Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

সততার দৃষ্টান্ত!

japanযাত্রা শুরুর আগের রাতে শুভ বলল, অ্যাই শুনছ তো, কাল কিন্তু সকাল সকাল বেরোতে হবে। তোমার লাগেজ গোছানো হয়েছে? তখন খুব ঘুম পাচ্ছিল। উত্তর দিতে গেলে ঘুমের রেশটা কেটে যাবে চিন্তা করে হুম বলে পাশ কাটিয়ে দিলাম। সকালে উঠে যথানিয়মে মা-ছেলের খাওয়া নিয়ে মল্লযুদ্ধ শুরু হলো। এই করতে করতে শেষমেশ দেরিই হয়ে গেল।

যাদের পরিবারে বাচ্চাকাচ্চা আছে তারা নিশ্চিতভাবেই জানেন, সফরে বের হলে কী পরিমাণ জিনিসপত্র গোছানো লাগে। স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ব্যাগে একের পর এক জিনিসপত্র তোলা হলো। কোথাও বের হওয়ায় আগে আমার গুণধর পুত্রটি একটা না একটা অপকর্ম করেই। দেখা গেল, সবাই প্রস্তুত, গাড়ির চাবি পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক খোঁজাখুঁজি করে সেটা উদ্ধার হলো কার্পেটের নিচ থেকে। ততক্ষণে বেড়ানোর আগ্রহ আর শক্তি দুটোই নিঃশেষের দিকে পৌঁছে এবং যাত্রা বাতিল হয়ে যায়!

chardike-ad

যাক, সেদিন অবশ্য কোনো রকম অঘটন ছাড়াই বের হলাম। যাচ্ছিলাম জাপানের বিখ্যাত ফুজি পাহাড়ের কাছাকাছি এলাকায় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পণ্য মেলে এমন শত শত দোকান নিয়ে স্থাপিত গোতেম্বা নামক একটা আউটলেটে। লক্ষ্য বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে ঘড়ি কেনা। জায়গাটা একটু দুর্গম হওয়ায় বাস বা গাড়ি ছাড়া যাওয়া সহজ নয়। বাসে যাব ঠিক ছিল, অথচ টিকিট কাটা হয়নি। আল্লাহর নাম নিতে নিতে দুজন ঝড়ের বেগে টোকিও স্টেশনের দিকে রওনা দিলাম।

বাস ছাড়বে সকাল সাড়ে দশটায়। আমরা পৌঁছালাম ঠিক ছয় মিনিট আগে। বলে রাখা ভালো, জাপানের ব্যস্ততম টোকিও স্টেশনটা বেশ বড় আর সব সময়ই ভিড়ভাট্টায় পূর্ণ। আমরা তীরের বেগে ছুটে গেলাম বাস স্টেশনের দিকে। একপর্যায়ে দেখি বাবা​-ছেলে আমাকে ফেলে রেখেই স্টেশনের বাইরে চলে যাচ্ছে। গেল ভালো কথা, কিন্তু তারা যাওয়ার সময় অধিক উত্তেজনায় আমার স্টেশন থেকে বের হওয়ার টিকিটও সঙ্গে নিয়ে গেছে।

আমি ভেতরে আটকা পড়ে শাপ-শাপান্ত শেষ করে গেলাম টিকিট কিনতে। আমার দুহাতে তখন ন্যূনতম চারজনের জিনিসপত্র। এই অবস্থায় খেই হারিয়ে কোনো রকমে টাকা রাখার ছোট পার্স বের করতে পারলাম। এমন সময় দেখি বাবা-ছেলে কালো মুখে ফিরে আসছে। কি হয়েছে, বাস পাওনি, উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম। নাহ, বাস রয়েছে, সিট নেই, যাত্রা বাতিল! হতাশা আর দুঃখে হাতের পার্স টিকিট কাউন্টারে রেখেই মনের ভুলে কখন যে সেখান থেকে চলে এসেছি মনেও নেই।

