এই বছরের গোল্ডেন গ্লোবস ছিলো চমকের পর চমকে ঠাসা

 

chardike-ad

নাৎসিদের গণহত্যার ভয়াল সময় থেকে বেঁচে ফেরা এক স্থপতির আমেরিকান স্বপ্নের পেছনে ছোটার গল্প ‘দ্য ব্রুটালিস্ট’ ও সংগীতনির্ভর থ্রিলার ‘এমিলিয়া পেরেজ’ হলিউডে নতুন বছরের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার গোল্ডেন গ্লোবস ঘরে তুলেছে।

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের নির্বাচিত সাংবাদিকদের ভোটে ‘দ্য ব্রুটালিস্ট’ সেরা চলচ্চিত্রের (ড্রামা) সম্মান পেয়েছে। ৩ ঘণ্টা ৩৫ মিনিট দৈর্ঘ্যের ছবিটি নির্মাণের জন্য সেরা পরিচালক হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৬ বছর বয়সী ব্র্যাডি কোর্বেট। গত বছর ৮১তম ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা পরিচালকের স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি। তার কথায়, ‘মধ্য-শতাব্দীর একজন নকশাকারকে নিয়ে সাড়ে তিন ঘণ্টার ছবি নিয়ে কারও তেমন আগ্রহ ছিল না। আমাকে শুনতে হয়েছে, এটি কেউ দেখবে না এবং সফল হবে না। কিন্তু আমি অসন্তুষ্ট হইনি। আমি ছবিটিকে নির্মাতাদের উঁচুতে তোলার সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছি। নির্মাতাদের ছাড়া চলচ্চিত্রের অস্তিত্ব নেই। আসুন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সমর্থন করি, তাদের সাহায্য করি।’

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী পটভূমিতে নির্মিত ‘দ্য ব্রুটালিস্ট’ ছবিতে আমেরিকায় জীবন সাজানোর চেষ্টা করা হাঙ্গেরির ইহুদি স্থপতির ভূমিকায় অভিনয়ের সুবাদে সেরা অভিনেতা (ড্রামা) হয়েছেন আমেরিকান তারকা অ্যাড্রিয়েন ব্রডি। ২১ বছর পর দ্বিতীয়বার গোল্ডেন গ্লোবে মনোনয়ন পেয়ে পুরস্কৃত হলেন তিনি। ৫১ বছর বয়সী এই অভিনেতার দৃষ্টিতে, ‘ছবিটি মানবতা ও শিল্পের একটি স্মৃতিস্তম্ভ। যারা আমেরিকার অভিবাসী হতে সংগ্রাম করেছেন, আশা করি ছবিটি তাদের অবস্থান কিছুটা ওপরে তুলতে পারে ও তাদের ভাষা দিতে পারে।’

ইহুদি-আমেরিকান চরিত্র নিয়ে নির্মিত ‘অ্যা রিয়েল পেইন’ ছবির সুবাদে সেরা পার্শ্ব অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছেন কিয়েরান কলকিন। তিনি ছিলেন নিরঙ্কুশ ফেভারিট। এবারের আসরে বিজয়ীদের নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন বাংলাদেশসহ ৮৫টি দেশের ৩৩৪ জন সাংবাদিক। গোল্ডেন গ্লোবসকে ভাবা হয় অস্কারের পূর্বাভাস। গোল্ডেন গ্লোবস জয়ীদেরই অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডস পাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল থাকে।

মেক্সিকান এক মাদকসম্রাটের পুরুষ থেকে নারীতে রূপান্তরিত হওয়ার স্প্যানিশ ভাষার ছবি ‘এমিলিয়া পেরেজ’ সেরা চলচ্চিত্রের (মিউজিক্যাল অথবা কমেডি) সম্মান জিতেছে। তবে এটি কানে স্বর্ণপাম জয়ী ‘আনোরা’ কিংবা বক্স অফিসে তোলপাড় ফেলে দেওয়া ‘উইকেড’ জিতবে বলে আশা করা হচ্ছিল।

সব মিলিয়ে চারটি পুরস্কার বাগিয়ে নিয়েছে ‘এমিলিয়া পেরেজ’। এরমধ্যে রয়েছে সেরা অ-ইংরেজি ভাষার চলচ্চিত্র, সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী (জোয়ি সালদানিয়া) ও সেরা মৌলিক গান (এল মাল)। ছবিটির পরিচালক জ্যাক অঁদিয়ার বলেন, “এই অস্থির সময়ে আশা করি ‘এমিলিয়া পেরেজ’ হবে আলোর বাতিঘর।”

এমিলিয়া পেরেজ চরিত্রে অভিনয় করেছেন কার্লা সোফিয়া গাসকোন। গোল্ডেন গ্লোবসের ইতিহাসে প্রথম ট্রান্সজেন্ডার নারী হিসেবে সেরা অভিনেত্রী (মিউজিক্যাল অথবা কমেডি) বিভাগে মনোনীত হয়ে ইতিহাস গড়েছেন। পুরস্কার বিতরণের মঞ্চে তিনি বলেন, ‘অন্ধকারকে দমিয়ে আলো সবসময়ই জয়ী হয়। আমাদের প্রাণ, অস্তিত্ব কিংবা পরিচয় কেড়ে নিতে পারবে না কেউই।’

