Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

বাংলাদেশে দূষিত বাতাসে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে

bd airদেড় দশকে দেশে শিল্পায়ন হয়েছে লক্ষণীয়। বিস্তৃত হয়েছে ইস্পাত, সিমেন্ট, সিরামিক শিল্পের। এসব শিল্প প্রতিষ্ঠা যতটা গুরুত্ব পেয়েছে, ততটাই উপেক্ষিত থেকেছে পরিবেশের বিষয়টি। ফলে এসব শিল্প থেকে নির্গত বিপুল পরিমাণ ক্ষতিকর বস্তুকণা সরাসরি মিশছে বাতাসে। এর সঙ্গে রয়েছে অপরিকল্পিত ইটভাটা ও যানবাহনের কালো ধোঁয়া। আগামীতে যোগ হচ্ছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে ১৭ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উত্পাদনের লক্ষ্য ধরা হয়েছে কয়লা থেকে, যা বাতাসে সালফার ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণা বলছে, বায়ুতে ক্ষতিকর গ্যাস ও বস্তুকণার মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি ফুসফসে ক্যান্সার, স্ট্রোক, অ্যাজমাসহ শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত নানা রোগ ও হূদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। এতে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও।

chardike-ad

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য বলছে, শুধু বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাবে ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে মৃত্যু হয় ৩০ হাজার ৯০০ জনের। দূষণের মাত্রা বাড়ায় মৃত্যুহারও বাড়ছে ধারাবাহিকভাবে। ১৯৯৫ সালে বায়ুদূষণে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৮ হাজার ৮০০। ২০০০ সালে তা আরো বেড়ে দাঁড়ায় ৪২ হাজার ৬০০, ২০০৫ সালে ৫১ হাজার ও ২০১০ সালে ৬৫ হাজার। আর ২০১৩ সালে বায়ুদূষণে মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয় ৭০ হাজার।

বর্তমানে দেশে প্রায় ৯০ লাখ মানুষ অ্যাজমায় আক্রান্ত। বিশেষজ্ঞদের মতে, রোগটিতে আক্রান্ত হওয়ার প্রধান কারণ বাতাসে বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতি। ফুসফুস ক্যান্সারে মৃত্যুরও অন্যতম কারণ বায়ুদূষণ।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বক্ষব্যাধি বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ফুসফুসের ক্যান্সার ও অ্যাজমার প্রধান কারণ বায়ুদূষণ। যতক্ষণ না বায়ুদূষণ কমানো যাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত কমবে না এসব রোগে মৃত্যুহার।

কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেনের বিভিন্ন অক্সাইড, ওজন ও বস্তুকণার উপস্থিতির ভিত্তিতে দূষিত বায়ুর দেশের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে ডব্লিউএইচও। তালিকায় ৯১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে চতুর্থ স্থানে। বাংলাদেশের বাতাসে এসব গ্যাস ও বস্তুকণার সবই পরিবেশ অধিদপ্তর নির্ধারিত মানমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।

বাতাসে কার্বন মনোক্সাইডের প্রধান উৎস যানবাহন ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি। নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড মিশছে যানবাহন, বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং শিল্প, বাণিজ্যিক ও আবাসিক খাতে ডিজেল পোড়ানোর কারণে। ভারী ধাতু হিসেবে বাতাসে সিসা মিশছে যানবাহনের জ্বালানি, ব্যাটারি ও ইস্পাত কারখানা থেকে। এছাড়া দূষিত বস্তুকণার (পিএম ১০, ৫ ও ২.৫) উৎস ডিজেল ইঞ্জিন, যানবাহন, বিদ্যুৎকেন্দ্র, ইটভাটা, সিমেন্টসহ বিভিন্ন ধরনের শিল্প-কারখানা।

আর সালফার ডাই-অক্সাইডের প্রধান উৎস কয়লা। বাতাসে এটি মেশে মূলত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, ইটভাটা ও সালফিউরিক অ্যাসিড উত্পাদন কারখানা থেকে।

