Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

লঞ্চডুবি : দক্ষিণ কোরিয়া বনাম বাংলাদেশ

লঞ্চডুবি আমাদের দেশের জন্য নতুন কিছু নয়। ঈদের সময় এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এ দেশে প্রতিবছরই লঞ্চ ডুবে মানুষের সলিল সমাধি হওয়া একটি দুঃখজনক নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বশেষ গত সোমবার দুই শতাধিক যাত্রী নিয়ে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ঘাটের অদূরে লৌহজংয়ে ডুবে যায় পিনাক-৬ নামের একটি লঞ্চ। রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এ ঘটনায় ৪১ মৃতদেহ উদ্ধারের খবর পাওয়া গেছে। তখনও নিখোঁজ ছিল ১২৬ জন।

স্বজনদের আহাজারিতে মাওয়ার আশপাশের বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। কিছুদিন পরই আবার সবকিছু শান্ত হয়ে যাবে। স্বজনরা এ দুর্ঘটনা নিজেদের অদৃষ্টি বলে মেনে নেবে। লঞ্চমালিক, চালক এবং নৌ-পরিবহন বিভাগের কারো গায়ে আঁচড়টিও লাগবে না।

chardike-ad

5555-300x125কিছুদিন আগে এশিয়ারই আরেকটি দেশ দক্ষিণ কোরিয়ায় একটি ফেরিডুবির ঘটনা ঘটে। চার শতাধিক যাত্রী নিয়ে ‘সিউল’ নামের ফেরিটি ডুবে যায়। এতে ২২৫ জনের প্রাণহানি ঘটে। নিখোঁজ হয় ৭৭ জন। লঞ্চটির যাত্রীদের উদ্ধারে ৫০টিরও বেশি জাহাজ ও হেলিকপ্টার উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়। আপ্রাণ চেষ্টা চালানো হয় দুর্ঘটনা কবলিত ফেরির যাত্রীদের উদ্ধারে।

এরপরও নিজের ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারেননি দেশটির প্রধানমন্ত্রী চাং হু-অন। তিনি ব্যর্থতার দায় নিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়ে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এ ঘটনার দায় নিয়ে পদত্যাগ করছি।’

শুধুই তা-ই নয়, ফেরি পরিচালনায় জড়িত সবাইকে আটক করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ এনে ফৌজদারি মামলাও করা হয়। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ওই ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও একবার ট্রেন দুর্ঘটনার পর তৎকালীন রেলমন্ত্রীর পদত্যাগ বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে।

কিন্তু আমাদের দেশ একটি অদ্ভূত প্রকৃতির দেশ। এখানে লঞ্চডুবিসহ নান ধরনের দুর্ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। শত শত মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এর আগে ১৫ মে ঝড়ের কবলে পড়ে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার মেঘনাবক্ষে দুই শতাধিক যাত্রী নিয়ে এমভি মিরাজ-৪ নামে একটি লঞ্চ ডুবে যায়। এতে ৫৫টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। অবশ্য সে সময় লঞ্চটি উদ্ধার করা হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত লঞ্চের অনেক যাত্রী-ই নিখোঁজ ছিল বলে অভিযোগ করেছিলেন স্বজনরা।

সে সময় উদ্ধার কাজ শেষ না হতেই কয়েক দফা উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। কিন্তু পরে লাশ পেয়ে আবারো শুরু করা হয় উদ্ধার অভিযান। লঞ্চটি উদ্ধার করতে গিয়ে উদ্ধারকারী জাহাজের রশি ছিড়ে যায়। এভাবেই চলতে থাকে এ দেশের উদ্ধার অভিযানগুলো।

এবারও পিনাক- ডুবে যাওয়ার ষষ্ঠ দিনে দুপুর ১২টায় রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সেটি উদ্ধার তো দূরের কথা। লঞ্চটির অবস্থানই শনাক্ত করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। নানা ধরনের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। ঘটনার পরপরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বাত্মক উদ্ধার তৎপরতা চালানোর নির্দেশ দেন। নৌমন্ত্রীও ছুটে যান ঘটনাস্থলে। কিন্তু এখনো খুঁেজ পাওয়া যাচ্ছে না লঞ্চটির। যতই সময় যাচ্ছে ততই নিখোঁজ যাত্রীদের স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠছে পদ্মাপারের বাতাস। অথচ দেশের কর্তৃপক্ষের যেন কোনো দায়বদ্ধতা নেই।

দক্ষিণ কোরিয়ার একই ধরনের ফেরি দুর্ঘনার দায় নিয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ এবং প্রেসিডেন্ট ক্ষমা চাইলেও আমাদের দেশে এ ধরনের ঘটনার কথা ভাবাও যায় না।

কেউ দুর্ঘটনার দায় দায়িত্ব নেওয়ার মধ্যে নেই। যিনি যে পদে আছেন তা রক্ষার্থেই মরিয়া তারা। গণতান্ত্রিক সমাজে যারা সরকারি বা রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হন, তারা যে জনগণের সমর্থনে এসেছেন, তা তারা ভুলে যান। ঝড়ে ডুবে, আগুনে পুড়ে বা অন্যান্য মানুষ-সৃষ্ট দুর্যোগের কারণে জনগণের ক্ষয়ক্ষতিতে তাদের কিছু যায়-আসে বলে মনে হয় না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দায়সারা ধরনের একটি তদন্ত কমিটি করেই খালাস। অথচ এর আগে লঞ্চডুবির ঘটনায় ৫০০টি তদন্ত কমিটি হলেও ফলপ্রসূ হয়েছিল মাত্র চারটি। জাতি হিসেবে যা খুবই দুঃখজনকই বটে।

