ে চার মাসে ছিনতাইকারীর হাতে নিহত হয়েছেন সাতজন। সর্বশেষ ১৮ ডিসেম্বর মেয়র হানিফ উড়ালসড়কে নিহত হন কামরুল হাসান। এর আগে ১৫ ডিসেম্বর ঢাকার মগবাজারে হাবিব উল্লাহ নামের এক তরুণ ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন।
চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনায় কত মামলা হয়েছে, তা নিজেদের ওয়েবসাইটে তুলে ধরেছে পুলিশ সদর দপ্তর। তাদের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর বিভিন্ন থানায় গত আগস্ট থেকে নভেম্বর সময়ে ছিনতাইয়ের (রবারি বা দস্যুতা) ঘটনায় মামলা হয়েছে ৬৫টি। গত বছর এই চার মাসে মামলা হয়েছিল ৬৭টি। ফলে দেখা যাচ্ছে, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ছিনতাইয়ের মামলা দুটি কম হয়েছে। কিন্তু পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গত বছরের সঙ্গে এ বছরের তুলনা চলে না। এ বছরের আগস্ট মাসে পুলিশি কার্যক্রম একেবারেই ভেঙে পড়েছিল। এখনো পুলিশি কার্যক্রম পুরো স্বাভাবিক হয়নি।
ঢাকায় ডাকাতির ঘটনা সাধারণত কম ঘটে। মামলাও কম হয়। পুলিশের তথ্য বলছে, চলতি বছর আগস্ট থেকে নভেম্বর সময়ে ডাকাতির ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৭টি। গত বছর একই সময়ে মামলা হয়েছিল ৬টি। চুরির ঘটনায় এবার মামলা হয়েছে ৩৪০টি। গত বছর একই সময়ে মামলা হয়েছিল ৫৩৪টি।
পুলিশ কর্মকর্তাদের কেউ কেউ বলছেন, এখন অপরাধের ঘটনা নিয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে। এ কারণে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বেশি তৈরি হচ্ছে।
অনেক ক্ষেত্রে চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় ভুক্তভোগীরা থানায় অভিযোগ নিয়ে যান না। ফলে শুধু মামলার পরিসংখ্যান দিয়ে অপরাধের প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না। যেমন কাস্টমসের একজন কর্মকর্তার বাসার আসবাব নিয়ে আসার পথে তাঁর বন্ধু যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়ায় ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। কাস্টমসের ওই কর্মকর্তা বলেন, মেয়র হানিফ উড়ালসড়কের প্রবেশপথে গত শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে তাঁর বাসার আসবাব নিয়ে আসা ট্রাকটি যানজটে আটকে ছিল। তখন ১২ থেকে ১৫ জনের একটি ছিনতাইকারী দল (আইনত ডাকাতি) তাঁর বন্ধুকে ছুরিকাঘাত করে সঙ্গে থাকা টাকা ও মালামাল নিয়ে যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় ওই ব্যক্তিকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। এ ঘটনায় মামলা করেননি ভুক্তভোগী।
কাস্টমসের ওই কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, যানজটের মধ্যে এ রকম সংঘবদ্ধভাবে ছিনতাই হচ্ছে, এটা খুবই উদ্বেগজনক।
পুলিশও বলছে, ঢাকায় ছিনতাই বেড়েছে। ডিএমপি কমিশনার শেখ সাজ্জাদ আলী গতকাল রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমার কাছে যে রিপোর্ট, তাতে দেখা যায় ছিনতাই অনেক বেড়ে গেছে। অধিকাংশ ছিনতাই হচ্ছে মুঠোফোন।’ তিনি বলেন, বাসে যাত্রী বসে থাকে, মুঠোফোন ছিনিয়ে নিয়ে দৌড় দেয়। ধারালো অস্ত্র দেখিয়ে মুঠোফোন ছিনতাই হচ্ছে। তিনি রাস্তাঘাটে মুঠোফোন ব্যবহারের সময় সতর্ক থাকার আহ্বান জানান এবং পুলিশ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে উদ্যোগী হচ্ছে বলেও জানান।
ছিনতাই মামলা বেশি চার থানায়
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন সরকারের সামনে যেসব বিষয় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আসছে, তার মধ্যে অন্যতম আইনশৃঙ্খলা রক্ষা। অভ্যুত্থানের পর পুলিশ থানা থেকে পালিয়ে যাওয়ায় অপরাধ দমন কার্যক্রমে স্থবিরতা এসেছিল। নতুন সরকার ঢাকায় পুলিশের জনবলে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ও ডিএমপি কমিশনার পদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। কিন্তু এখনো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়নি।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে বেশি আলোচনা হয়েছিল মোহাম্মদপুর নিয়ে। গত ২ নভেম্বর স্থানীয় বাসিন্দারা থানার সামনে বিক্ষোভও করেন। এরপর সেনাবাহিনী, পুলিশ ও র্যাব যৌথ অভিযান শুরু করে। ছিনতাইয়ের মামলার তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ১ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪০ দিনে ঢাকায় সর্বাধিক তিনটি করে ছিনতাই মামলা হয়েছে মোহাম্মদপুর, খিলগাঁও, হাতিরঝিল ও শাহজাহানপুর থানায়। দুটি করে ছিনতাই মামলা হয়েছে হাজারীবাগ, মিরপুর ও শাহআলী থানায়। একটি করে ছিনতাই মামলা হয়েছে ১৬টি থানায়।
