Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

ন্যান্সির আত্মহত্যা চেষ্টাঃ নেপথ্যে নীরব রাজনৈতিক হয়রানি?

বাংলাদেশের সংগীত অঙ্গনে বেশ ক’বছর ধরেই ন্যান্সি একটি জনপ্রিয় কণ্ঠ। পুরো নাম নাজমুন মুনিরা ন্যান্সি। হাবীবের সঙ্গিতায়োজনে ‘আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা’ ছবিতে ‘পৃথিবীর যত সুখ’ গানটি দিয়ে প্রথমবারের মতো আলোচনায় আসেন ২০০৬ সালে। তবে তারও আগে ‘হৃদয়ের ডোর’ নামে তাঁর একটি একক গান ব্যাপক শ্রোতাপ্রিয় হয়। এরপর গত সাত-আট বছরে সলো, মিক্সড, প্লে ব্যাক যেখানেই কণ্ঠ দিয়েছেন সেখানেই সুরের মূর্ছনায় মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন। ২০১১ সালে পেয়েছেন ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’। নিয়মিত কনসার্ট, টিভি শোতে ব্যস্ত সময় পার করছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে কিছু টানাপড়েন বাদ দিলে সবমিলিয়ে ভালোই চলছিল জীবন।

nancy_with_daughter
একমাত্র কন্যা নায়লার সাথে কণ্ঠশিল্পী ন্যান্সি

২০১৩ সালের শেষ দিক। দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের দ্বন্দ্ব নিয়ম করে সংঘাতের রূপ নিচ্ছে। রাজনীতির গরম ময়দানে ততদিনে গুরুত্বপূর্ণ ‘মঞ্চ’ হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক। সমসাময়িক ইস্যুতে তারকারা এখন নিজের মতামতটা ফেসবুকেই বেশী ‘শেয়ার’ করেন। করেছিলেন ন্যান্সিও। আর সেটাই কাল হল এই শিল্পীর জন্য।

chardike-ad

বহুল আলোচিত, সমালোচিত সেই ফেসবুক স্ট্যাটাসে ন্যান্সি বিএনপি নেত্রীর প্রতি তাঁর সমর্থন ব্যক্ত করে কড়া ভাষায় সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। ন্যান্সি লিখেন, “ক্ষমতার অপব্যবহারকারী শেখ হাসিনার জন্য নয়, দীর্ঘদিন ধরে শুধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারণে যাঁরা আওয়ামী লীগকে সাপোর্ট করেছেন, তাঁদের সকল অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করেছেন; এখনি সময় প্রতিবাদ করার। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের মানুষ স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের মিথ্যাচারের কবল থেকে মুক্তি চায়।”

এই স্ট্যাটাসের পর ন্যান্সিকে ডেকে নিয়ে ধন্যবাদ দিয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। সে সাধুবাদকে প্রেরণা হিসেবে নিয়ে হয়তো আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে যোগ দেয়ার পরিকল্পনাও করছিলেন মনে মনে। কিন্তু দেশের তৎপরবর্তী পরিস্থিতি আর ক্ষমতাসীনদের নীরব আক্রোশে পুড়ে সে চিন্তায় গুড়ে বালি দিতে হয়েছে খুব দ্রুতই।

ন্যান্সির ঘনিষ্ঠদের দাবী, এই একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস তাঁর এতদিনের কষ্টার্জিত ক্যারিয়ার হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। স্ট্যাটাস দেয়ার কিছুদিন পর দৈনিক প্রথম আলোকে ন্যান্সি বলেছিলেন, “অসংখ্য ফোন পাচ্ছি সেদিন রাত থেকে। সবাই আমার শুভাকাঙ্ক্ষী। সবার একটাই কথা—এটা আমি কী লিখালম! কেন লিখলাম। এ ধরনের মন্তব্যের কারণে আমার সংগীতের ক্যারিয়ারও শেষে হয়ে যেতে পারে। আমি যেন স্ট্যাটাসটা ডিলিট করি, সে পারমর্শও অনেকে দিয়েছেন। এ ছাড়া আমি যেন ফেসবুক বার্তাটির জন্য দুঃখ প্রকাশ করি।”

তবে ন্যান্সির বিশ্বাস ছিল রাজনৈতিক মতপ্রকাশের কারণে তাঁর সংগীত ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যাবে না। ন্যান্সির ভাষায়, “রাজনৈতিক মতামত প্রকাশের কারণে শ্রোতারা যদি আমার গান না শোনেন, আমাকে গান গাইতে না ডাকেন, যদি জাতীয় পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হই, ব্ল্যাক লিস্টেড হই, তাতে আমার কোনো দুঃখবোধ থাকবে না। আমি মনে করব শিল্পী হিসেবে আমি ব্যর্থ। কেননা সবাই আমাকে আমার কণ্ঠের জন্যই চেনেন। আমি যদি গান করার ক্ষমতা রাখি আর আমার গান যদি শ্রোতাদের ভালো লাগে, আমি অবশ্যই গান করে যাব। আমার রাজনৈতিক মত প্রকাশের কারণে আমার সংগীত ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যাবে, তা আমি কখনো বিশ্বাস করি না।”