সেরা চলচ্চিত্রের (মিউজিক্যাল অথবা কমেডি) স্বীকৃতি হাতছাড়া হলেও ‘উইকেড’ সিনেম্যাটিক অ্যান্ড বক্স অফিস অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কার জিতেছে। ছবিটি পরিচালক চীনা-তাইওয়ানিজ বংশোদ্ভূত আমেরিকান নির্মাতা জন এম. চু বলেন, ‘পৃথিবীব্যাপী এখন ছড়িয়ে আছে হতাশা ও বিদ্বেষ। এর মধ্যেও আমরা শিল্পে ডুবে থাকতে পারি, এটি এক অর্থে আশাবাদ ও আনন্দের।’

সেরা অভিনেত্রী (মিউজিক্যাল অথবা কমেডি) বিভাগে পুরস্কৃত হয়ে নিজেই চমকে গেছেন ডেমি মুর। একেই বলে প্রত্যাবর্তন! তার অভিনীত ‘দ্য সাবস্ট্যান্স’ ছবিতে একজন মধ্যবয়সী ম্রিয়মান অভিনেত্রীর তারুণ্য ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষার ভয়ানক পরিণতি দেখানো হয়েছে। ‘আনোরা’ তারকা মাইকি ম্যাডিসন কিংবা ‘উইকেড’ তারকা সিনথিয়া এরিভো পুরস্কারটির জন্য ফেভারিট ছিলেন। কিন্তু ভোটাররা ভেবে রেখেছিলেন অন্য কিছু!

‘দ্য সাবস্ট্যান্স’ ডেমি মুরের ক্যারিয়ারকে পুনরুজ্জীবিত করেছে নিঃসন্দেহে। পুরস্কার গ্রহণের পর মঞ্চে ৬২ বছর বয়সী এই তারকা বলেন, “এই মুহূর্তে আমি হতভম্ব। আমি সত্যিই এই পুরস্কার আশা করিনি। ৪৫ বছরের বেশি সময় ধরে অভিনয় করছি, এবারই প্রথম অভিনেত্রী হিসেবে কিছু অর্জন করতে পেরেছি। ৩০ বছর আগে একজন প্রযোজক বলেছিলেন, আমি পপকর্ন উপযোগী অভিনেত্রী। তখন যেসব কাজ করেছি সেগুলো কেবল ব্যবসাসফল আর কাড়ি কাড়ি টাকা আনতে পেরেছে। কিন্তু পুরস্কারের মতো কোনও স্বীকৃতি পায়নি। কয়েক বছর আগে ভেবেছিলাম হয়তো আমার আর দেওয়ার কিছু নেই। ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেছে ভেবে নতজানু থাকার সময় ‘দ্য সাবস্ট্যান্স’-এর পাণ্ডুলিপি এলো আমার কাছে। এরপর পৃথিবী জানিয়ে দিলো আমি ফুরিয়ে যাইনি।”

এবারের আসরের অন্যতম বড় চমক সেরা অভিনেত্রী (ড্রামা) বিভাগে ব্রাজিলের ফার্নান্দো তোরেসের জয়। পর্তুগিজ ভাষায় নির্মিত ‘আই অ্যাম স্টিল হিয়ার’ চলচ্চিত্রে ব্রাজিলিয়ান এক কংগ্রেসম্যানের স্ত্রীর ভূমিকায় দারুণ অভিনয়ের স্বীকৃতি পেলেন তিনি। ১৯৭১ সালে ব্রাজিলে সামরিক স্বৈরশাসনের সময় তার স্বামীকে গুম করা হয়। তখন পরিবারটি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পেছনের কারণ উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেন এই নারী।

এবারই প্রথম ব্রাজিলের কেউ গোল্ডেন গ্লোব জিতলেন। হলিউডের হেভিওয়েট দুই তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি অথবা নিকোল কিডম্যানের হাতেই পুরস্কারটি উঠবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। কিন্তু ফার্নান্দো তোরেস হেসেছেন শেষ হাসি। ১৯৯৯ সালে তার মা ফার্নান্দো মন্টেনেগ্রো একই বিভাগে প্রথম ব্রাজিলিয়ান হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছিলেন।

গোল্ডেন গ্লোবসের অন্যতম চমক ছিল ‘অ্যা ডিফারেন্ট ম্যান’ ছবির জন্য সেরা অভিনেতা (মিউজিক্যাল অথবা কমেডি) বিভাগে সেবাস্টিয়ান স্ট্যানের পুরস্কার প্রাপ্তি। এর গল্প বিকৃত মুখের এক ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে। সে তার চেহারার ব্যাপক পরিবর্তন করে। এটাই তার প্রথম গোল্ডেন গ্লোব জয়। রোমানিয়ান-আমেরিকান এই তারকা মারভেল স্টুডিওসের সুপারহিরো উইন্টার সোলজার হিসেবে বেশি জনপ্রিয়।

