
বাংলাদেশের পাবনার ঈশ্বরদীতে যখন গত রোববার সদ্যোজাত আটটি কুকুর ছানা বস্তায় ভরে পুকুরে ফেলে মেরে ফেলা হচ্ছিল, তখন মাত্র দেড়শো কিলোমিটার দূরে পশ্চিমবঙ্গের নদীয় জেলার নবদ্বীপে ঘটছিল সম্পূর্ণ বিপরীত এক ঘটনা।
পাবনার ঘটনা যেমন বাংলাদেশের মানুষকে হতবাক করে দিয়েছে, তেমনই নদীয়ার ঘটনাতেও অবাক মানুষ।
পাবনার সেই মা কুকুরটি যখন সন্তান হারিয়ে ছোটাছুটি করছিল, সেই একই সময়ে এক সদ্যোজাত মানব সন্তানকে পাহারা দিচ্ছিল নবদ্বীপের কয়েকটি দেশি কুকুর।
সোমবার সকালে নবদ্বীপের স্বরূপগঞ্জ এলাকার ভৌমিক পরিবারের সদস্যরা যখন তাদের বাড়ির টয়লেটের কাছে খুঁজে পান সদ্যোজাত ওই শিশুটিকে, তাকে ঘিরে রেখেছিল চারটি কুকুর।
পাড়াতেই ঘোরঘুরি করে ওই কুকুরগুলো। ওরাই নিজের থেকে দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছিল মানবশিশুটিকে পাহারা দেওয়ার।
স্বরূপগঞ্জের মানুষ যখন আলোচনা করছেন যে কোনো মা তার সন্তানকে জন্ম দেওয়ার পরেই কারও বাড়িতে ফেলে দিয়ে যেতে পারে, একই সঙ্গে ওই দেশি কুকুরগুলোর ‘দায়িত্ববোধ’ নিয়েও প্রশংসা করছেন তারা।
কী হয়েছিল ভৌমিক বাড়িতে?
অন্যদিনের মতো সোমবার সকালে টয়লেটে যাচ্ছিলেন ভৌমিক পরিবারের প্রবীণ সদস্য রাধা ভৌমিক।
হঠাৎই তার কানে আসে শিশুর কান্নার শব্দ।
তিনি জানাচ্ছিলেন, “আমি রাস্তা থেকে ঘুরে এসে বাথরুমে যাব, হঠাৎই বাঁদিকে নজর গেছে আমার। কানে কান্নার আওয়াজ পাই। বাঁদিকে তাকিয়ে দেখি বাচ্চাটা পড়ে আছে। গায়ে কিচ্ছু নেই। যেভাবে হয়েছে, সেভাবেই রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে দিয়ে গেছে।”
পরিবারের মানুষদের ডাকাডাকি করে একটা কাপড়ে জড়িয়ে নিয়ে শিশুটিকে তারা স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে শিশুটিকে কৃষ্ণনগরের সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
ভৌমিক বাড়িরই আরেক সদস্য পিঙ্কি ভৌমিক জানাচ্ছিলেন, “ভাগ্যিস শেয়াল টেনে নিয়ে যায়নি। এই ঠান্ডার মধ্যে ওর গায়ে কিচ্ছু ছিল না। আমরাই একটা কাপড় দিয়ে পরিষ্কার করে ওকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম।”
পাহারায় ছিল চারটে দেশি কুকুর
শেয়াল কীভাবেই বা টেনে নিয়ে যেত সদ্যোজাত ওই শিশুটিকে? তাকে যে ঘিরে রেখেছিল চারটে কুকুর।
“আমাদের এখানে কুকুর আছে চারখানা, ছোট থেকে পালি আমরা ওদের, খাবারদাবার দিই। ওরাই বাচ্চাটাকে পাহারা দিয়ে রেখেছিল সেদিন,” বলছিলেন পরিবারেরই সদস্য এবং স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য নির্মল ভৌমিক।
বৃহস্পতিবার ভৌমিক বাড়িতে গিয়ে দেখা পাওয়া গেল সেই কুকুরগুলোর কয়েকটিকে।
পরিবারের আরেক সদস্য মানিক ভৌমিক বলছিলেন, “এই কুকুরগুলোই পাহারা দিচ্ছিল সে রাতে। এই কুকুরগুলো রাস্তাতেই থাকে, পথে বসে পাহারা দেয়। আমাদের কজনের বাড়িতে যায় খাওয়া দাওয়া করে। ওরাই পাহারা দিয়ে রেখেছিল – শেয়াল ঢুকতে পারেনি।”
দায়িত্ব নিয়েছে শিশু কল্যাণ কমিটি
