Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

পলাশী যুদ্ধের শুরুটা যেভাবে

polashiনবাবের বাহিনী ততক্ষণে ছাউনি থেকে বের হয়ে প্রান্তরের দিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। চারদিক থেকে সৈন্যরা এসে জড়ো হতে শুরু করে পুরো এলাকায়। জমকালো কাপড়ে আচ্ছাদিত হাতিগুলো বাহিনীর পুরোভাগে থেকে যুক্ত করেছে ভিন্ন এক আভিজাত্য। পুরো বাহিনীর দিকে এক ঝলক দৃষ্টি গেলেই যে কারো শিরদাঁড়া বেয়ে ভয়ের হিমশীতল ভাব নেমে যাবে। সারিবদ্ধ সৈন্যদের শিরস্ত্রাণ আর তরবারিগুলো হালকা রোদেই বারবার ঝিলিক দিয়ে উঠছে। সবচেয়ে বড় কামানটাকে একটা কাঠের তৈরি পাটাতনের ওপর স্থাপন করা হয়েছে। বহু দূর থেকেও সহজে দৃষ্টি যায় ওই কামানের দিকে। বাহিনীর শক্তিমত্তা আরো বাড়িয়ে তোলার পাশাপাশি অস্ত্র পরিবহনের জন্য রয়েছে অনেকগুলো ষাঁড়। বিশালাকৃতির কামানের পাটাতনগুলোকে টেনে আনছে শক্তিশালী সাদা ষাঁড়গুলো। হাতিগুলোও কাজে লাগানো হচ্ছে। ষাঁড় কিংবা হাতিগুলোর মাথা থেকে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে নানা ধরনের সব ঝালর।

বৈচিত্র্যময় সাজপোশাকে এ ধরনের ভারতীয় যুদ্ধযাত্রা ইংরেজদের জন্য নতুন কিছু নয়। তবু প্রতিপক্ষের সমর প্রস্তুতি দেখে ক্লাইভের বাহিনী শুরুতেই থমকে যায়। বিশেষ করে হাতিসহ অতগুলো কামানের পাশাপাশি অর্ধলক্ষাধিক সৈন্যের সুসজ্জিত বহর দেখে এক লহমায় কলজে শুকিয়ে কাঠ হওয়ার উপক্রম তাদের। এর আগের যুদ্ধগুলোয় ক্লাইভ যে বাহিনীর মুখোমুখি হয়েছিলেন, সেখানে সৈন্যরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত ছিল না। এবারের যুদ্ধে সাধারণ সৈন্যের পাশাপাশি দাক্ষিণাত্য থেকে যেসব অশ্বরোহীকে ভাড়া করে আনা হয়েছিল, তাদের সবাই ছিল দেহ, মন ও মননে পুরোদস্তুর যুদ্ধবাজ। একবার রণভেরী বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তারা কতটা উন্মত্ত হয়ে প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, তা নিয়ে কারো সংশয় ছিল না।

chardike-ad

তীব্র গরমে ইংরেজ সৈন্যের বেশির ভাগ ঘেমে অস্থির। তাদের পক্ষে এ অবস্থায় যুদ্ধ চালিয়ে নেয়া পাহাড়সম চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেয়। তবু ছাড় দেয়ার পাত্র নয় তারা। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সবাই প্রস্তুত, নেতার পক্ষ থেকে আক্রমণের চূড়ান্ত নির্দেশ আসার অপেক্ষায়। কর্ণাটকের লড়াইয়ে ইংরেজ বাহিনী যে সুবিধাগুলো পেয়েছিল, এখানে তার সিংহভাগ উপস্থিত থাকবে না, তা বুঝতে খুব বেশি সময় লাগেনি ক্লাইভের। তার পরও পরিস্থিতি নখদর্পণে নিতে তখনো তৎপর তিনি। অন্তত শত্রুসেনার তুলনায় তার বাহিনীর অবস্থান কেমন, সেটা বুঝে নিতে প্রথম থেকেই উদ্যোগ লক্ষ করা গেছে ক্লাইভের মধ্যে। পাশাপাশি মীর জাফরের পক্ষ থেকে তথ্য মিলেছে, ফরাসিদের একটি দল নবাবের পক্ষে মাঠে নামতে পারে।

একদিকে নবাবের বিশাল বাহিনীর রণসজ্জায় আতঙ্কিত ইংরেজরা। তার সঙ্গে ইংরেজদের জাতশত্রু চৌকস ফরাসিদের একটি ইউনিটও যদি মাঠে নামে, তা হবে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। বিশেষ করে ইংরেজরা সম্মুখযুদ্ধে ফরাসিদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে গলদ্ঘর্ম হওয়ার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। অন্যদিকে পরিস্থিতির কবলে পড়ে মীর জাফরের বাহিনীও ইংরেজদের পক্ষে লড়াইয়ের ময়দানে নামতে পারছে না।

