বুধবার । ডিসেম্বর ১৭, ২০২৫
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ফিচার ১০ অক্টোবর ২০২৫, ১:৫২ অপরাহ্ন
শেয়ার

চট্টগ্রামের বেলা বিস্কুটের দুই শতাব্দীর স্বাদ


Bela Biscuits

বেলা বিস্কুট গরম চা
মজা গরি ডুবাই খা
ঘরত গরবা আইস্যি
বেলা দেহি হাইস্যি।

কবি ও সাংবাদিক ওমর কায়সার তার এক ছড়ায় এভাবেই প্রশংসা করেছেন চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বেলা বিস্কুটের। চট্টগ্রামের গণি বেকারির এই ঐতিহ্যবাহী পণ্যটির রয়েছে দীর্ঘ দেড়শ বছরেরও বেশি সময়ের ইতিহাস।

প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক অধ্যাপক আবুল ফজল রচিত আত্মজীবনী রেখাচিত্র (১৯৬৬) গ্রন্থে দেখা মেলে বেলা বিস্কুট নিয়ে স্মৃতিচারণার। তিনি লিখেছিলেন- ‘ঘুম থেকে উঠে পান্তাভাতের বদলে খাচ্ছি গরম-গরম চা বেলা কি কুকিজ নামক বিস্কুট দিয়ে। কুকিজ ইংরেজি নাম, বেলা কিন্তু খাস চাটগেঁয়ে।’

তিনি সেই গ্রন্থে আরো লেখেন, ‘চন্দনপুরার বেলায়েত আলী বিস্কুটওয়ালার নাম অনুসারে বেলা বিস্কুটের নামকরণ হয়েছে।’

চট্টগ্রামের মানুষের সাথে বেলা বিস্কুটের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। কিন্তু এই বেলা বিস্কুট তৈরির যাত্রা শুরু হয় গণি বেকারি প্রতিষ্ঠা হবার আরও আগে। প্রায় ২০০ বছর আগে তৈরি হওয়া এই বিস্কুটকে বলা হয়ে থাকে উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন বিস্কুট। বছরের পর বছর চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের মধ্যে প্রসার লাভ করা এই বিস্কুট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে দেশের অন্যান্য স্থানেও। গবেষকদের তথ্যানুসারে, আবদুল গণি সওদাগরের পূর্বপুরুষ লাল খাঁ সুবেদার ও তাঁর ছেলে কানু খাঁ মিস্ত্রির হাত ধরে বেকারি পণ্য তৈরির সূচনা হয় চট্টগ্রামে। সে সময়ে এই এলাকায় প্রবেশ ঘটে পর্তুগিজদের। তাদের খাদ্যাভ্যাসে ছিল রুটি, পাউরুটি, বিস্কুটসহ নানা বেকারি পণ্য। প্রচলিত রয়েছে পর্তুগিজদের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই আবদুল গণি সওদাগর প্রথম বেলা বিস্কুটের প্রচলন ঘটিয়েছিলেন। তাদের এমন খাদ্যাভ্যাসের কারণে চট্টগ্রাম অঞ্চলে পুরোদমে শুরু হয় বেকারি শিল্পের যাত্রা।

চট্টগ্রামের চন্দনপুরা এলাকায় এই বেকারির অবস্থান। বেকারির নাম অনুসারে এই এলাকায় একটি গলিও আছে। নাম ‘গণি বেকারি গলি’। চট্টগ্রামে বসবাসরত প্রায় সব মানুষেরই এই বেকারি নিয়ে আছে ভালো জানাশোনা।

Bela Biscits Inner 2

বর্তমানে গণি বেকারি ।। ছবি: সংগৃহীত

এই বেকারির পণ্যের ইতিহাস শুরু হয়েছিলো গণির পূর্বপুরুষ লাল খাঁ সুবেদার এবং তার ছেলে কানু খাঁ মিস্ত্রির হাত ধরে। ঠিক কখন গণি বেকারিতে বেলা বিস্কুট তৈরি হতে শুরু করে, তার সঠিক তথ্য নেই। তবে মোগল আমলের শেষদিকে ও ইংরেজ আমলের শুরুতে ভারতের বর্ধমান থেকে আগত লাল খাঁ ও কানু খাঁ এই বেকারিশিল্পের সূচনা করেন চট্টগ্রামে।