সম্প্রতি ঢাকার রাস্তায় দিনদুপুরে ধারালো অস্ত্র (চাপাতি) হাতে ছিনতাইয়ের একটি ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনাটি ঢাকার আসাদগেটের। মোহাম্মদপুর থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) হাফিজুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ভিডিওটি আমাদের নজরে এসেছে। আমরা ছিনতাইকারীদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করছি।’
ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে ছিনতাই
দেশীয় বাজারমুখী একটি পোশাক কারখানার মালিক আলী হোসেন গত ১১ নভেম্বর ভোরে যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়ায় ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। বাধা দিলে তাঁকে ছুরিকাঘাত করে টাকাপয়সা নিয়ে পালিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। রক্তাক্ত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
আলী হোসেনের ছেলে এ ঘটনায় যাত্রাবাড়ী থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা যাত্রাবাড়ী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) কাউছার হুসাইন গণমাধ্যমকে বলেন, ব্যবসায়ী আলী হোসেন হত্যায় জড়িত চার ছিনতাইকারীর কাউকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
আলী হোসেনের বাড়ি মুন্সিগঞ্জে। তাঁর বড় ছেলে ফয়সাল আহমেদ পড়াশোনা করেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে। আরেক ছেলে পড়েন নরসিংদীর একটি কলেজে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে। আলী হোসেনের ছেলে ফয়সাল গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাবার আয়েই আমাদের লেখাপড়ার খরচ চলত। এখন দুই ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ চালানো নিয়েই দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে।’ তিনি বলেন, এত দিন হয়ে গেল, পুলিশ অপরাধীদের কাউকে ধরতে পারেনি।
ঢাকায় ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন বিদেশি নাগরিকও। শাহবাগ থানার একটি মামলার এজাহারের তথ্য অনুযায়ী, ব্যবসায়িক প্রয়োজনে ঢাকায় আসা চীনের নাগরিক লিজিং (৩২) ১১ নভেম্বর দুপুর ১২টার দিকে রাজধানীর সচিবালয়ের উল্টো দিকে ছিনতাইয়ের শিকার হন। ছিনতাইকারীরা তাঁর গলায় থাকা সোনার চেইন নিয়ে যায়। শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ খালিদ মনসুর গণমাধ্যমকে বলেন, তাঁরা সন্দেহভাজন হিসেবে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছেন।
ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বেশির ভাগ ঘটনা ঘটছে রাতে ও ভোরে। ছিনতাইকারীরা ধারালো অস্ত্র বেশি ব্যবহার করছে। তারা দলবদ্ধ হয়ে এসব অপরাধে জড়াচ্ছে। ডিএমপির গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, চুরি, ছিনতাই কিংবা ডাকাতির ঘটনার তথ্য পুলিশ লুকাচ্ছে না; বরং যাঁরাই থানায় অভিযোগ দিচ্ছেন, সেসব ঘটনায় মামলা হচ্ছে। এসব ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে।
যদিও অনেক ঘটনায় অপরাধীরা ধরা পড়ছে না। মতিঝিল থানায় গত ২৪ নভেম্বর হওয়া একটি মামলার এজাহার বলছে, পুলিশ সদর দপ্তরে কর্মরত কনস্টেবল সোহেল রানা ২২ নভেম্বর ভোরে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সামনে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। ছিনতাইকারীরা কনস্টেবল সোহেলের পেটে ছুরি চালিয়ে মুঠোফোন ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মতিঝিল থানার উপপরিদর্শক জাহাঙ্গীর আলম গতকাল গণমাধ্যমকে বলেন, এখনো কোনো ছিনতাইকারী গ্রেপ্তার হয়নি।
সূত্র: প্র.আ