
একদিনে ২৪ ঘণ্টা ! বদলায়নি কোনোদিনই। কিন্তু মানুষ যতো ব্যস্ত হয়েছে, সময়কে নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজন ততোটাই বেড়েছে। প্রাচীন দার্শনিক থেকে শুরু করে মডার্ন ডে সিইও পর্যন্ত, সবাই একটা কথাই মানে:
Time is Money. Time is the actual Currency.
সময়ই হলো জীবনের মুদ্রা, আর যিনি সময়কে সঠিক উপায়ে খরচ করতে জানেন, তিনিই সফল। টাকা-পয়সা খরচে পারদর্শিতার চাইতেও সময়ের যথোপযুক্ত ব্যবহারের পারদর্শিতা বেশি মূল্যবান ও কার্যকরী।
গ্রিক দার্শনিক সেনেকা বলেছিলেন—“আমাদের জীবনের সময় ছোট নয়, আমরা বরং সময় নষ্ট করি।”

আমরা আসলে দিনের বেশিরভাগ সময় কোথায় ব্যয় করি?
মধ্যযুগে সময় ব্যবস্থাপনা মানে ছিল ধর্মীয় আচার বা কৃষিকাজের সঙ্গে মিলিয়ে দিন গোনা। শিল্পবিপ্লবের পর সময় হলো যন্ত্রের মতো- ঘড়ির কাঁটা অনুযায়ী শ্রম, কাজ আর বিশ্রাম।
আসলে প্রতিটি যুগেই সময় ব্যবস্থাপনা সমাজের সার্বিক অগ্রগতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিল।
প্রাচীন সভ্যতায় কৃষিকাজ নির্ভর সমাজে সময় মানে ছিল ঋতু আর ফসলের ক্যালেন্ডার। মধ্যযুগে সময় মানে ছিল মঠের ঘণ্টাধ্বনি, নামাজ বা গির্জার প্রার্থনার সময়সূচি। শিল্পবিপ্লবের পর থেকে সময়কে মানুষ “শ্রমশক্তি” হিসেবে দেখতে শুরু করলো, আর তখন থেকেই ‘টাইম ইজ মানি’ বাক্যটি বাস্তবে রূপ নেয়।
আজকের জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে সময় হলো মস্তিষ্কের শক্তি ও মনোযোগের মুদ্রা। প্রতিটি সমাজ তার অগ্রগতির ধাপে ধাপে সময় ব্যবহারের নতুন সংজ্ঞা দাঁড় করিয়েছে, আর এখানেই টাইম ম্যানেজমেন্ট প্রতিটি যুগে অপরিহার্য থেকে গেছে।
একটা সময়ে কখন শিকার বের হবে, কখন শিকার ধরা হবে আর রাতে কখন ভোজন মেলা বসবে, তাই ছিল টাইম ম্যানেজমেন্ট। সঠিক সময়ে শিকার ধরতে না পারার অর্থই আপনি টাইম ম্যানেজমেন্টে ফেল করলেন আর পুরো দিন না খেয়ে কাটাতে হচ্ছে।
আর বর্তমান এই সময়ে, ডিজিটাল যুগে সময়ের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা যেন আরও চ্যালেঞ্জিং। নোটিফিকেশন, মিটিং, ইমেইল- সব মিলে এক অবিরাম গোলক-ধাঁধা। জেন-জি ভাষায় বলতে গেলে, “দেলুলু” পরিস্থিতি এক।

Harvard Business Review-এর এক জরিপে দেখা গেছে, একজন অফিস কর্মী দিনে গড়ে ২৩% সময় নষ্ট করেন কেবল “context switching”-এর কারণে, মানে এক কাজ থেকে আরেক কাজ করতে গিয়ে মনোযোগ হারানোয়। মাল্টি- টাস্কিং এর বদৌলতে তারা হারায় সময়।
ডেভিড অ্যালেনের বিখ্যাত বই Getting Things Done এ টাইম ম্যানেজমেন্ট এর কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন- টাইম ম্যানেজমেন্ট মানে শুধু একের পর এক কাজ শেষ করা নয়, বরং মাথাকে রিল্যাক্স রাখা, শান্তিতে রাখা- তথা ঝুঁটঝামেলা মুক্ত রাখা। পাঁচ ধাপের একটা মডেল তিনি তাঁর বইতে উপস্থাপন করেছিলেন মাথাকে রাজ্যের সব কাজের ঝুঁটঝামেলা মুক্ত রাখার উদ্দেশ্যে।

