Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

চিকিৎসার নামে গলাকাটা বাণিজ্য

hospitalরাজধানীসহ সারাদেশে বেসরকারি ক্লিনিক, ডায়াগনোস্টিক সেন্টার ও প্যাথলজিতে চিকিৎসার নামে চলছে গলাকাটা বাণিজ্য। রোগীরা প্রতিনিয়ত প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। সরকারি স্বাস্থ্যনীতির তোয়াক্কা না করে এসব প্রতিষ্ঠান চিকিৎসার নামে রোগীদের জীবন বিপন্ন করে তুলেছে। তারা এতটাই ক্ষমতাধর যে, জেল-জরিমানা দিয়েও নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। চলছে দুর্দণ্ড প্রতাপে। ৬০ টাকার ওষুধ ৫শ’ টাকায় বিক্রি, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই রক্ত বিক্রি, সহকারীদের দিয়ে ডাক্তারের স্বাক্ষর, একজন সহকারী কর্তৃক পাঁচ জন চিকিৎসকরে স্বাক্ষর দেওয়া- এমন অনেক অপকর্মের প্রমাণ পেয়ে শাস্তি দিয়েছে মোবাইল কোর্ট। কিন্তু কিছুতেই তাদের দমানো না যাওয়ায় অনেকে ক্রসফায়ার দিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণে আনার পরামর্শ দিয়েছেন। কোন কোন নামীদামী বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের চিত্র একই। মোবাইল কোর্ট ওই সব বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযান চালিয়ে প্রমাণ পেয়েছে এবং ওই সব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জেল-জরিমানাও করেছে।

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম জানান, চিকিৎসার নামে এ ধরনের বাণিজ্যকারী প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলসহ কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

chardike-ad

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বেসরকারি ক্লিনিক, ডায়াগনোস্টিক সেন্টার ও প্যাথলজিতে চলে শুধু টাকা আদায়ের গলাকাটা বাণিজ্য। রোগীর জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণেও সেবার নামে অপারেশন থিয়েটারে চলে অমানবিক গোপন বাণিজ্য। টাকা ছাড়া তারা কিছুই বোঝেন না। এছাড়া ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা থেকে কমিশন বাণিজ্য, রোগী ভর্তি, নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের ওষুধ প্রেসক্রাইব, অপারেশন নিশ্চিত করা, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে লাইফ সাপোর্টে পাঠানো, কেবিনে রোগী ধরে রাখাসহ লাশ হস্তান্তর পর্যায়ের নানা ধাপে কমিশন লেনদেন হয়। আর রোগীকে দিতে হয় বড় অঙ্কের বাড়তি টাকা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কঠোর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে এসব বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো অবাধে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

এদিকে সরকারি অনুমোদন ছাড়াই দেশজুড়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টার, প্যাথলজি ব্যবসার ছড়াছড়ি। সাইনবোর্ডসর্বস্ব এসব প্রতিষ্ঠানে হাতুড়ে টেকনিশিয়ান দিয়েই চলে রোগ নির্ণয়ের সব পরীক্ষা। তারা মনগড়া রিপোর্ট তৈরি করে অহরহ ঠকাচ্ছে নিরীহ মানুষকে। একই রোগের পরীক্ষায় একেকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে একেক রকম রিপোর্ট পাওয়ার অসংখ্য নজির রয়েছে। পুরুষের পরীক্ষা রিপোর্টে তুলে ধরা হয় মেয়েলি রোগের বিবরণ। আবার উল্টো চিত্রও আছে। এসব রিপোর্ট নিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনরা চরম বিভ্রান্তিতে পড়েন। অভিযোগ তুলেও এসবের প্রতিকার মিলছে না।

