Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

মোহাম্মদ আল আজিম, দক্ষিণ কোরিয়া

chardike-ad

প্রবাসীদের বাস্তবতার সাথে স্বপ্নের যোগসাজশ খুব একটা মেলেনা, সেটা যদি হয় মাতৃভূমি থেকে যোজন যোজন দূরত্বে অচেনা সব মানুষদের ভিড়ে তবে হিসাবটা আরেকটু কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়ে। তবুও সময় ও পরিস্থিতিকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে কাকতালীয়ভাবে অল্প সংখ্যক কিছু উদ্যমী, সাহসিকতায় ভরপুর মানুষ দীরদর্পে এগিয়ে যাচ্ছে অচেনা শহরে অচেনা সব মানুষদের ভীড়ে, প্রবাসের মাটিতে এক টুকরো বাংলাদেশ হয়ে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে কষ্টার্জিত উপার্জনে দেশের মাটিতে পরিবার ও দেশের নীতিনির্ধারকরা দিব্যি আরাম-আয়েশে দিনযাপন করছে উনারা কতটা খোঁজ খবর রাখে এই সব প্রবাসীদের?

রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা সবাই বলে প্রবাসীরা নাকি দেশের সূর্য সন্তান, প্রশ্ন হলো কতটুকু খোঁজ রাখেন, এই সূর্য সন্তানদের? কেমন কাটে সেইসব মানুষ গুলোর দিন? উওরটা বোধহয় না’ই হবে! তথচ আপনার একেকটা সকাল’কে রঙ্গিন করে তুলতে এইসব মানুষ গুলোর একেকটা দিনের সলিলসমাধি হয় এই দূর প্রবাসে।

বলছি এই মহাবিশ্বের অন্যতম আধুনিক সভ্যতার দেশ দক্ষিণ কোরিয়ায় বসবাসরত এক উদ্যমী, সাহসী ও হার না মানা এক প্রবাসীর অবহেলিত এক নিষিদ্ধ গল্প। এই গল্পের ছদ্মনাম সুখচান মধ্যেবিত্তের ঘরে পিতলের চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নেওয়া একটি ছেলে। সুখচান বড় হতে থাকে মা-বাবার আদর আর পরিজনদের ভালোবাসায়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে সুখচানের স্বপ্নটাও বড় হতে শুরু করে, সুখচানের স্বপ্ন ছিলো পাখির মতো উড়ে উড়ে দূরের ঐ অস্পর্শী আকাশটা ছুঁয়ে দেওয়ার। স্কুল, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে যখনই বাস্তবতায় পা রাখতে শুরু করলো স্বপ্ন গুলোও মরিচিকার মতো হাঁরিয়ে যেতে শুরু করলো!

অসহায় মধ্যবিত্ত পিতার চাপিয়ে দেওয়া দায়িত্বে, ঘরে বিয়ে দেওয়ার মত একটি বোন। চোখের সামনে যখন হাজার বছরের জমে থাকা রঙ্গিন স্বপ্ন গুলো ধূসর হতে শুরু করলো তখনও পোকাঁয় কাঁটা ও দূর্বল রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে দাঁড়িয়ে থাকা ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তে অর্জিত ৫৬ হাজার বর্গ কিলোমিটারের সোনার বাংলায় সুখচানের কোন গতি মেলেনি!

বেকারত্ব, ডিপ্রেশন, পরিবারের চাপ আর সামাজিক ভাবে অবমর্যাদায় ভুগতে থাকে সুখচান। কাকতালীয়ভাবে স্বপ্নের আলোকবর্তিকা হয়ে ধরা দেয় ইপিএস (এমপ্লয়মেন্ট পারমিট সিস্টেম) নামক একটি স্বপ্ন। শত কাঠখড় আর নিজের যোগ্যতার সর্বোচ্চটুকু উজাড় করে দিয়ে অবশেষে প্রবাস নামক নিষিদ্ধ গল্পে তাঁরও নাম উঠলো। শুরু হলো ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ে মরে যাওয়া স্বপ্ন গুলোর নতুন করে জন্ম দেওয়া এবং উদ্দেশ্যহীন পথচলার।

