Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

বাঙালি বরের মনে ইউরোপের কনে

saipras-storyপোলিশ প্রবাদে আছে- মেয়েরা বিয়ের আগে কান্নাকাটি করে আর ছেলেরা বিয়ের পর। নিছক লোককথা হলেও ইউরোপে বিয়ের ভুল করলে যে কোন প্রবাসীরই কান্না করা লাগতে পারে।

বাংলাদেশ থেকে অনেকে মনে করেন যে ইউরোপে বিয়ে করা অনেক সহজ একটা ব্যাপার! আমি সাইপ্রাসে থাকি। সাইপ্রাসে বাংলাদেশি ছাত্র ও প্রবাসীদের বিয়ে ও বিয়ে করার সূত্রে নাগরিকত্বের মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে অনেক দালাল হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা।

chardike-ad

সাইপ্রাস ইউরোপিয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ হলেও ‘শেনজেন কান্ট্রি’ নয়। ইউরোপিয় ইউনিয়নের ২৬টি দেশ এই চুক্তিতে আছে। কিন্তু সাইপ্রাস নেই, দেশটি সম্পূর্ণ নিজস্ব আইনে চলে, অনেকটা ব্রিটিশদের মতো।

অনেকেই ভাবছেন শেনজেন জিনিসটা আবার কী! ইউরোপের মোট ৪৩টি দেশের মধ্যে ২৮টি দেশ হচ্ছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ)। আবার ৪৩টি দেশের মধ্যে ২৬টি দেশ হচ্ছে ‘শেনজেন কান্ট্রি’। এই দেশগুলো নিজেদের মধ্যে পাসপোর্টসহ সীমানা সংক্রান্ত অন্যান্য বিধি-নিষেধ প্রশাসনিকভাবে উঠিয়ে দিয়েছে। এই চুক্তিকে বলা হয় ‘শেনজেন চুক্তি’।

শেনজেন দেশগুলো হলো- অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, চেক রিপাবলিক, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিস, হাঙ্গেরি, আইসল্যান্ড, ইতালি, লাটভিয়া, লিশটেনস্টাইন, লিথুনিয়া, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, শ্লোভাকিয়া, স্লোভেনিয়া, স্পেন, সুইডেন ও সুইজারল্যান্ড।

এই ২৬টি দেশে প্রবাসীরা যদি বিভিন্ন মেয়াদে থাকেন (একেক দেশে একেক নিয়ম) তাহলে তাকে ওই দেশের সরকার ইউরোপের নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করে। তখন সরকার তাদের ইউরোপের কাগজপত্র দিয়ে দেয়। কিন্তু শেনজেনের বাইরে যে দেশগুলো রয়েছে ওইসব দেশে ইউরোপের কাগজপত্র পেতে হলে যে কোন ইউরোপিয়ান মেয়ে বিয়ে করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

এবার বলি ইউরোপের কাগজপত্র দিয়ে কী করা যায়। যদি কারো কাছে ইউরোপের কাগজপত্র থাকে তাহলে সে ইউরোপের ৩২টা দেশে বিনা ভিসায় অনায়াসে যেতে পারবেন ও কাজ করতে পারবেন।

এবার মূলকথায় আসি। এই ইউরোপিয়ান কাগজপত্র পাওয়ার জন্য সাইপ্রাসে হাজার হাজার প্রবাসী এশিয়ান ও বাংলাদেশি আছেন যারা ‘কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ’ এর মাধ্যেমে কাগজপত্র বানিয়ে নিচ্ছেন।

প্রশ্ন হলো কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ কী? ইসলাম ধর্মে এটা ‘মুথা বিয়ে’ নামে পরিচিত। যদি কোন দু’জন মনে করেন যে, তাদের নির্দিষ্ট কোন প্রয়োজনবোধে অথবা উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে কিছুদিনের জন্য একসঙ্গে বসবাস প্রয়োজন, তবে তারা চুক্তি বিয়ে করতে পারেন। কোরানের কোথাও এ ব্যাপারে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই, এমনকি শেষ নবীও এব্যাপারে নিষেধ করেননি, শিয়াদেরও এ বিয়ের প্রবণতা আছে। তবে বাংলাদেশে এটা অপ্রচলিত।

ইউরোপে সহজ ভাষায় ‘কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ’ হল টাকার বিনিময়ে বিয়ে। অর্থাৎ মেয়ে থাকবে মেয়ের জায়গায়, ছেলে থাকবে ছেলের জায়গায়। মাঝখানে দালালপক্ষ উকিলের ম্যাধ্যমে টাকার বিনিময়ে কাগজপত্রগুলো বানিয়ে দেয়।

কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ বা চুক্তিভিত্তিক বিয়ে করতে কত টাকা লাগে? সাইপ্রাসে যদি কেউ কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ করতে চান তাহলে সে ইউরোপের মাত্র দুইটা দেশের মেয়েদেরকেই বিয়ে করতে পারে। কারণ, এই দুইটা দেশ ছাড়া ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোর মেয়েরা এসব কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ সহজে করে না, আর করলেও তাদের অনেক টাকার চাহিদা পূরণ করতে হয়।

কিন্তু কম খরচে রোমানিয়া ও বুলগেরিয়ার নারীদের সহজে চুক্তিভিত্তিক বিয়ে করা যায়। তাদের বিয়ে করতে হলে আজ থেকে দু’বছর আগেও বাংলাদেশি টাকায় চার-পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে সবকিছু ম্যানেজ করা যেতো। কিন্তু এখন চুক্তিভিত্তিক বিয়ের আইন অনেকটা কড়াকড়ি হওয়ায় প্রায় আট-দশ লাখ টাকার উপরে চলে যায়। এখন মূল বিষয় হচ্ছে, এই আট-দশ লাখ টাকা খরচ করেও কি আপনি সফল হচ্ছেন! নাকি নিজের সর্বস্ব হারিয়ে ইউরোপের কাগজপত্র পাওয়ার স্বপ্ন চুরমার হয়ে যাচ্ছে!

চুক্তিভিত্তিক বিয়ের নামে এখন প্রতারণার শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশিসহ শত শত এশিয়ান প্রবাসী। বিয়ে করার জন্য দালালের সঙ্গে চুক্তি হয় একরকম, কিন্তু শেষের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রথমে দালালের সঙ্গে বিয়ে করা থেকে শুরু করে কাগজপত্র পাওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশিরা প্রায় ৮-১০ লাখ টাকার চুক্তি করেন।

বিয়ের পর চুক্তি অনুযায়ী মেয়েকে রোমানিয়া বা বুলগেরিয়া থেকে নিয়ে আসতে হয়। মেয়েকে নিয়ে আসার পর থেকে শুরু হয় খরচের অত্যাচার। এবার তার যাবতীয় খরচ বহন করতে হয়। দালালের সঙ্গে চুক্তির বাইরেও তাকে টাকা দিয়ে খুশি রাখতে হয়, যাতে ওই মেয়ে কোন বাটপারি না করে!

কিন্তু তাতেও কি লাভ হয়! মেয়ে আপনার উপর এমন অর্থনৈতিক অত্যাচার চালাবে যেন আপনি একজন জমিদার আর সে আপনার রাজরাণী! যেখানে এক ইউরো লাগে সেখানে আপনাকে দিয়ে সে দশ ইউরো খরচ করাবে। এভাবে যেতে যেতে আপনার যখন প্রায় পাঁচ-ছয় লাখ টাকা খরচ হয়ে যাবে এবার শুরু হয় ব্ল্যাকমেইল।

সে আপনার চুক্তির বাইরে আরো টাকা চাইবে। আপনি দিতে বাধ্য, কারণ না দিলে সোনার পাখি আপনাকে ছেড়ে চলে যাবে। আর পাখি চলে গেলেই আপনার সবকিছু শেষ। এতদিন যে টাকা খরচ করলেন তার পুরোটাই লোকসান। চুক্তির বউ যদি বেঈমানি করে তাহলে ইউরোপের কাগজ পাওয়ার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যাবে। তখন মনে পড়ে যেতে পারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা, ‘স্ত্রীর সঙ্গে বীরত্ব করে লাভ কি? আঘাত করলেও কষ্ট, আঘাত পেলেও কষ্ট।’

আবার যার ভাগ্য ভালো সে এমন পরিস্থিতিতে পড়ে না। এটা নির্ভর করে সম্পূর্ণ মেয়ের উপর। এখানে দালালেরও কোন হাত নেই। মেয়ে বেঈমানি করলে দালালও বিপদে পড়ে যায়। তবে সবাই যে কাগজ পায় না তাও না। অনেকের সবকিছু সুন্দরমতো হয়ে যায়।

তাই প্রবাসী বাংলাদেশি যারা দালালদের প্রলোভনে পড়ে সাইপ্রাস বা ইউরোপের নন-শেনজেন দেশগুলোতে আসার চিন্তা করছেন, এসব মিথ্যা প্রলোভনে ভুলেও কেউ পা দেবেন না।

লিখেছেন: মাহাফুজুল হক চৌধুরী, সাইপ্রাস থেকে, সৌজন্যে: বিডিনিউজ