ডাক্তাররা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সরবরাহকৃত স্লিপে ট্রিক মার্ক দিয়ে দেন কোন কোন টেস্ট করাতে হবে। রোগী নিজের পছন্দের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সেই টেস্ট করালে ডাক্তার সে রিপোর্ট গ্রহণ করেন না। ডাক্তার তার নির্ধারিত সেন্টার থেকে আবার একই টেস্ট করিয়ে আনতে চাপ দেন। ওই সেন্টার তাকে কমিশন দেয়। কমিশন নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল চিকিৎসা মেলে। পরীক্ষার ফি বাবদ ইচ্ছামাফিক টাকা-পয়সা আদায় করা হচ্ছে। একই ধরনের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার জন্য একেক প্রতিষ্ঠানে ধার্য আছে একেক ধরনের ফি। নিয়ম আছে রেট চার্ট প্রতিষ্ঠানের দর্শনীয় স্থানে লাগিয়ে রাখার। কেউ সে নিয়ম মানছে না। বেশি টাকা দিয়ে টেস্ট করিয়েও সঠিক রোগ নির্ণয়ের নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা।

রোগী আকর্ষণের জন্য ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোয় বিশেষজ্ঞদের তালিকার সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখা হলেও তাদের অধিকাংশকেই পাওয়া যায় না। নাম ব্যবহার বাবদ মাসিক ফি দেওয়া হয় ওইসব ডাক্তারকে। ডাক্তাররা এখন সামান্য জ্বর, ঠাণ্ডা, কাশির জন্যও ডজন ডজন পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা লিখে দিচ্ছেন। প্রয়োজন না থাকলেও হাসপাতালে ভর্তি পর্যন্ত করিয়ে ছাড়েন তারা। সুযোগ থাকলে অপারেশনের মুখোমুখি করিয়ে লাইফ সাপোর্টের পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া হয় রোগীকে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ডাক্তারের জন্য রয়েছে লোভনীয় কমিশন। সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী বাগিয়ে নিয়ে অভিজাত হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারলেই শতকরা ৫০ ভাগ ‘ভর্তি ফি’ সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের পকেটে যায়। এ কমিশন বাণিজ্যের প্রভাবে চিকিৎসা ব্যয় বহুগুণ বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে গরিব মানুষ চিকিৎসা নিতে গিয়ে আরও নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। অপারেশন, ক্যান্সার রোগীদের কেমোথেরাপি, অর্থোপেডিক রোগীদের ফিজিওথেরাপি, কিডনি রোগীদের ডায়ালিসিসের ক্ষেত্রেও আলাদা কমিশন নির্ধারণ করা আছে। এমনকি ওষুধ লেখার জন্য আগে থেকেই ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে কমিশনের নামে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা নেন অনেক চিকিৎসক। প্রতিষ্ঠানগুলোতে নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, নামমাত্র ব্লাড ল্যাব, প্যাথলজি ল্যাব, মানসম্পন্ন ওটি রুম না থাকা, পর্যাপ্ত চিকিৎসক না থাকা, লোকবল না থাকা, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকা, মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধের ব্যবহারসহ রোগীদের সু-চিকিৎসার নামে এক ধরনের প্রতারণা করা হচ্ছে। বার বার ভ্রাম্যমাণ আদালতের জরিমানার শিকার হয়েও আক্কেল হয়নি এসব প্রতিষ্ঠানের কর্তা ব্যক্তিদের।

গত এক বছরে ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, চাপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ৪০০ বেসরকারি ক্লিনিক, ডায়াগনোস্টিক সেন্টার ও প্যাথলজিতে র‍্যাবের মোবাইল কোর্ট অভিযান চালিয়ে নানা অনিয়মের প্রমাণ পেয়ে বিভিন্ন শাস্তি দিয়েছে। গতকাল সোমবার একটি নামীদামী বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মিরপুর শাখাসহ তিনটি স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে ১৩ লাখ টাকা জরিমানা করেছে র‍্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। অন্য দুটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে- রিজেন্ট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং মেডিক হেলথ ডায়াগনস্টিক সেন্টার। র‍্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্টেট সারোয়ার আলম জানান, সোমবার দুপুর ১টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এই তিন প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালান তারা। মিরপুর ১০ নম্বরে পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযান চালিয়ে দেখা যায়, সেখানে প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার জন্য যে রাসায়নিক উপাদান ব্যাবহার করা হয় তার অধিকাংশই মেয়াদোত্তীর্ণ। এছাড়া পরীক্ষার খালি ফরম আগে থেকেই স্বাক্ষর করা অবস্থায় পাওয়া যায়। এছাড়া কর্মচারীরাই পরীক্ষার প্রতিবেদন ফরমে স্বাক্ষর করেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। তিনজন ডাক্তারের স্বাক্ষর করেছেন একজন চিকিৎসক। এসব অপরাধের জন্য এই প্রতিষ্ঠানকে ছয় লাখ টাকা জরিমানা করা হয় বলে জানান তিনি।

