‘পুশ ইন’ ঘিরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তজুড়ে চলছে অস্থিরতা। দেশের কয়েকটি জেলার সীমান্ত এলাকার মতো কুড়িগ্রামের চারটি উপজেলার সীমান্তেও এ অস্থিরতা চলছে। বাংলাদেশিসহ রোহিঙ্গা নাগরিক, এমনকি ভারতীয় নাগরিকদের বিধিবহির্ভূতভাবে সীমান্তপথে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো অব্যাহত রেখেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)।
এতেই থামছে না প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সীমান্তরক্ষীরা। তারা আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করে সীমান্তে গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। এমনকি ড্রোন উড়িয়ে বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করার মতো অপরাধ করছে। বিজিবিসহ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিএসএফের এসব কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
বিএসএফের এসব অপতৎপরতার বিপক্ষে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) কৌশলগত সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। তারা ‘পুশ ইন’ ঠেকানোর চেষ্টাসহ উত্তেজনা প্রশমনে ধৈর্য্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সহায়তায় দিনরাত অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করছে বিজিবি।
কুড়িগ্রাম সদর, ফুলবাড়ী, নাগেশ্বরী, ভূরুঙ্গামারী, উলিপুর, রৌমারী ও রাজিবপুর উপজেলার সঙ্গে ভারতের সীমান্ত রয়েছে। এর মধ্যে ফুলবাড়ী সীমান্ত লালমনিরহাট বিজিবি ১৫ ব্যাটালিয়ন এবং রৌমারী ও রাজিবপুর উপজেলা সীমান্ত জামালপুর বিজিবি ৩৫ ব্যাটালিয়নের আওতাভুক্ত। অবশিষ্ট সীমান্ত কুড়িগ্রাম বিজিবি ২২ ব্যাটালিয়নের আওতাধীন।
কী ঘটছে সীমান্তে
সবশেষ রৌমারী উপজেলার ঐতিহাসিক বড়াইবাড়ী সীমান্তে ফের বাংলাদেশের আকাশসীমায় ভারতীয় ড্রোন উড়তে দেখা গেছে। গত শুক্রবার রাত ৮টার দিকে ওই সীমান্তে বাংলাদেশের ৫০০ মিটার অভ্যন্তরে চারটি ড্রোন উড়তে দেখা যায়।
গত ৬ মে থেকে কুড়িগ্রাম সীমান্ত পথে রোহিঙ্গাসহ ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের ঠেলে দেওয়া শুরু করে বিএসএফ। ওই দিন রৌমারী সীমান্ত দিয়ে নারী-শিশুসহ ২১ জন রোহিঙ্গা ও নয় বাংলাদেশিকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠায় বিএসএফ। বিজিবি এর প্রতিবাদ জনালেও তাতে কর্ণপাত করেনি বিএসএফ।
এর একদিন পর ভূরুঙ্গামারী উপজেলার চরভূরুঙ্গামারী ইউনিয়নের ভাওয়ালকুড়ি সীমান্ত দিয়ে পাঁচ রোহিঙ্গা নাগরিককে বাংলাদেশে ঠেলে দেয় ভারত। তারা একই পরিবারের সদস্য এবং ভারতে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) নিবন্ধিত। ভারতের আসামের মাটিয়া রিফিউজি ক্যাম্পে বসবাস করছিলেন। তাদের কাছ থেকে দিল্লির ইউএনএইচসিআর থেকে ইস্যু করা পাঁচটি রেজিস্ট্রেশন কার্ড উদ্ধার করে বিজিবি।
গত ২৩ মে রাতের আঁধারে ফুলবাড়ী সীমান্ত দিয়ে নারী-শিশুসহ ২৪ বাংলাদেশিকে সীমান্তপথে ঠেলে দেওয়ার জন্য জড়ো করে বিএসএফ। বিজিবি আপত্তি জানালে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে পরিচয় নিশ্চিত হয়ে ২৪ বাংলাদেশিকে আনুষ্ঠানিক গ্রহণ করে বিজিবি। এই সীমান্তে বিধি চর্চা হলেও একই রাতে ভূরুঙ্গামারী সীমান্ত দিয়ে বিজিবির নজর এড়িয়ে আরও ১৪ বাংলাদেশিকে ঠেলে দেয় বিএসএফ। পরে তাদের আটক করে বিজিবি।
সীমান্তে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে গত ২৭ মে। এদিন রৌমারী উপজেলার ঐতিহাসিক বড়াইবাড়ী সীমান্তে ১৪ নারী-পুরুষকে বাংলাদেশে অভ্যন্তরে ঠেলে দেয় বিএসএফ। ওসব ব্যক্তি নিজেদের ভারতের নাগরিক দাবি করেন। এর মধ্যে ভারতের আসামের মরিগাঁও জেলার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকও রয়েছেন।
এ ঘটনায় বড়াইবাড়ী বিজিবি ও স্থানীয় বাসিন্দারা প্রতিবাদ জানিয়ে ঠেলে দেওয়া নাগরিকদের ভারতে ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় বাংলাদেশি নাগরিক ও বিজিবি সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে বিএসএফ। সাউন্ড গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায়। অতিরিক্ত সৈন্য জড়ো করাসহ সীমান্তে যুদ্ধ প্রস্তুতি নেয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ড্রোন উড়িয়ে নজরদারি করে। দেখা দেয় উত্তেজনা। দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা শূন্যরেখায় অবস্থানের পরও ঠেলে দেওয়া নিজ দেশের নাগরিকদের ফেরত নেয়নি বিএসএফ। পরে তাদের হেফাজতে নেয় বিজিবি।