কিন্তু তখনো গণি বেকারির এত নামডাক ছিলো না। ১৮৯০ সালের দিকে এই যাত্রায় নাম লেখান আবদুল গণি সওদাগর। নিষ্ঠার সাথে দীর্ঘদিন পরিচালনা করেছেন এই বেকারির কার্যক্রম। ১৯৭০ সালে তিনি মারা যান। তার মৃত্যুর পর বেকারির দায়িত্ব নেন আবদুল গণির ভাইয়ের ছেলে দানু মিয়া সওদাগর। তার মৃত্যুর পরে জামাল উদ্দিন এবং পরবর্তীতে তার পুত্র আবদুল্লাহ মোহাম্মদ এহতেশামের উপর অর্পিত হয় এই গুরুভার। বর্তমানে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ এহতেশামই বেকারির ব্যবসাটি দেখাশোনা করছেন।

মানুষের শৈশব-কৈশোরের অনেক গল্প এবং স্মৃতির সাথে সম্পৃক্ত এই বেকারি ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। যুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ সৈন্যদের জন্য খাবার হিসেবে রুটি নিয়ে আসা হতো এই ‘গণি বেকারি’ থেকেই। প্রতিদিন বিশাল সংখ্যক সৈন্যের জন্য রুটি তৈরি করতে হতো গণিকে। এত মানুষের জন্য যেসব কাঁচামাল দরকার হতো সেটি তখন ব্রিটিশরাই সরবরাহ করতো তাকে। সে সময় থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত গণি বেকারি ক্রেতাদের কাছে এক আস্থার নাম।

অতি প্রাচীন এই বেকারির নেই দ্বিতীয় কোনো শাখা। কেবল চট্টগ্রামের চন্দনপুরা এলাকায় কলেজ গলিতে ১৫৫ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত একমাত্র শাখার দেখা মেলে।

Bela Biscits Inner 1

গণি বেকারির বেলা বিস্কুট

ঐতিহ্যবাহী এই বেকারি এখনো প্রাচীন পদ্ধতিতেই ভর করে টিকে আছে। ১৫০ বছর আগে যে চুলা ব্যবহার করে বিস্কুট তৈরি করা হতো এখনো সেই চুলাতেই তৈরি হয় বেকারির পণ্য।

আধুনিক প্রযুক্তির এই যুগে একাধিক মেশিনের চল এলেও প্রকৃত স্বাদ ও পণ্যের যথাযথ মান বজায় রাখতে এখনো বেকারির বিস্কুট তৈরি করা হয় ‘তন্দুরে’। মাটির তৈরি চুলাকে বলা হয় ‘তন্দুর’। বিস্কুট তৈরির পুরো পদ্ধতিজুড়ে যত পন্থা অবলম্বন করা হয় তার সবকিছুতেই আছে সেই প্রাচীন সময়কার ছাপ। ১৫ জন কর্মী অতি দক্ষতার সাথে করে যাচ্ছেন এই কাজ।

তবে এইজন্য বেশ দুর্ভোগও পোহাতে হয় বেকারিকে। ১৮৭০ সালে বিস্কুট তৈরি করতে মাটির যে তন্দুরি চুলা ব্যবহার করা হতো সেটি বেশ পুরাতন হওয়ায় বারবার মাটির প্রলেপ লাগিয়ে ঠিক করতে হয় যা বেশ কষ্টসাধ্য একটা কাজ। মেশিন ব্যবহার করলে হয়তো তাদের এত কষ্ট হতো না। তবে মেশিনে পণ্যের স্বাদে ভিন্নতা তৈরি হয় বলেই এখনো মাটির তন্দুরেই ভরসা করেন তারা।

Bela Biscuits Inner 3

১৯৯০ এর দশকে গণি বেকারি ।। ছবি: সংগৃহীত

শুধু তাই নয়, বিস্কুট তৈরিতেও তাদের আছে নিজস্ব পদ্ধতি৷ যার ফলে অন্যান্য সব বেকারির চেয়ে এই বেকারির পণ্য একেবারেই আলাদা। সাধারণত বিস্কুট তৈরিতে ইস্ট ব্যবহৃত হলেও এখানে সেটা করা হয় না। ইস্টের পরিবর্তে ‘মাওয়া’ নামের একটি মিশ্রণ ব্যবহার করা হয় যা তাদের গোপন তরিকা হিসেবেও সমাদৃত। এই কারণে বিস্কুটের স্বাদেও তৈরি হয় ভিন্নতা।