-যা কিছু মনে আসে, সব লিখে ফেলুন।
– কোন কাজটি আসলেই গুরুত্বপূর্ণ, সেটা ঠিক করুন।
-কাজগুলো ভাগ করুন (আজ, আগামীকাল, পরের সপ্তাহ)।
-সময় সময় আপনার তালিকা রিভিউ করুন।
-একসাথে একটাই কাজ করুন, পুরোদমে। সম্পূর্ণ মনোযোগ নিবেশ করে।
দেখে আসি, গতো শতাব্দী আর এই শতাব্দীতে টাইম ম্যানেজমেন্ট নিয়ে ঠিক কীরূপ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে একেকটি প্রজন্ম। আমরা , আমাদের এই প্রজন্মও তো টাইম ম্যানেজমেন্ট নিয়ে নানামুখী চ্যালেঞ্জকে অতিক্রম করে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত।
•Baby Boomers (1946–64): এই প্রজন্মের শক্তিই ছিল “শৃঙ্খলা আর স্থায়িত্ব”। তবে তখনও তো আর ডিজিটাল কিছু স্পর্শ করেনি তাদেরকে।
•Generation X (1965–80): এই প্রজন্মের চাওয়া-পাওয়াই ছিল শুধু একটা। “ওয়ার্ক–লাইফ ব্যালেন্স”। কাজও করতে চাই, শান্তিতেও থাকতে চাই। কার্যকরী ডেলিগেশন নির্ধারণে দক্ষতা জরুরি। বিশেষ করে, কোন কাজ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কোনটা করতে হবে, কোনটা না করলেও চলবে। এর থিওরেটিক্যাল আলাপের শুরু হয়তো এখানেই।
•Millennials (1981–96): একসাথে অনেক কাজের ঝোঁক থাকলেও, ফোকাস ধরে রাখাই ছিল তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
•Gen Z (1997– ): ডিজিটাল নেটিভ হলেও, ক্রমাগত নোটিফিকেশন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভ্রান্তি সামলানোই মূল পরীক্ষা এই জেনারেশনের জন্য। তবে ফোকাসের কথা বলতে গেলে, নিউইয়র্ক টাইমস এর গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই প্রজন্মের মস্তিষ্ক স্ক্রলিং করতে করতে অস্থির। তারা কোনোকিছুতে দীর্ঘ সময় আবিষ্ট থাকতে চায়না। কোথাও এমনকি স্থির হয়ে বসতে চায়না। এবং সবথেকে ভয়ের ব্যাপার, এরা আরাম ও করতে চায়না।
প্রতিটি প্রজন্ম ভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেও, টাইম ম্যানেজমেন্টের মূল সূত্র একটাই: যা গুরুত্বপূর্ণ নয়, তা বাদ দিতে শিখুন।
যদি বলা হয়, টাইম ম্যানেজমেন্টে খুব সমস্যা হচ্ছে, কিছু টিপস দরকার।
• দিনের সবচেয়ে জরুরি ৩টি কাজ ঠিক করুন।
• একই সময়ে একটাই কাজ করুন।
• কাজের মাঝে ছোট ছোট বিরতি নিন—এতে প্রোডাক্টিভিটি বাড়ে।
• সময়মতো “না” বলতে শিখুন।

কেন এই দক্ষতা কালজয়ী
সভ্যতা পাল্টেছে, প্রযুক্তি বদলেছে, কিন্তু সময়ের ২৪ ঘণ্টা কখনো বাড়েনি। আড্ডা, কাজ, পরিবার, স্বপ্ন- সব কিছুর মাঝেই যারা সময়কে গুছিয়ে নিয়ে কাজ করতে পেরেছে, তারাই এগিয়ে গেছে।
টাইম ম্যানেজমেন্ট মানে শুধু ঘড়ির কাঁটার হিসাব নয়; জীবনের দিকনির্দেশনা ঠিক করা। পুরো লাইফের কাঁটাই ঘুরে যেতে পারে সময়ের সঠিক ব্যবহারে।
আগামী ১০০ বছরেও এই দক্ষতার কদর অটুট থাকবে। কারন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অটোমেশন, মেটাভার্স কিংবা স্পেস কলোনাইজেশন- যাই আসুক না কেন, মানুষের হাতে প্রতিদিন থাকবে মাত্র ২৪ ঘণ্টা। প্রযুক্তি উন্নয়নের গতি বাড়বে, কাজের ধরন পাল্টাবে, কিন্তু সময়ের সঠিক ব্যবহার ছাড়া কেউ সফল হতে পারবে না। বরং, ভবিষ্যতের মানুষদের জন্য টাইম ম্যানেজমেন্ট হবে বেঁচে থাকার মৌলিক দক্ষতার মতো—যেমন একটা সময়ে পড়তে-লিখতে জানাটা অপরিহার্য ছিল, এখন প্রযুক্তির ব্যবহার সঠিকভাবে না জানলে মানুষ পিছিয়ে যাবে, আর তখন সময় ব্যবস্থাপনাই হতে পারে প্রজন্মের ত্রূপের তাস।
সুতরাং, নিশ্চিত হোক সময়ের যথোপযুক্ত ব্যবহার।

আপনার টাইম ম্যানেজমেন্টের স্টাইল কোনটা?
• Planner
• Procrastinator
• Multitasker
• Focused Worker
পিটার ড্রাকার এর কথাটা মনে রাখবেন- Time is Currency.
Quick Stats (Harvard Business Review)
• গড়ে কর্মীরা দিনে ২৩% সময় নষ্ট করেন Multi-Tasking এর দরুণ।
• মিটিং-এর প্রায় ৬০% সময় অপ্রয়োজনীয় মনে হয় কর্মীদের কাছে।





































