সময়ের সমষ্টিই জীবন। তাই প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান। কিছু কিছু কর্মের কারণে কিছু কিছু সময় বিশেষ মর্যাদা লাভ করে। আরবী মাসের ‘জিলহজ্ব মাস’ তেমনি কিছু কর্ম সম্পাদনের মাস। যা সর্বশেষ রাসূল মুহাম্মাদ সাঃ বিদায়ী হজ্বে শিখিয়ে দিয়ে গেছেন। এসব আমলের মাধ্যমে ইসলামী বিশ্বাসসমূহকে চরিত্রে ও কর্মে প্রতিফলনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
মুসলিমগণ আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ ও রাসূলের অনুকরণ ও অনুসরণ করার মানসে যে কালেমা শপথ বাক্য পাঠ করে মৌখিক সাক্ষ্য দিয়েছে, জিলহাজ্বের আমলগুলো সম্পাদনের মাধ্যমে এর বাস্তব সাক্ষ্য পেশ করে। হযরত ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত রাসূল সাঃ বলেছেন, ভাল আমলের দিক থেকে মর্যাদায় জিলহাজ্ব মাসের প্রথম ১০ তারিখের চেয়ে উত্তম আর কোন কিছু নেই। সাহাবীরা রাসুল (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ, আল্লাহর পথে জিহাদও কি তার সমকক্ষ নয়? জবাবে বললেন, জিহাদও এর সমকক্ষ নয়। এ কথাটি তিনবার বললেন। এরপর বললেন, অবশ্য যে নিজের ধন সম্পদ ও জান দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদে গেল অতঃপর শহীদ হল, সে তার সমকক্ষ হবে (বুখারী)।
মাসের দিক থেকে রামজান মাস আর দিন সমূহের দিক থেকে জিলহাজ্ব মাসের প্রথম ১০ দিন খুবই মর্যাদাপূর্ণ। প্রবাসের বাস্তবতায় পাচঁটি আমল নিয়ে আলোচনা করব।
আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা দেওয়া
ইতিহাসের শত শত নবী রাসূলদের শ্রেষ্ঠতম কাজগুলোর অনুকরণে পৃথিবীতে প্রতিনিধিত্বশীল মানবজাতির এক বিশাল অংশ একসাথে আল্লাহর বড়ত্বের ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে। সেই আল্লাহর বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা দিয়ে আমাদেরকেও আত্বসমর্পণকারীদের সাথে সামিল হতে হবে। জিলহাজ্ব মাসের এই সময়ে আল্লাহর বড়ত্ব প্রকাশের অনেক দোয়া ও জিকির পাঠ করার তাগাদা রয়েছে। (বুখারী ও মুসলিম ) এই দোয়াটি পঠিতব্য ”আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ওয়াল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ” এই দোয়াটি জিলহাজ্ব মাসের ৯ তারিখ ফজর থেকে ১৩ তারিখ আসর (অক্টোবরের ৩ তারিখ থেকে ৭ তারিখ ) সালাতের পর উচ্চস্বরে পড়া দরকার। আরবীতে একে বলা হয়েছে ‘ আইয়ামে তাশরীক’। এছাড়াও যত দোয়া ও জিকির জানা আছে তা অর্থসহ জেনে পাঠ করা উচিত বেশী করে।
সাধ্যমত রোজা রাখা
এ মাসে ঈদের দিনগুলি ব্যতীত অন্যান্য দিন গুলিতে সাধ্যমত রোজা রাখার তাগাদা রয়েছে ( আবু দাউদ, নাসায়ী)। হজ্বরত নয় এমন ব্যক্তির জন্য আরাফাতের দিন ( ৩তারিখ জুমাবার) রোজা রাখা অনেক অনেক মর্যাদার। হজরত আয়েশা রাঃ থেকে বর্ণিত রাসূল সাঃ বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা আরাফার দিনে এতবেশী সংখ্যক বান্দাহদেরকে দোযখ থেকে মুক্তি দেন যা আর কোন দিন করেন না (মুসলিম সহ একাধিক সহীহ হাদীসে বর্ণিত) । আবু কাতাদাহ রাঃ থেকে বর্ণিত, রাসূল সাঃ বলেছেন, আরাফার দিনের রোজা এক বছর আগের ও এক বছর পরের পাপকাজের কাফফারা করে দেয়। ( মুসলিম)
ঈদের নামাজে অংশ নেওয়া