নৌ-পরিবহনের ব্যাপারে এদেশে কিছু আইন আছে। আইন প্রণয়নের ব্যাপারে আমরা সেরা। এক দৌড়ে আমরা আন্তর্জাতিক সনদে গিয়ে স্বাক্ষর করে আসি। কিন্তু দেশে তার বাস্তবায়নের তাগিদ খুব একটা থাকে বলে মনে হয় না।

দুর্ঘটনার শিকার পিনাক-৬ লঞ্চটি ১৯৯১ সালে তৈরি শান্ত পানিতে চলাচলের জন্য সনদ দিয়েছিল সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর। যাত্রী ওঠার কথা ছিল সর্বোচ্চ ৮৫ জন। কিন্তু লঞ্চে উঠেছিল তার তিন থেকে চার গুণ যাত্রী। নৌযানের ফিটনেসে দেয়ার সংস্থা বাংলাদেশ বাংলাদেশ সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলছেন, পুরোনো নকশায় তৈরি, অতিরিক্ত যাত্রী বহন ও আবহাওয়ার পূর্বাভাস না মেনে চলার কারণেই লঞ্চটি ডুবে গেছে। অথচ নৌপথে এসব লক্কড়ঝক্কড় যান চলাচল বন্ধের ব্যাপারে কঠিন অবস্থানে যাওয়ার কোনো উদ্যোগ নেই এ দেশের কর্তৃপক্ষের।

শুধুই লঞ্চডুবিই নয়, সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের সাতটি লাশের দায়ভার নিয়ে কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি দায়িত্ববান আচরণ দেখাতে পারলেন না। এতো হাতে গোনা কয়েকটি লাশ! রানা প্লাজার হাজার লাশেও তাদের কিছু আসে যায় না। কোথায় কি হল তাতে কি আসে যায়, আমার চাই ক্ষমতা। কাজেই অন্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধান পদত্যাগ করলে আমরা কেবল বিস্ময়ই প্রকাশ করতে পারি আর কিছু না।

আমাদের দেশে এরকম ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা মন্ত্রী কিংবা প্রতিমন্ত্রীও পদত্যাগের নাম কোনদিন মুখে নেবেন না। তাদের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তারা হাসিমুখে বলবেন, ‘পদত্যাগের প্রশ্নই আসে না।’

আর ক্ষমা চাওয়া? সে তো ভিন্ন গ্রহের কোনো শব্দ। এক্ষেত্রে বড় পর্যায়ের লোকেরা তো দূরের কথা স্থানীয় এমপি, চেয়ারম্যান এমনকি ইউপি সদস্যের কাছেও ‘ক্ষমা চাওয়া’ শব্দটি বড়ই কঠিন। কোনো কারো মুখ থেকে এ শব্দটি আশাও করতে পারেন না হতভাগা বাংলাদেশিরা।

সম্প্রতি সেন্টমার্টিনেও মারা যায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪টি তরতাজা প্রাণ। লঞ্চ ডুবি, ট্রলার ডুবিতে নিহতের সংখ্যা অনেক হলেও উৎসবে পার্বণে এর মাত্রা বেড়ে যায় বহুগুণে। টনক নড়ে না কেবল কর্তৃপক্ষের। দুঃখও প্রকাশ করে না কেউ। উন্নত দেশগুলোতে দায়িত্ব পালনে বিন্দুমাত্র গাফলতি হলেই ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা সাধারণত পদত্যাগ করে থাকেন। কখনো স্বেচ্ছায়, কখনো বা চাপের মুখে।

কথায় কথায় আমরা বিদেশের উদাহরণ দেই। দেশি-বিদেশি জিনিস পরি, খাই-যাইও বিদেশে ঘন ঘন। অথচ তাদের ভাল রীতিটা গ্রহণ না করে আমরা কেবল খারাপটাই করি। পদত্যাগ ওদেরই মানায়। কারণ, ওরা যে বিদেশি আর আমরা পদত্যাগ করি না পদত্যাগের ধারও ধারি না। আমরা গদি আঁকড়ে বেঁচে থাকাকেই সেরা বাঁচা বলে বিবেচনা করি। জনগণের জন্য ক্ষমতায় এলেও জনগণের সুখের জন্য আমাদের জনপ্রতিনিধিরা ত্যাগে রাজি নন।

সবশেষে বলতে চাই, অনেক হয়েছে। সময় বদলে গেছে। বাংলাদেশও আগের মতো অবস্থানে নেই। এদেশের মানুষেরও বিবেক কিছুটা হলেও খুলেছে। একই ধরনের ঘটনায় দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী যদি পদত্যাগ করতে পারেন। দেশটির প্রেসিডেন্ট যদি জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারেন।

তাহলে প্রতিবছর লঞ্চ, সড়ক দুর্ঘটনা, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসের কারণে ডজন ডজন প্রাণহানি। বিভিন্ন দুর্ঘটনায় হাজার হাজার মানুষের পঙ্গুত্ব বরণ। এর দায় কেউ নেওয়ার মতো কেউ নেই এদেশে। কখনোই কি এ সবের দায় জাতির কাছে ক্ষমা চাবে এ দেশের দায়িত্বশীলরা। কখনোই কি এ দেশের জনগণের সৌভাগ্যও হবে না এসবের দায় নিয়ে দায়িত্বশীল কারো পদত্যাগের খবর পড়ার!