Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

সিন্ডিকেটের কবলে শ্রমবাজার, নিয়ন্ত্রণহীন অভিবাসন ব্যয়

bangladeshi-workerসরকারি হিসাবে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর খরচ সাড়ে ৩৭ হাজার টাকা। বাস্তবে দিতে হচ্ছে তিন লাখ টাকা। মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো নিয়ন্ত্রণ করছে ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সির চক্র। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, এ কারণে বৈধ এজেন্সিগুলো বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে অভিবাসন ব্যয়ও কমছে না।

মালয়েশিয়া বর্তমানে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় গেছেন ৯৯ হাজার ৭৮৭ জন। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই মালয়েশিয়ায় গেছেন ৩৮ হাজার ৮৬৫ জন।

chardike-ad

সিন্ডিকেটের কবলে শ্রমবাজার: বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির অন্যতম বাজার মালয়েশিয়া ২০০৯ সালে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দেয়। ২০১২ সালে সরকারিভাবে কর্মী পাঠাতে দুই দেশ চুক্তি করে। এরপর আড়াই বছরে আট হাজার কর্মী যান। তবে সাগরপথে অবৈধভাবে বিপুলসংখ্যক লোক মালয়েশিয়ায় যান। ২০১৫ সালের মে মাসে থাইল্যান্ডে এবং পরে মালয়েশিয়ায় গণকবর পাওয়ার পর বিশ্বজুড়ে হইচই হলে আবারও বাংলাদেশ থেকে বেসরকারিভাবে কর্মী নেওয়ার প্রস্তাব দেয় মালয়েশিয়া।

২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুই দেশের মধ্যে জি টু জি প্লাস (সরকারি-বেসরকারি) সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ার ১২ ঘণ্টার মধ্যেই মালয়েশিয়া বলে, এই মুহূর্তে তারা আর কর্মী নেবে না। এতে কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া ঝুলে যায়। এরপর ২০১৬ সালের নভেম্বরে মালয়েশিয়ার মন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে আসে। ওই বৈঠকে আবার কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের এক বছর পর ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে কর্মী পাঠানো শুরু হয়।

জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সদস্য, এমন অন্তত পাঁচটি এজেন্সির মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জি টু জি প্লাস চুক্তির নিয়ম অনুযায়ী, কর্মী নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়া হয় অনলাইনে। এ কাজের জন্য সিনারফ্ল্যাক্স নামে একটি কোম্পানিকে নিয়োগ দেয় দেশটির সরকার। মালয়েশিয়ান কোম্পানি সিনারফ্ল্যাক্সের সঙ্গে বর্তমানে কর্মী পাঠানো ১০টি এজেন্সি সিন্ডিকেট করে। তাদের দাবি, সিন্ডিকেটের ফলে একদিকে অন্য রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো কর্মী পাঠানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগে শ্রমিকদের কাছ থেকে বেশি টাকা নেওয়া হচ্ছে।

বর্তমানে মালয়েশিয়ায় লোক পাঠাতে পারছে যে ১০টি এজেন্সি, সেগুলো হলো ক্যারিয়ার ওভারসিজ, এইচএসএমটি হিউম্যান রিসোর্স, সানজারি ইন্টারন্যাশনাল, রাব্বী ইন্টারন্যাশনাল, প্যাসেজ অ্যাসোসিয়েটস, ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল, ইউনিক ইস্টার্ন প্রাইভেট লিমিটেড, আমিন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস, প্রান্তিক ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরিজম ও আল ইসলাম ওভারসিজ। এই ১০ এজেন্সির মধ্যে ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের মালিক বায়রার বর্তমান কমিটির মহাসচিব মো. রুহুল আমিন। রাব্বী ইন্টারন্যাশনালের মালিক বায়রার ওয়েলফেয়ার সম্পাদক মোহাম্মদ বশির। প্রান্তিক ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরিজমের মালিক সাবেক কমিটির সভাপতি মো. গোলাম মোস্তফা। এ ছাড়া এসব এজেন্সির সঙ্গে বায়রার প্রভাবশালী একাধিক নেতা জড়িত বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

১০ এজেন্সির অন্যতম প্রান্তিক ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী ও বায়রার সাবেক সভাপতি মো. গোলাম মোস্তফা বলেন, বাংলাদেশের সহস্র এজেন্সি মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি করতে গিয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়ায় শৃঙ্খলা আনতেই নির্দিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সির বাইরে অন্য কাউকে শ্রমিক পাঠানোর সুযোগ দিতে চায় না মালয়েশিয়ার সরকার। প্রবাসীকল্যাণ সচিব নমিতা হালদার বলেন, ‘বাংলাদেশ অংশে সিন্ডিকেটের বিষয়ে মন্তব্য করতে চাই না। আমরা ৭৫০টির বেশি বৈধ এজেন্সির তালিকা পাঠিয়েছিলাম। মালয়েশিয়া সরকার এই ১০ এজেন্সিকে অনুমতি দিয়েছে।’

নিয়ন্ত্রণহীন অভিবাসন ব্যয়: ২০১৬ সালে জি টু জি প্লাস সমঝোতায় মালয়েশিয়ায় কর্মী যাওয়ার খরচ নির্ধারণ করা হয় সাড়ে ৩৭ হাজার টাকা। ২০১৭ সালের জুন মাসে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় এক অফিস আদেশের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে পুরুষ কর্মীদের অভিবাসন ব্যয় নির্ধারণ করে দেয়। ওই অফিস আদেশে বলা হয়, জি টু জি প্লাস প্রক্রিয়ায় মালয়েশিয়ায় নির্মাণ বা কারখানাশ্রমিকদের জন্য অভিবাসন ব্যয় ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা এবং কৃষিশ্রমিকের জন্য ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা নির্ধারণের জন্য জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভায় মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত করা হবে। মন্ত্রণালয় ও বায়রা সূত্রে জানা যায়, জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভায় মালয়েশিয়ায় পুরুষ শ্রমিকদের অভিবাসন ব্যয় বাড়ানোর বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। ফলে সরকারের হিসাবে মালয়েশিয়া শ্রমিক পাঠানোর নির্ধারিত খরচ সাড়ে ৩৭ হাজার টাকা রয়েছে।

তবে বাস্তব চিত্র ভিন্ন। বায়রা, মন্ত্রণালয়, জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর কর্মকর্তা এবং মালয়েশিয়া যাওয়া কর্মীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শ্রমিকদের সরকার নির্ধারিত টাকার সাত থেকে নয় গুণ বেশি টাকা দিতে হচ্ছে।

সম্প্রতি মালয়েশিয়া গিয়েছেন, এমন চারজন কর্মীর পরিবারের সদস্যের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেছেন, বাস্তবে ২ লাখ ৮০ থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা লাগছে। অথচ সরকারি নথিতে সাড়ে ৩৭ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে বলে দেখানো হচ্ছে।

সার্বিক বিষয়ে অভিবাসনবিষয়ক গবেষণা সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার সবার জন্য উন্মুক্ত করতে এবং অভিবাসন ব্যয় কমাতে সরকারের সদিচ্ছা জরুরি।

সৌজন্যে- প্রথম আলো