যে যে অবস্থায় থাকুক ঈদের নামাজে শরীক হতে হবে। মনে রাখতে হব, ঈদ মুসলমানদের খুশির দিন। পবিত্র বিনোদনের নমূনা, যা ভোগবাদী ও ফুর্তিবাজ মানুষের জন্য শিক্ষনীয়। প্রবাসের নানা সীমাবদ্ধতা সত্বেও কাছের ও দূরের সকলের সাথে উৎসবমূখর পরিবেশে ঈদ উদযাপন করার চেষ্টা করতে হবে। কোরিয়ান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকদের কাছে ইসলামী সংস্কৃতি তুলে ধরতে হবে। এতে তাদের ও আমাদের উভয়েরই কল্যাণ রয়েছে। সবাই যার যার সংস্কৃতিকে লালন করে। একে অপরের সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা থাকলে দূরত্ব থাকেনা, অনেক সমস্যাই সমাধান হয়ে যায়। কিছুটা পার্থক্য থাকলেও ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতির ব্যাপারে কোরিয়ানরা বেশ উদার ও কৌতূহলী। বর্তমানে কোরিয়ান পরিসংখ্যানে ইসলাম ধর্ম একটি উদীয়মান ধর্ম হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। এর কারণ ইসলাম তাদের কাছে নতূন এবং উন্নত মনুষ্যত্ববোধের শিক্ষা দেয় যা অন্য কোন কোথাও শোনেনি। ঈদের নামাজ সহ ধর্মকর্ম করতে অনেকের কিছুটা সমস্যার মধ্যে পরতে হয়। এক্ষেত্রে যদি কাজ দিয়ে তাদের সন্তষ্ট করা যায়, একজন ভাল মানুষ হিসেবে সুন্দর ব্যবহার করা হয়, কাজের ফাঁকে ধর্মপালন তাদের অধিকার হরণ নয় বরং সহায়ক, এটা যদি তাদের কাছে প্রমাণ করানো যায়।
সর্বোপরি প্রাথমিক কিছু বিড়ম্বনা সহ্য করে আদর্শের উপর অবিচল থাকা যায়, তাহলে দেখতে পাবেন এই কোরিয়ানরাই আপনার ধর্ম ও সংস্কৃতির ভক্ত হয়ে গেছে। গত ২ দশক থেকে কর্মরত প্রবাসী মুসলিমরাই এর সাক্ষ্য দেয়। আমাদের সদিচ্ছা এবং ‘কূটনৈতিক প্রচেষ্ঠা’ থাকলে প্রবাসেও আমরা আমাদের ধর্ম-সংস্কৃতি (অধিকার) চর্চা করার সহজ সু্যোগ পাব। উল্লেখ্য, কোরিয়াতে ইন্দোনেশিয়ানরা তাদের দূতাবাস ও সমন্বয়কারীর প্রচেস্টায় ঈদের সময় জাতীয় ছুটি হিসেবে কোরিয়ান মালিকের কাছ থেকে ছুটি আদায় করে নেয়। এছাড়াও বিশ্বের প্রভাবশালী নানা দেশেও মুসলিমগণ এভাবে তাদের অধিকার সহজে আদায় করে নিয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে কোরিয়াতেও এমন পরিবেশ আসবে ইনশাআল্লাহ।
কোরবানী করা
জিলহাজ্ব মাসে কোরবানীর আদেশ শুধু তাদের জন্য নয় যার হজ্বে আছে, বরং এটা প্রত্যেক সচ্ছল মুসলমানের জন্য। নবী সাঃ দশ বছর মদীনায় বাস করেন এবং প্রতি বছর কোরবানী করতে থাকেন ( তিরমিযি, মিশকাত)। মূলত এই কোরবানীর শিক্ষা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে এটা প্রত্যেক জাতির জন্যই আল্লাহর হুকুম ছিল। এমন কি সৃষ্টির শুরু থেকে (আদম (আঃ) এর দুই পুত্র থেকে)। সূরা হজ্ব ৩৪ / সূরা মায়েদা ২৭ তে এ সম্পর্কিত বর্ণণা পাওয়া যায়। হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর রাঃ কে একজন জিজ্ঞাসা করলো কোরবানী করা আবশ্যক কিনা ? তিনি বলেন, নবী সাঃ এবং মুসলমানগণ কোরবানী করেছেন। ঐ ব্যক্তি পুনরায় প্রশ্ন করলে তার জবাবে হযরত আব্দুল্লাহ বলেন, তুমি বুঝতেছনা যে, নবী সাঃ এবং মুসলমানগণ কোরবানী করেছেন।
