Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

শাহজালাল বিমানবন্দরে যাত্রী হয়রানি চরমে

sahjalalদেখে মনেই হয় না এটা আন্তর্জাতিক কোনো বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন ডেস্ক। মনে হয় যেন কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট সংগ্রহের দৃশ্য। এর চেয়ে বাস টার্মিনালের কাউন্টারের লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট সংগ্রহ করা অনেক সহজ ও স্বস্তিদায়ক। প্রতিনিয়তই এমন দৃশ্যের দেখা মেলে দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর শাহজালালে। যাত্রীদের সাথে অসদাচরণ, হয়রানি, ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ নানা অজুহাতে টাকা আদায় করা যেন বিমানবন্দরের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, মন্ত্রিসভা থেকে শুরু করে বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার বিভাগীয় বৈঠকেও যাত্রী হয়রানি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। সিদ্ধান্ত হচ্ছে হয়রানি বন্ধের। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। যাত্রী হয়রানি থামানো যাচ্ছে না কোনোভাবেই। উল্টো দিন দিন হয়রানির মাত্রা বেড়েই চলেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশের শ্রমবাজারে সুনাম ও দক্ষতার সাথে হাড়ভাঙা পরিশ্রমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে আসছেন প্রবাসীরা। সেখানে ইমিগ্রেশনের হাতে তাদের নিয়মিত হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। এ বিষয়টি দেখার জন্য কেউ নেই।

chardike-ad

ভুক্তভোগীরা জানান, গত ২০ বছরে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রী ও বিমান ওঠা-নামার সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি যাত্রীসেবার মান। আগে লাগেজ পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিমানবন্দরে যাত্রীদের অপেক্ষা করতে হতো। এখনো সেই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি মেলেনি যাত্রীদের। এখন নতুন করে যাত্রীদের ভোগান্তি আরো বেড়েছে। বিদেশগামী যাত্রীদের বিমানবন্দরের দোতলায় প্রবেশপথে দীর্ঘ সময় লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। নিরাপত্তা তল্লাশির নামে যাত্রীদের এ ভোগান্তির মুখে পড়তে হচ্ছে প্রতিদিন।

হাজারো অভিযোগ। মন্ত্রীপর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। সিভিল এভিয়েশনের কড়া তদারকি। প্রশাসনিক নজরদারিসহ গোয়েন্দা বিভাগগুলোর নানামুখী তৎপরতায়। তারপরও হজরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রী হয়রানি বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। যাত্রীদের হয়রানিমুক্ত রাখা যাদের দায়িত্ব উল্টো তারাই হয়রানির কাজে মেতে উঠেছেন। বিমানবন্দরে প্রবেশপথের মোড় থেকেই শুরু হয় যাত্রী হয়রানি। এরপর কনকর্স হল, মূল ভবন, ইমিগ্রেশন পুলিশ, কাস্টমস পোস্টসহ ঘাটে ঘাটে চলে হয়রানির মচ্ছব।

ভুক্তভোগী যাত্রীরা বলছেন, আগে দীর্ঘপথ জার্নি করে বিদেশ থেকে আসার পর লাগেজের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। এখন এর সাথে আরো নতুন উপসর্গ যুক্ত হয়েছে। গতকাল রোববার বিমানবন্দরের দোতলায় দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের সাথে কথা বলে এসব অভিযোগ পাওয়া যায়।

তারা বলছেন, শুধু লাগেজ পেতে এবং প্রবেশপথেই নয়, ইমিগ্রেশনেও যাত্রীদের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। কিছু কর্মকর্তার নির্দয় আচরণে সর্বস্তরের যাত্রীরা দিশাহারা। ব্যবসায়ী, রাজনীতিক ও শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিদেশে কর্মরত বৈধ শ্রমিকরাও চরম হয়রানি থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। স্বল্পশিক্ষিত যাত্রীদের নানা প্রশ্ন করে তাদের পাসপোর্ট আটকে রেখে টাকা আদায় যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করতে যাত্রীদের দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে।

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবদুল্লাহ আল ফারুক বলেন, বিমানবন্দরে লাগেজ হারানো বা লাগেজ কেটে মালামাল নিয়ে যাওয়ার ঘটনা এখন নেই বললেই চলে। যাত্রীদের হয়রানির অন্য যে বিষয়গুলো রয়েছে, সেগুলো আমরা গুরুত্বের সাথে নিয়ে কমিয়ে আনতে কাজ করছি। আমাদের মন্ত্রীও বিমানবন্দরের সার্বিক বিষয়গুলো অবহিত রয়েছেন। যাত্রীসেবার মান আরো কিভাবে বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে মন্ত্রী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন।

sahjalalশাহজালাল বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যাত্রীদের দাঁড়িয়ে থাকা এবং হয়রানির অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইমিগ্রেশন অন্য একটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে। এরপরও ইমিগ্রেশনের ক্ষেত্রে যাত্রীদের যেসব অভিযোগ রয়েছে তা আমরা সমাধানের কথা বলছি। ই-পাসপোর্ট চালু হলে ইমিগ্রেশনে বিলম্বিত হওয়াসহ অন্য অসুবিধাগুলো দ্রুত শেষ করা সম্ভব হবে। এক কথায় যাত্রীদের সার্বিক সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