এরপর মিরপুর ১২ নম্বরে রিজেন্ট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযান চালানো হয় জানিয়ে সারোয়ার আলম বলেন, এই প্রতিষ্ঠানে বেশ কয়েকটি ত্রুটি ধরা পড়ে। রক্ত পরিসঞ্চালনে তারা নিয়ম মানছে না। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনুমতিও তাদের নেই। আবার রক্ত পরিসঞ্চালনের ক্ষেত্রে যে সব রেকর্ড রাখার কথা তা নেই। কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই রক্ত বেচাকেনা করা হচ্ছে। অথচ রক্ত কেনাবেচার আগে এইচবিএস এজি, এইচআইভি, বিডিআরএলসহ সংক্রমণ ব্যাধি পরীক্ষা করাতে হয়। এসব পরীক্ষা ছাড়াই তারা মাসের পর মাস অবৈধভাবে রক্ত বেচাকেনা করে আসছে। এই প্রতিষ্ঠানের ওষুধ বিক্রি কেন্দ্রে ৬০ টাকার ওষুধ ৫০০ টাকায় বিক্রি করার প্রমাণ মিলেছে। আবার অনুমোদনহীন ভারতীয় ওষুধও পাওয়া গেছে। তাদের অপারেশন থিয়েটারে রান্না করার ব্যবস্থা রয়েছে। এই হাসপাতালকেও ছয় লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে বলে জানান তিনি। বিকালে মিরপুর ১২ নম্বরে মেডিক হেলথ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযানে যায় র‍্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। সেখানে পরীক্ষা না করে প্রতিবেদন দেওয়া, খালি ফরমে স্বাক্ষর রাখাসহ বেশ কিছু ত্রুটি পাওয়া গেছে। এজন্য এই প্রতিষ্ঠানকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। জরিমানার সব টাকা নগদ আদায় করা হয়েছে বলে জানান সারোয়ার আলম। র‍্যাবের মোবাইল কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম জানান, জেল-জরিমানা দিয়েও তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এরা চিকিৎসার নামে মানুষ মেরে ফেলে। এদের নিয়ন্ত্রণে ভিন্ন কিছু চিন্তা করার সময় এসেছে।

এদিকে দেশের সকল প্রাইভেট ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালগুলোর সেবার মান বৃদ্ধি, সঠিক রোগ নির্ণয় নিশ্চিত করাসহ বিভিন্ন ধরনের অপচিকিত্সা থেকে ভুক্তভোগী রোগীদের রক্ষায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বয়ে একটি ‘ভিজিলেন্স টিম’ গঠন করা হয়েছে। এই টিম দেশের সকল প্রাইভেট ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালগুলো পরিদর্শন করবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ইতোমধ্যে বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ও সকল জেলার সিভিল সার্জনদের এই ব্যাপারে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তারা যেন অবিলম্বে ভিজিলেন্স টিম গঠন করে নিজ নিজ এলাকার সকল প্রাইভেট ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালগুলোতে নিয়মিত পরিদর্শন কার্যক্রম সচল রাখে। কিন্তু কোন কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। ভিজিলেন্স টিম নামে আছে, কাজে নেই। ইত্তেফাক