কিন্তু বিশ্বাসটা ভাঙতে ন্যান্সির খুব বেশী দিন লাগে নি। এই দেশে উঠতি তারকাদের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করাটা যে কতোটা ক্ষতিকর সেটা ওই স্ট্যাটাসের পর থেকে প্রতিনিয়ত একটু একটু করে ভুক্তভোগী হয়ে প্রমাণ করছেন এই কণ্ঠশিল্পী। জুনে দৈনিক মানবজমিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ন্যান্সি নিজেই বলেছেন গত অক্টোবর থেকে তার স্টেজ শোকেন্দ্রিক বিরামহীন ব্যস্ততায় নেমে এসেছে অবাক করা নীরবতা। প্রতিনিয়ত স্টেজ শো’র অফার পাচ্ছিলেন। কিন্তু প্রায় সবগুলোই বাতিল হয়ে যাচ্ছিলো অজানা কারণে। ন্যান্সি বলছিলেন, “গেল অক্টোবর থেকে শতাধিক স্টেজ শো চূড়ান্ত করেছি। কিছু শো’র জন্য এডভান্স নিয়েছি। মিউজিশিয়ানদের নিয়ে আমরা প্র্যাকটিস করেছি। অতঃপর শো’র আগের রাতে আয়োজকরা জানাচ্ছেন, আপু সরি। কালকের শোটা বাতিল করা হয়েছে। সাত-আট মাস ধরে আমি শুধু শো ধরছি আর বাতিলের খবর শুনছি।”

তিনি বলেন, “একজন শিল্পীর জন্য এটা যে কি পরিমাণ সম্মানহানিকর সেটা বলে বোঝাতে পারবো না। তাছাড়া আমি তো ভাই গানটাকে পেশা হিসেবেই নিয়েছি। গ্রামের সব ফেলে ঢাকায় এসেছি এই গানের জন্যই তো। এখন গানই যদি না গাইতে পারি, তাহলে আমি খাবো কি? ঢাকাতেইবা থাকবো কেন? আমি জানি না, এটা শুধু আমার ক্ষেত্রেই ঘটছে? নাকি সবার বেলাতেই এমনটা হচ্ছে।”

ন্যান্সি আরও বলেন, “তবে এভাবে শতাধিক শো বাতিল হলেও দুয়েকজন আয়োজক অব দ্য রেকর্ডে আমাকে বলেছেন যে কথা, সেটা শুনে খুব ভেঙে পড়েছি। নিরুপায় হয়ে বহু কেঁদেছি। কাঁদছি এখনও। মনে হচ্ছে আমি এমন এক দেশের মানুষ, যে দেশে মনের কথা মুখে বলাটাও পাপ। আর সেই পাপের প্রায়শ্চিত্তটাই এখন আমি করছি।”

10552457_10203041344688498_4501619482458611794_n
পুলিশি ‘হয়রানি’র প্রতিবাদে গত বছরের ৩১ অক্টোবর জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন ন্যান্সি

এর আগে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার কিছুদিন পর পুলিশি হয়রানিরও শিকার হতে হয় ন্যান্সিকে। ‘হাস্যকর’ অজুহাতে বাড়িতে পুলিশি অভিযানের পর বিএনপি সমর্থক মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের নিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি সংবাদ সম্মেলনও করেছিলেন তিনি।

যে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে এতোকিছু সেখানেও হয়রানি তাঁর পিছু ছাড়ছে না। ন্যান্সির দাবী প্রায় প্রতি মাসেই এক-দু’বার করে তাঁর ফেসবুক আইডি হ্যাক করা হচ্ছে কিংবা রিপোর্ট করে বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। ক’দিন পরপর ফেসবুক আইডি আর ফ্যান পেইজ খুলতে খুলতে একপ্রকার ‘ক্লান্ত’ হয়ে পড়ছিলেন তিনি। মানবজমিনকে দেয়া বক্তব্যে ন্যান্সি তাঁর ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে আকুতি জানিয়ে বলেছিলেন, “আমার তো মনে হচ্ছে দু’দিন পরে দেশ থেকেই আমাকে পালিয়ে যেতে হবে। কারা যেন আমার প্রতিটি রাস্তা ক্রমশ আটকে দিচ্ছে। আমি চোখেমুখে অন্ধকার দেখছি। আমার সাজানো জীবনটাকে নিয়ে যারাই এমনটা করছেন তাদের কাছে হাতজোড় করে বলছি, প্লিজ আমাকে এবার ক্ষমা করুন। এতটা নির্দয় হবেন না। আমাকে আমার মতো বাঁচতে দিন।”

ঘনিষ্ঠজনদের ধারণা, ক্যারিয়ারের এই করুণ দশার সাথে কিছু পারিবারিক নানা টানাপোড়েন মিলিয়েই সম্ভবত আত্মঘাতী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি।

উল্লেখ্য, শনিবাস সন্ধ্যায় নেত্রকোনায় নিজের ক্রয় করা বাড়িতে একত্রে ষাটটি ঘুমের বড়ি খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন ন্যান্সি। পরে প্রতিবেশীরা তাঁকে উদ্ধার করে প্রথমে নেত্রকোনা হাসপাতালে ও পরে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নিয়ে যান। রবিবার সকালে অবস্থার অবনতি হলে ন্যান্সিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তিনি সেখানেই চিকিৎসাধীন ছিলেন।