একটি সময়ের স্বপ্নবাজ সুখচান এখন আর স্বপ্ন দেখতে পছন্দ করেনা,অন্যকাউকে স্বপ্ন দেখাতেই বেশ সাচ্ছন্দ্য তাঁর। সুখচানের এইবার সত্যিই সুখ ধরা দিয়েছে। কর্মময় জীবনের দিনের শেষে জননীর কণ্ঠে ভেসে আসা “ভালো আছি” শব্দটাই তাঁর সারাদিনের শ্রম ঘামের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি। সুখচান এখন বিশ্বাস করতে শিখে গেছে নিজের আত্নত্যাগে যদি প্রিয়সব মানুষদের মুখের হাঁসি দিনশেষে ও অমলিন থাকে এটাই তাঁর কাছে প্রকৃত সুখ। কিন্তু কর্মচঞ্চল এই শহরেও দিনের শেষে নিকষকালো অন্ধকার নেমে আসে ‘ নেমে আসে নিস্তব্ধতা। ঘোর অন্ধকার গ্রাস করে ফেলে এই শহরের সব অলিগলি,সোডিয়াম বাতিরাও প্রান ফিরে পায়, হঠাৎ জেঁগে ওঠা ঝিঁঝিঁপোকার শব্দে মুখরিত হয়ে উঠে শহর। তখন হয়তো ওপাশে জানালার গ্রীল ছেপে কিংবা সোডিয়ামের আলোতে দূরের অন্ধকার আকাশে ধ্রুবতারাকে সাক্ষী রেখে নিঃশব্দে কেঁদে যায় কোন এক বিষন্ন তরুন! প্রবাসী সুখচানের এ কাঁন্না নিরর্থক অর্থহীন, ক্ষানিক বাদেই তো তাঁকে নেমে পড়তে হবে নতুন উদ্যমে।

সুখচান থেমে গেলে তো থেমে যাবে একটা পরিবার, ভেঙ্গে যাবে কত প্রিয়জনের তাঁকে ঘিরে লালিত স্বপ্ন। তাইতো এই সুখচান কখনো না থেমে নিরন্তর পথ চলতে পছন্দ করে। ফেলে আসা স্বপ্ন, প্রিয়জন, পরিবার যতই ওদের ব্যথার কারন হোক না কেন দিনশেষে ওরাই ‘তো আবার আমাদের ভালো থাকার কারণ।

দক্ষিণ কোরিয়াতে সুখচানের ২ বছর শেষ হলো সবে মাত্র, এই দুইবছরে প্রায় ২০ লক্ষ টাকা দেশে পাঠিয়েছেন পরিবারের কাছে, একটি মাত্র বোন তাই সুখচান অনেক বেশি পরিমাণ খরচ করে খুব ভালো ঘরে বিয়েও দিয়েছেন।

শুধু মাত্র একটি প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়ায় সুখচান অনেক বড় অপরাধ করে বসে পরিবারের সাথে! নতুন বছরে নিজের অর্থ কত টাকা জমা হয়েছে একাউন্টে এই প্রশ্ন করাটি ছিলো সুখচানের মহা অপরাধ। সুখচান খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারে তার কষ্ট করে উপার্জন করা অর্থ সব শেষ,কেন শেষ? কি হলো এতো টাকা এই উওর আজও মিলেনি পরিবারের কাছে থেকে। এখন সুখচানের দিনরাত্রি বোবা কান্না করা ছাড়া আর উপায় নেই, কোম্পানির সহকর্মীরা ছাড়া আর কেউ নেই তার পাশে, এখন সহকর্মীরা সুখচানকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে, শত কষ্ট দুঃখ কেউ না বুঝলেও প্রবাসীরা একজন প্রবাসীর কষ্ট বুঝে।

সুখচান এখনো স্বপ্ন দেখে সে ঘুরে দাঁড়াবে একসময়, এখনো তার হতে ২ বছর ১০ মাস রয়েছে, হয়তো একদিন সত্যি সত্যি সুখচানের সুখ আসবে। ট্রেন বদলায়,প্লাটফর্ম বদলায়,স্টেশনের পর স্টেশন আসে কিন্তু সুখচানের মত মানুষ গুলির গন্তব্যে থাকে অবিচল, শত বিপর্যয় এদের রুখে দেওয়ার কারণ হতে পারেনা। হাজারও দুঃখ কষ্টের মাঝে বেলা শুরু আর বেলা শেষে বলতে হয়,ভালো থাকুক প্রিয়জন, ভালো থাকুক পরিবার।