আমরা প্রবাসে সচ্ছলতার সাথে বসবাস করি। আমাদের বোঝার বাকি নেই যে, আমাদের কোরবানী করতে হবে। অভাব না থাকলেও বাস্তব কিছু সমস্যা এখানে থাকে। পশুর অপ্রতুলতা, জবেহ করার স্থান সংকট, জবেহ পরবর্তী কাজের জন্য লোক সংকট। এসব সমস্যা সত্ত্বেও একনিষ্ট বহু মুসলিম একা কোরবানী দিচ্ছেন অথবা যৌথভাবে দিচ্ছেন। প্রবাসের এই কষ্টকর আমলের জন্য আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে মর্যাদায় সমাসীন করবেন। কোরিয়াতে যারা স্থায়ী থাকেন (পরিবার নিয়ে), ব্যবসায়ী, কিছুটা স্বাধীন চাকরিজীবী ইত্যাদি যাদের জন্য উপরিউক্ত সমস্যাগুলোর সমাধান করা সহজ। তাদের কোরবানী না করা বড়ই গুনার কাজ। এতে তারা নিজেদের বঞ্চিত করতেছেন এমন নয় শুধু বরং কোরিয়ান সমাজকেও বঞ্চিত করছেন। উপরিউক্ত সমস্যার ক্ষেত্রে নিকটস্থ হালাল ফুড প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। কোরিয়া মুসলিম ফেডারেশন (KMF) ও সাহায্য করে থাকে। নিকটস্থ মসজিদ বা ইসলামিক সেন্টারেরও সাহায্য নেওয়া যায়। ইন্টারনেটের মাধ্যমে বা অন্য কোনভাবে পশুর ফার্ম এর খোজ নিয়ে কোরবানি দেওয়া যায় । তাদেরকে ইসলামি জবেহ পদ্ধতি অবগত করে ওখানেই কোরবানীর কাজ সম্পাদন করা যায়। মনে রাখতে হবে, দেশে হোক বা বিদেশে, এসব কাজ একটু কষ্টকর হয়ে থাকে বলেই এর আনন্দ ও মর্যাদা মধুর হয়। এভাবে কোরবানী করে আমরা কোরিয়ান সহ অন্যান্য ধর্মের লোকদের সাথে নিয়ে ঈদের যে আনন্দ পাবো, তা আর অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না। ”আল্লাহ এভাবে পশুদেরকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা তাঁর দেয়া নির্দেশনা অনুযায়ী তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ কর।” সূরা হজ্ব ৩৭।
হাজ্ব, কোরবানী ও ঈদ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা
বিজ্ঞানময় এই যুগে আমাদের বিশ্বাস ও কর্মসমূহকে শুধুমাত্র আবেগ দিয়ে মূল্যায়ন করলে এবং প্রচলিত রসম রেওয়াজের মত করে অন্ধ অনুসরণ করলে যথেষ্ট নয়। চিন্তা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে, শ্রম মেধাকে ভিত্তি করে, আবেগ ভালবাসার সৌন্দর্য দিয়ে সাজিয়ে আমাদের বিশ্বাস নামক বীজকে ফুলে ফলে বিকশিত করতে হবে। অন্যথায় এই বিশ্বাসের বীজসমূহ অংকুরিত হওয়ার আগেই তা মাটির সাথে মিশে যাবে। আজকের মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে বড় অভাব হচ্ছে নিজের বিশ্বাস ও ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞতা। আমি এটা বুঝাতে চাইনি যে, বিজ্ঞান ও যুক্তি ছাড়া বিশ্বাস করা যাবেনা, বরং আমি বুঝাতে চেয়েছি আপনার চিন্তা-গবেষণা অদৃশ্যের প্রতি বিশ্বাসকে একটি পরিপূর্ণ বৃক্ষে পরিণত করবে, যা উর্ধ্বমূখী এবং আশপাশজুড়ে বেষ্টিত। আল কোরআন বিশ্বাসীদের প্রতি এই ধরণের আহবানই করেছেন বেশী বেশী। বিভিন্ন যুক্তি ও প্রশ্ন-উত্তরের অবতারণা করেছেন। নবী সাঃ ও একই ভাবে বিশ্বাস ও কর্মসমূহকে প্রতিষ্ঠা করেছেন ব্যক্তিতে, সমাজে। মানুষ শয়তান এবং জীন শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আল্লাহ আমাদের হেফাজাত করুন। আমীন।
আমাদের সবাইকে জিলহজ্জ মাসের এই আমল সমূহ পালনের তাওফীক দিক। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদেরকে জিলহজ্জ মাসের সব চেয়ে বড় আমল ‘হাজ্জে বায়তুল্লাহ’ আদায়ের তাওফীক দিক আমীন।
লেখক- ইমাম, শিওয়া মসজিদ, আনসান, দক্ষিণ কোরিয়া।





