এদিকে যুদ্ধ অন্যদিকে মোড় নিলে নিজেদের পিঠ বাঁচাতে গিয়ে মীর জাফরের সৈন্যরাও যে ইংরেজদের ওপর চড়াও হবে না, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। পাশাপাশি দুই ভাগে ভাগ হয়ে চারদিকে ঘিরে ফেলার যে পরিকল্পনা নিয়ে নবাবের বাহিনী সামনে এগিয়ে চলেছিল, সেটাও ইংরেজদের মনে ব্যাপক ভীতির জন্ম দেয়। এতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়লে বের হওয়ার কোনো পথ থাকবে না তাদের সামনে। আটকে পড়লে তার নামান্তর নির্বিচার গণহত্যার সম্মুখীন হওয়া। অন্তত এখন পর্যন্ত নবাবের প্রতি তাদের আচরণ আত্মসমর্পণ করে প্রাণরক্ষার মতো অবস্থাও আর টিকিয়ে রাখেনি।

শত্রুশিবিরে সৈন্যদের নড়াচড়া লক্ষ করে ক্লাইভ নিজ বাহিনীর নেতাদের সঙ্গে আরেক দফা বৈঠক করেন। কোনোভাবে যুদ্ধের ফলাফল তাদের বিপরীতে গেলে সেখান থেকে নিরাপদে পিছু হটার ছক নিয়েও আলাপ করেন তারা। কোনো ধরনের বিপর্যস্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে রাতের আঁধারেই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে আসার নির্দেশ দেয়া হয় ইংরেজ সৈন্যদের।

নবাবের বাহিনী দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে আমবাগানের মধ্য দিয়ে এগিয়ে আক্রমণ চালানোর প্রস্তুতি গ্রহণ করে। তারা প্রথম আক্রমণেই ইংরেজ বাহিনীকে একেবারে ছত্রখান করে দেয়ার চেষ্টা চালাবে, তা শুরু থেকেই উপলব্ধি করেন ক্লাইভ। গোলন্দাজ বাহিনীর ওপর নির্ভরশীল ইংরেজ সেনাদল একটি ইটভাটার মধ্যে ঢুকে অবস্থান নেয়। তবে সেখানে অবস্থান গ্রহণ তাদের জন্য অতটা নিরাপদ ছিল না। এ সময় কামান থেকে গোলাবর্ষণ করে ইংরেজরা নবাবের বাহিনীর মাঝে কিছু অবকাশ তৈরি করতে সক্ষম হয়। সিদ্ধান্ত আসে, ওই জায়গাগুলো দিয়েই অনুপ্রবেশ করতে হবে। বিশেষ করে নানা দিক থেকে আক্রান্ত হয়ে যুদ্ধের শুরুতেই নবাবের বাহিনীর ছোড়া গুলিতে প্রাণ যায় ২০ জন সিপাইয়ের পাশাপাশি জনা দশেক ইংরেজ সেনার।

বিখ্যাত সেনানায়ক সিনফ্রের নেতৃত্বে নবাবের পক্ষে লড়াইয়ে অংশ নেয় প্রায় অর্ধশত ফরাসি সেনা। তারা একটি সুবিধাজনক জায়গা থেকে কামান দাগতে থাকে ইংরেজদের অবস্থানের ওপর। এ বাহিনী ক্ষুদ্রকায় হলেও নবাবের বাহিনীর তুলনায় ছিল অনেক গোছানো। মাঠের লড়াইয়ে ইংরেজদের সব দুর্বলতাও তারা জানত। এভাবে আধাঘণ্টা ধরে কামানের গোলা নিক্ষেপের মুখে পড়ে ক্লাইভ বুঝতে পারেন তার বাহিনীর দুরবস্থার কথা। এর পর পুরো বাহিনীকে আমবাগানের মধ্যে তৈরি করা অস্থায়ী ছাউনি থেকে পিছু হটতে বলা হয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন গাছের আড়ালে থেকে নবাবের বাহিনী গোলাবর্ষণ করে গেলেও তাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকটা কমে যায়। পাশাপাশি আরেকটু পিছু হটে এলে আগে থেকে অবস্থান নিতে থাকা সৈন্যরা এবার নতুন উদ্যমে লড়াই শুরু করে। তবে ক্লাইভ চেয়েছিলেন যেভাবে হোক কোনোক্রমে অন্তত আক্রমণ সারা দিন ধরে রাখা। এতে রাতের আঁধারে শত্রু ছাউনিতে হামলা করার একটা সুযোগ আসবে। এভাবেই গা বাঁচিয়ে হলেও গোলাগুলি চলতে থাকে দুই পক্ষ থেকে।