বাতাসে সালফার ডাই-অক্সাইডের মাত্রা অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে পরিবেশ অধিদপ্তরের এক গবেষণায়। গবেষণাটিতে তারা দেখিয়েছে, ২০১০ সালে ঢাকার বাতাসে ৩৪ হাজার ৩০০ টন সালফার ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হলেও ২০১৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬০ হাজার ২১৬ টন। অর্থাৎ তিন বছরে ঢাকার বাতাসে সালফার ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়েছে ৭৫ শতাংশ। আর গ্যাসটির ৯৮ দশমিক ৩ শতাংশই আসছে ইটভাটায় কয়লা পোড়ানোর কারণে।

বর্তমানে বাতাসে সালফার ডাই-অক্সাইডের প্রধান উৎস ইটভাটা হলেও আগামীতে এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। কারণ বর্তমানে কয়লা থেকে ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উত্পাদন হলেও ২০২১ সালের মধ্যে তা ছয় হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। আর ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উত্পাদনের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ১৭ হাজার মেগাওয়াট।

জানতে চাইলে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রযুক্তি আর আগের মতো নেই। দূষণ রোধ করার প্রযুক্তি অনেক উন্নত হয়েছে। কীভাবে প্রযুক্তি আরো উন্নত করা যায়, সে বিষয়ে উন্নত বিশ্বে গবেষণা চলছে। সেখান থেকে সর্বশেষ উদ্ভাবিত প্রযুক্তিই আমরা ক্রয় করি। প্রযুক্তি আরো উন্নত হলে দূষণও কমবে।

সালফার ডাই-অক্সাইডের মতোই ঢাকার বাতাসে বেড়েছে কার্বন মনোক্সাইডের পরিমাণ। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০১০ সালে ২৭ হাজার ১০০ টন কার্বন মনোক্সাইড নিঃসরণ হলেও ২০১৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫ হাজার ৫৮১ টনে। অর্থাৎ তিন বছরের ব্যবধানে নিঃসরণ বেড়েছে ৬৮ শতাংশ। আর ২০১৩ সালে নিঃসৃত কার্বন মনোক্সাইডের ৪০ শতাংশই এসেছে যানবাহনে ডিজেল পোড়ানোর ফলে। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে এসেছে ২৭ শতাংশ।

এছাড়া ২০১০ সালে বাতাসে ৪৪ হাজার ৯৫০ টন ক্ষতিকর বস্তুকণা (পিএম১০) মিশলেও ২০১৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৮ হাজার ৫২৪ টনে। ক্ষতিকর গ্যাস ও বস্তুকণার উপস্থিতি পরিবেশ অধিদপ্তর নির্ধারিত মানমাত্রার উপরে।

১০ মাইক্রোমিটার বা তার চেয়ে কম ব্যাসের ক্ষুদ্র বস্তুকণা পার্টিকুলেট ম্যাটার— পিএম১০ নামে পরিচিত। এসব ক্ষুদ্র বস্তুকণা নিঃশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে গিয়ে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। এসব বস্তুকণা সবচেয়ে বেশি আসছে ইটভাটা, সিমেন্ট, ইস্পাত, সিরামিক কারখানা থেকে। প্রতিটি ইটভাটা বছরে ৮৩ টন, লোহা ও ইস্পাত কারখানা ১৭ টন, সিমেন্ট কারখানা ১৩০ টন ও সিরামিক কারখানা থেকে গড়ে ২০ টন করে পিএম১০ বাতাসে মিশছে। এছাড়া চট্টগ্রামের ডিএপি (ডাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেট) সার কারখানা থেকে ৬৬৬ ও টিএসপি কারখানা থেকে ১ হাজার ৩২৬ টন পিএম১০ মিশছে বাতাসে।

সম্প্রতি চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ডিএপি সার কারখানা দুর্ঘটনায়  অ্যামোনিয়া গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে পরিবেশে। প্রাথমিকভাবে এতে অর্ধশত ব্যক্তি আক্রান্ত হলেও দীর্ঘমেয়াদে এর স্বাস্থ্যগত প্রভাব এখনো অজানা। এছাড়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে ইউরেনিয়াম ব্যবস্থাপনায় থাকবে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ।

সার্বিক বিষয়ে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী বলেন, শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীব্যাপীই দূষণজনিত কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। তবে এখন মানুষ সচেতন হচ্ছে। এখন যানবাহন থেকে কালো ধোঁয়া বের হয় না। যাচ্ছেতাইভাবে চালানো যায় না শিল্প-কারখানাও। বণিকবার্তার সৌজন্যে।