যাত্রী আবুল কালামের সাথে গতকাল কথা হয় বিমানবন্দরে। তিনি দুই বছর পর গতকালই দেশে ফিরেছেন। আবুল কালাম বলেন, যাত্রী হয়রানি আর ভোগান্তির আরেক নাম শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। অত্যাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগেও বিমানবন্দরে একজন যাত্রীকে ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট থেকে দেড় ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ইমিগ্রেশনের জন্য। পৃথিবীর সব দেশের বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশেন সম্পন্ন করতে লাগে মাত্র এক থেকে দুই মিনিট। কিন্তু শাহজালালে ঘটছে তার উল্টোটা। তিনি আরো বলেন, বিমানবন্দরে প্রবেশ ও বের হওয়ার সব ক’টা গেটে আর্চওয়ে বসিয়ে নিরাপত্তারক্ষীর উপস্থিতিতে খুলে দিলে বিড়ম্বনা ও দীর্ঘ সময় অপেক্ষার ভোগান্তির অবসান হতো।

সিঙ্গাপুরের যাত্রী মামুন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, শুধু ইমিগ্রেশন নয়, লাগেজ পেতেও যাত্রীদের বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছে। কার পার্কিংয়ের অবস্থা আরো জটিল। বিমানবন্দরের সামনে ও কার পার্কিংয়ের স্থানে সারা দিন ট্যাক্সিক্যাব ও দালালদের যানবাহনে ভর্তি থাকে। ফলে যাত্রীদের যানবাহন নিয়েও নানা সমস্যা পোহাতে হচ্ছে। এটাই বিমানবন্দরের প্রতিদিনের চিত্র। এ নিয়ে যাত্রীদের অন্তহীন অভিযোগের পরও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।

সরেজমিন গত দুই দিন দেখা গেছে, শাহজালাল বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে শত শত যাত্রী দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রায় এক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করে বের হন মুন্সীগঞ্জের মামুন মিয়া এবং কেরানীগঞ্জের আবু তাহের। তারা জানান, মধ্যপ্রাচ্য থেকে শাহজালাল বিমানবন্দরে আসেন সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে। ইমিগ্রেশন শেষ করতে প্রায় ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট এবং লাগেজ পেতে আরো দেড় ঘণ্টা লাগে। কয়েকটি কাউন্টার ফাঁকা। কোনো ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা নেই। যে কয়টিতে কর্মকর্তারা আছেন, তারাও ততটা দক্ষ নন। আবার কেউ কেউ কাউন্টার ছেড়ে অন্য কাজে বের হয়ে যান। ইমিগ্রেশনে বিনা কারণে অবান্তর প্রশ্ন করে সময় ব্যয় করেন। এমনিতে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত। তারপর আবার নানা প্রশ্ন। সব কিছু পাসপোর্টেই আছে।

ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, কাউন্টার বাড়ানোর জায়গা নেই। মাত্র ২২টি ইমিগ্রেশন কাউন্টার। পিকআওয়ারে যখন ৫-৬টি বিমান স্বল্প সময়ের মধ্যে অবতরণ করে তখন যাত্রীদের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হয়।

গতকাল সিঙ্গাপুরগামী যাত্রী হায়দার (ডাকনাম) বলেন, ইমিগ্রেশন শেষ করতে তাকে প্রায় দেড় ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ইমিগ্রেশনে প্রবেশের আগে যে স্ক্যানার মেশিন রয়েছে, তা পার হয়ে যেতেও লাইনে দাঁড়াতে হয়। আর ইমিগ্রেশনের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা যেভাবে পাসপোর্ট নিয়ে ইমিগ্রেশন শেষ করেছেন দেখে মনে হয়েছে, গাবতলী বাস টার্মিনালে যারা বাসের টিকিট দেন তারাও ওই কর্মকর্তাদের থেকে স্মার্ট।

যাত্রীরা অভিযোগ করে জানান, বিমানবন্দরের বাইরের তুলনায় ভেতরের ঘাটে ঘাটে হয়রানি-ভোগান্তি কয়েক গুণ বেশি। যাত্রীসেবায় নিয়োজিত ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা, বিমানবন্দর পুলিশ ও কাস্টমসসহ বিভিন্ন বিভাগে দায়িত্বরতদের একটা বড় অংশই নিয়মিত যাত্রী হয়রানি করছেন। বিমানবন্দর অভ্যন্তরের অন্তত ১০টি ধাপে যাত্রীদের কাছ থেকে চাহিদামাফিক টাকা হাতানোর ধান্ধায় নানা রকম হয়রানি চালানো হয়। যাত্রীরা বিদেশ গমনের সময় বহির্গমন লাউঞ্জের প্রবেশমুখে কর্তব্যরত একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর খপ্পরে পড়েন। সেখানে টার্গেটকৃত যাত্রীদের পাসপোর্ট, টিকিট ইত্যাদি চেক করার সময় জানানো হয়, তার বিরুদ্ধে গোয়েন্দা রিপোর্ট রয়েছে। কাজেই তাকে দেশ ছেড়ে যেতে দেয়া সম্ভব নয়। বিমানে ওঠার চূড়ান্ত মুহূর্তে এমন অভিযোগের কথা শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। দিশাহারা যাত্রী কাকুতি-মিনতি করতে থাকেন। এ অবস্থায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃৃপক্ষকে ম্যানেজ করার নামে যাত্রীর কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

সৌজন্যে- দৈনিক ইনকিলাব