বলে রাখা ভালো যে, বিদেশে পার্সের মধ্যে যতটা টাকা থাকে, তার চাইতেও বেশি থাকে দরকারি কাগজপত্র আর কার্ড। জাপান হলো কার্ডের স্বর্গরাজ্য। এ দেশে চুল কাটতে গেলেও সে দোকানের কার্ড দিয়ে দেয়। সেখানে প্রতিবার চুল কাটায় একটা সিল পড়ে। ১০ বার চুল কাটলে একবার বিনা মূল্যে চুল কাটার সুযোগ। একইভাবে ১০ বার একই দোকানে খেলে ১১ বারের বেলায় রাজকীয় ভোজ ফ্রি। সবই ব্যবসায়িক চাতুরতা।

যা হোক, আমার ব্যাগে হাবিজাবি একগুচ্ছ কার্ডের বাইরেও দুটো অতীব গুরুত্বপূর্ণ কার্ড ছিল। একটি ক্যাশ কার্ড, অপরটি ক্রেডিট কার্ড। জাপান জীবনের যা কিছু সঞ্চয় তার সবটাই ওই কার্ডের মধ্যে জমা হয়েছে। দুটো কার্ড ব্যবহার করতেই পাসওয়ার্ড প্রয়োজন তবে সেখানে থাকা তথ্যগুলো বেশ সংবেদনশীল। আর পাসওয়ার্ড না ব্যবহার করেও ক্রেডিট কার্ডে অনায়াসে লাখ খানেক টাকার বাজার করা সম্ভব। এ রকম দুটো কার্ড সংবলিত পার্স জাপানের সবচেয়ে ব্যস্ত স্টেশনের মহা ভিড়ের মধ্যে যে হারিয়ে ফেলেছি তা খেয়াল হলো ঘণ্টা চারেক পার হয়ে একটা রেস্টুরেন্টে বসে খাবারের অর্ডার দেওয়ার পর। দুজনেই স্তম্ভিত ও বাক্যহারা!

এই ব্যাগ কী আর ফেরত পাব? এ কী সম্ভব? দুজনেই ছুটলাম হারানো জিনিসপত্র রাখা হয় এমন অফিসে। পাংশু মুখে খোঁজ করলাম। হ্যাঁ মিলেছে এমন একটা ব্যাগ। ছুট লাগালাম সেদিকে। অবচেতন মনে ভাবছি যদিবা ব্যাগ থাকেও, কার্ডগুলো কী অব্যবহৃত থাকবে?

এত দিন পত্রিকায় পড়েছিলাম কিন্তু নিজের জীবনেও সেটা চরম সত্য হয়েই ধরা দিল। নাম না জানা কোনো মহান মানুষ ব্যাগটি একেবারে অক্ষত অবস্থায় অফিসে ফেরত দিয়েছেন। ধন্যবাদ জানিয়ে খাটো করার সুযোগটুকুও না দিয়ে একেবারে নীরবে প্রস্থান করেছেন তিনি। আমরা এমন ভাব করতে লাগলাম, যেন এটাই স্বাভাবিক।
আমাদের পরিচিত অনেকেই জাপানে ল্যাপটপ, ফোন, ব্যাগ, ঘরের চাবি থেকে শুরু করে হারিয়ে যাওয়া অনেক কিছুই ফেরত পেয়েছেন।

অবিশ্বাস্য একেকটা ঘটনা। কীভাবে একটা জাতি অপরের জিনিসের প্রতি এতটা নির্মোহ হয়ে গিয়েছে দুজন একটু বিশ্লেষণ করতে চাইলাম। সবশেষে মনে হলো, জাপান আমাকে নানাভাবে ঋণে বেঁধেছে। জাপানের গুলিস্তান অর্থাৎ শিবুইয়া নামে পরিচিত টোকিওর প্রাণকেন্দ্রে টাঙানো একটা বড় ব্যানার দেখেছিলাম একবার। সেখানে জাপানি ভাষায় লেখা ছিল—নিহোন দাকে দেকিরু। যার বাংলা তরজমা করলে দাঁড়ায়, একমাত্র জাপান বলেই সম্ভব। অনেকের অনেক অসন্তুষ্টি থাকলেও নিজের জীবন দিয়েই বিচার করে দেখলাম, একটা জাতি কতটা সৎ, কতটা পরিশ্রমী, কতটা নির্মোহ হতে পারলে এমন কথা লিখতে পারে!

লেখকঃ শারমিন সিদ্দিক ভূঁইয়া, টোকিও থেকে, সৌজন্যেঃ প্রথম আলো