কোনো শিশুকে খুঁজে পাওয়া গেলে আইন অনুযায়ী জেলার শিশু কল্যাণ কমিটিকেই তার দায়িত্ব নিতে হয়। চিকিৎসা থেকে শুরু করে কোনো আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানো – সবটারই দায়িত্ব জেলা শিশুকল্যাণ কমিটির।
স্বরূপগঞ্জের ভৌমিক বাড়ি থেকে পাওয়া শিশুটিরও দায়িত্ব নিয়েছে নদীয়া জেলা শিশু কল্যাণ কমিটি বা সিডব্লিউসি।
কমিটির চেয়ারপার্সন টিয়া বিশ্বাস বিবিসিকে বলছিলেন, “সদ্যোজাত ওই শিশুটি আমাদের দায়িত্বেই আছে। হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছে। আর আইন অনুযায়ী আমাদের ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দিতে হয়, সেই নির্দেশও আমরা জারি করে দিয়েছি। পুলিশও তদন্ত করবে, আমাদেরও অন্যান্য তদন্ত করতে হবে – বিশেষত যদি শিশুটির পরিচয় খুঁজে পাওয়া যায়, সেটাও দেখতে হবে।”
স্বরূপগঞ্জের পুলিশ তদন্ত শুরু করে দিয়েছে যে কোনো মা এভাবে শীতের রাতে সদ্যোজাত সন্তানকে ফেলে দিয়ে যেতে পারে!
ভারতে কন্যা সন্তান হলে তাকে রাস্তায় বা ময়লার বাক্সে ফেলে দেওয়ার ঘটনা মাঝে মধ্যেই সামনে আসে। কিন্তু স্বরূপগঞ্জের ঘটনায় নবজাতটি পুত্র সন্তান। তাকে কেন ফেলে দিল তার পরিবার, সেটাই এখন স্পষ্ট নয়।
এলাকার মানুষ অবশ্য সন্দেহ করছেন সামাজিক লজ্জা থেকে বাঁচতে কেউ একাজ করে থাকতে পারেন।
পথ কুকুর ভারতে বড় সমস্যা
নবদ্বীপের ঘটনায় চারটি দেশি কুকুরের ভূমিকা নিয়ে সবাই যখন আলোচনা করছে, তখন এধরনের পথ কুকুরদের নিয়ে ক্ষুব্ধ অনেক মানুষ।
কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ভারতে গত বছর ৩৭ লাখ মানুষকে কুকুর কামড়িয়েছে। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে সাড়ে ৭৬ হাজার ঘটনা আছে। শুধু দিল্লি শহরে পথ কুকুরের কামড় খেয়েছেন ২৫ হাজারেরও বেশি মানুষ।
ভারত সরকার দেশের সংসদে তথ্য দিয়ে জানিয়েছে যে ২০২৪ সালে সারা দেশে ৫৪ জন মানুষ জলাতঙ্কে মারা গিয়েছিলেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীতে যত মানুষ জলাতঙ্কে মারা যান, তার ৩৬ শতাংশই ভারতের।
পথ কুকুরদের হিসাব করা হয় না, তবে দিল্লি শহরেই কয়েক লাখ পথ কুকুর আছে।
গত অগাস্ট মাসে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট আদেশ দিয়েছিল যে রাজধানী দিল্লিতে সব পথ কুকুরকে ধরে এনে তাদের ভ্যাকসিন দিতে হবে এবং নির্বীজকরনের পরে যে এলাকা থেকে ধরা হয়েছে, সেখানেই ছেড়ে দিয়ে আসতে হবে। তবে হিংস্র এবং যেসব কুকুরের জলাতঙ্ক আছে, তাদের আশ্রয় শিবিরেই রেখে দিতে হবে।
এই ইস্যুতে পশু অধিকার কর্মীদের সঙ্গে বিরোধ আছে সেসব মানুষের – যারা মনে করেন পথ কুকুরদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দিয়ে নির্বীজকরণ অথবা মেরে ফেলাই এই সমস্যার ‘সমাধান’। তবে ‘সমাধান’ ঘিরে প্রশ্ন ওঠে এই পথ কুকুররাই যখন সদ্যোজাত এক মানব সন্তানকে রক্ষা করে, তখন!
সূত্র: বিবিসি বাংলা







