বিএসফের এমন তৎপরতা যা বলছেন বিজিবি ও অধিকারকর্মীরা
মাসজুড়ে সীমান্ত পরিস্থিতির বিষয়ে বিজিবি বলছে, সীমান্তে কোনও আইনের তোয়াক্কা করছে না বিএসএফ। প্রতিনিয়ত আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে চলছে। প্রতিটি ঘটনায় বিজিবির পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানানো হলেও কোনও ভ্রুক্ষেপ করছে না তারা।
কুড়িগ্রাম সীমান্তের দায়িত্বে থাকা বিজিবির দায়িত্বশীলরা বলছেন, বিজিবির সঙ্গে কোনও ধরনের যোগাযোগ ছাড়াই লোকজনদের সীমান্ত পথে বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে বিএসএফ। তারা সীমান্তে যেসব অস্ত্র এবং প্রযুক্তি সরঞ্জাম ব্যবহার করছে, তা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। ভারতে যদি অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি থাকে, তাহলে তাদের ফেরত নিতে বাংলাদেশের আপত্তি নেই। বাংলাদেশের নাগরিকদের পরিচয় নিশ্চিত হয়ে সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করে হস্তান্তর করা যেতে পারে। কিন্তু এভাবে কোনও ধরনের যোগাযোগ ছাড়াই কাউকে সীমন্তপথে ঠেলে দেওয়া আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। একই মতো মানবাধিকারকর্মীদেরও।
মানবাধিকারকর্মী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটে। কোনও রাষ্ট্র অনুপ্রবেশকারীদের রাখতে না চাইলে তাদের নিজ দেশে ফেরত দিতে পারে। আমাদের কোনও নাগরিক তাদের দেশে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে থেকে থাকলে ফেরতের জন্য দুই রাষ্ট্রের মধ্যে যোগাযোগ হতে পারে। যাচাই করে নাগরিকদের পরিচয় নিশ্চিত হয়ে ফেরত দেওয়ার বিধান রয়েছে। দুই দেশের সম্পর্ক অটুট রেখে নিয়ম-কানুন মেনে আমরা আমাদের নাগরিকদের ফেরত নিতে পারি।’
কবির আরও বলেন, ‘আমরা তো আমাদের নাগরিকদের ফেরত নিতে অস্বীকৃতি জানাইনি। কিন্তু ভারত সীমান্তপথে রাতের আঁধারে বাংলাদেশের নাগরিক পরিচয়ে যেভাবে ঠেলে দিচ্ছে, তা আইনসম্মত তো নয়ই বরং ওই নাগরিকদের জন্য অমর্যাদাকর। আর তারা রোহিঙ্গাদের কেন বাংলাদেশে ঠেলে দেবে। প্রয়োজনে তারা জাতিসংঘের সহায়তা নিতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে ঠেলে দিতে পারে না।’
দ্বিপাক্ষিক চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন
সীমান্তে নাগরিকদের জোর করে ঠেলে দেওয়া ও অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন উল্লেখ করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘১৯৫১ সালের রিফিউজি কনভেনশন ও ১৯৬৭ প্রটোকল অনুযায়ী, কোনও ব্যক্তিকে এমন দেশে ফেরত পাঠানো যাবে না যেখানে তার জীবন বা স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়বে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ অনুসারে, যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়া কাউকে বহিষ্কার বা শারীরিক ক্ষতির সম্মুখীন করা যাবে না। বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের দ্বারা নাগরিকদের জোরপূর্বক ঠেলে দেওয়া আন্তর্জাতিক ও মানবাধিকার আইনের পরিপন্থি।’
মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘সীমান্তে অস্ত্র বা প্রযুক্তি ব্যবহারে জাতিসংঘের নির্দেশনা অনুযায়ী শুধু অতীব প্রয়োজনেই জীবনরক্ষার্থে বলপ্রয়োগ অনুমোদিত, যা ২০১১ সালের বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চুক্তির “সংযম ও মানবিক আচরণ” নীতির সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। ফলে এ ধরনের পুশব্যাক ও বলপ্রয়োগ আন্তর্জাতিক আইন, মানবাধিকার ও দ্বিপাক্ষিক চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।’
‘বাংলাদেশ চাইলে এ বিষয়ে জাতিসংঘে অভিযোগ জানাতে পারে, যা আন্তর্জাতিক সহানুভূতি ও কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে সহায়ক হবে। তবে এমন পদক্ষেপ গ্রহণের আগে কৌশলগতভাবে চিন্তা করে, প্রমাণ সংগ্রহ ও দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করে সামনে এগোনো বাঞ্ছনীয়’ বলেও উল্লেখ করেন আইনজীবী ইশরাত হাসান।
খবর: বাং.ট্রি.