সেরা অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র বিভাগেও চমক দেখা গেছে। পুরস্কারটি জিতেছে লাটভিয়ার ‘ফ্লো’। এর গল্পে দেখা যায়, বন্যার দুর্যোগে বেঁচে থাকার জন্য প্রাণীদের একজোট হয়ে কাজ করা। যদিও এই বিভাগে বক্স অফিস কাঁপানো ‘দ্য ওয়াইল্ড রোবট’ কিংবা ‘ইনসাইড আউট টু’র জয়ের সম্ভাবনা ছিল বেশি।

ছয়টি বিভাগে মনোনীত ‘কনক্লেভ’ কেবল সেরা চিত্রনাট্যের পুরস্কার পেয়েছে। এটি লিখেছেন পিটার স্ট্রাউহ্যান।

ছোট পর্দায় জাপানের জয়জয়কার

সপ্তদশ শতকের জাপানে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের গল্প নিয়ে নির্মিত এফএক্স-এর ‘শোগুন’ সেরা টিভি সিরিজ (ড্রামা)-সহ সামনের সারির চারটি পুরস্কার জিতেছে। এতে অভিনয়ের জন্য হিরোয়ুকি সানাদা সেরা অভিনেতা (ড্রামা সিরিজ), অ্যানা সোয়াই সেরা অভিনেত্রী (ড্রামা সিরিজ) ও তাদানোবু আসানো সেরা পার্শ্ব অভিনেতার স্বীকৃতি পেয়েছেন। তারা সবাই প্রথমবার গোল্ডেন গ্লোব জিতলেন। তাদের মধ্যে তাদানোবু আসানোর জয়কে চমক বলা চলে। কারণ সেরা পার্শ্ব অভিনেতা বিভাগে ফেভারিট ছিলেন এবন মস-বাকরাক (দ্য বেয়ার), ডিয়েগো লুনা (লা মাকিনা)।

ছোট পর্দার বিজয়ী তালিকায় আরেক চমক সেরা অভিনেতা (লিমিটেড সিরিজ, অ্যান্থলজি সিরিজ অথবা টিভি মুভি) বিভাগে কলিন ফারেলের পুরস্কার প্রাপ্তি। এইচবিও’র ‘দ্য পেঙ্গুইন’ সিরিজে ব্যাটম্যানের থলথলে ভিলেন অসওয়াল্ড কব চরিত্রে অনবদ্য নৈপুণ্যের সুবাদে এই স্বীকৃতি পেলেন তিনি। গোল্ডেন গ্লোবসে এটি আইরিশ এই তারকার তৃতীয় পুরস্কার। পুরস্কার গ্রহণের পর মঞ্চে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন তিন ঘণ্টা লাগতো প্রস্থেটিক মেকআপে। সেজন্য সকালে ব্ল্যাক কফিতে চুমুক দিয়ে আশির দশকের গান শুনে নিজেকে প্রস্তুত করতাম।’

নেটফ্লিক্সের ‘বেবি রেইন্ডিয়ার’-এর জন্য রিচার্ড গাড সেরা অভিনেতা (লিমিটেড সিরিজ, অ্যান্থলজি সিরিজ অথবা টিভি মুভি) পুরস্কার জিতবেন বলে বাজি ধরা হয়েছে বেশি। তবে সেরা লিমিটেড সিরিজ অথবা টিভি মুভি পুরস্কারটি জিতেছে ‘বেবি রেইন্ডিয়ার’। এতে অভিনয়ের সুবাদে সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী হয়েছেন জেসিকা গানিং। প্রত্যাশা মতোই সেরা অভিনেত্রী (লিমিটেড সিরিজ, অ্যান্থলজি সিরিজ অথবা টিভি মুভি) হয়েছেন জোডি ফস্টার (ট্রু ডিটেক্টিভ: নাইট কান্ট্রি)।

সেরা টিভি সিরিজ (মিউজিক্যাল অথবা কমেডি) স্বীকৃতি পেয়েছে হ্যাকস (এইচবিও/ম্যাক্স)। সিরিজটির সুবাদে জিন স্মার্ট সেরা অভিনেত্রী (মিউজিক্যাল অথবা কমেডি) পুরস্কার পেয়েছেন। প্রত্যাশা অনুযায়ী সেরা অভিনেতা (মিউজিক্যাল অথবা কমেডি) হয়েছেন জেরেমি অ্যালেন হোয়াইট (দ্য বেয়ার)।

এবারের আসরের সঞ্চালক নিকি গ্লেজার সেরা স্ট্যান্ড-আপ কমেডি পারফরম্যান্স বিভাগে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। কিন্তু তাকে হতাশ করে পুরস্কারটি জিতেছেন ভিয়েতনামের বংশোদ্ভূত আমেরিকান তারকা অ্যালি ওয়াং (অ্যালি ওয়াং: সিঙ্গেল লেডি, নেটফ্লিক্স)।