শীতল হাওয়ার ভোরবেলাতে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে বেলা বিস্কুট ডুবিয়ে খাওয়া যেন এখানকার সব মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করে অন্যরকম প্রশান্তি। বর্তমানে বেলার সাথে যুক্ত হয়েছে মাখন বেলাও।

এই বেকারির অন্দরে বিস্কুট কেনার উদ্দেশ্যে আগমন ঘটে বিভিন্ন বয়েসি ক্রেতার। তাদের ৩০ ধরণের পণ্যের মধ্যে ক্রেতাদের পছন্দের শীর্ষে আছে বেলা বিস্কুট। প্রায় ৩ ধরণের বেলা পাওয়া যায় এখানে। বেলা, মাখন বেলা এবং রোজ বেলা। এদের মধ্যে মাখন বেলার দাম সরচেয়ে বেশি। ৩০ পিস মাখন বেলার দাম রাখা হয় ১৫০ টাকা, সাধারণ বেলা এবং রোজ বেলার দাম ১১০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। দিনে ২০০-২৫০ প্যাকেট বিস্কুট বিক্রি হয় তাদের।

ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী বেলা বিস্কুটের যোগান দিতে পারেন না তারা অনেক সময়। কারণ বেকারির কেবল একটা শাখা। এছাড়া বেলা বিস্কুট পুরোপুরি তৈরি করতে সময় লাগে ২ দিন। সময়সাপেক্ষ হওয়ার কারণেও যোগান বেশি দেওয়া সম্ভব হয় না।

Bela Biscuits Inner 4

গণি বেকারির ঐতিহ্যবাহী বাকরখানি ।। ছবি: সংগৃহীত

এই বেকারির আরও একটি উল্লেখযোগ্য পণ্য হলো বাকরখানি। সাধারণ বাকরখানির মত নয় এটি। স্বাদে অনন্য এই বাকরখানি খাওয়া হয় মাংসের ঝোল বা মাংস দিয়ে। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলোর মধ্যে এটিও একটি। কোরবানির ঈদে গরু বা খাসির মাংসের লাল ভুনা কিংবা কালা ভুনার সাথে বাকরখানি দিয়ে মেহমান আপ্যায়ন করা হয় প্রায় প্রতিটি ঘরে। এমনকি ঈদের আগে এই বাকরখানির জন্য পূর্বেই অর্ডার দিয়ে রাখতে হয়। দুই ধরণের বাকরখানি আছে এই বেকারিতে। একটি শুকনো বাকরখানি, অন্যটি চিনির শিরাযুক্ত রসালো বাকরখানি। মাংসের সাথে এই বাকরখানির সংমিশ্রণ স্বাদে নিয়ে আসে অন্যরকম বৈচিত্র্য।

বৈচিত্র্যময় এই বাকরখানির দেখা মেলে কেবল চট্টগ্রামে। বাকরখানির কথা আসলেই সবার চোখের সামনে ভেসে উঠে পুরান ঢাকার মুচমুচে নোনতা বাকরখানির কথা। কিন্তু গণির বাকরখানি খেতে এমন শুকনো বা নোনতা স্বাদের হয় না। অত্যন্ত রসালো এবং সুমিষ্ট চট্টগ্রাম অঞ্চলের এই বাকরখানি ছেলেবুড়ো সবারই অন্যতম পছন্দের খাবার।

শতাব্দী প্রাচীন এই বেকারির সঙ্গে ক্রেতাদের রয়েছে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। অতীতে যেসব ক্রেতাদের মন জয় করে নিয়েছিলো এই বেকারির পণ্য, সেসব ক্রেতারা এখনো এসে ভিড় করেন এখানে৷ ক্রেতাদের এই তালিকায় যুক্ত হয়েছেন বংশপরম্পরায় পরবর্তী প্রজন্মের ক্রেতারাও।

মাত্র ১৫ জন কর্মী নিয়ে চলা গণি বেকারীর আর কোনো শাখা খোলেননি এহতেশাম। কারণ, বেকারীর আদি ও আসল স্বাদ, মান এবং ঐতিহ্য ধরে রাখা। আর গণি বেকারি সেটি করতে পেরেছে খুব সফলভাবেই।