আগামী বছরের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে কিংবা ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ বা মাঝামাঝি নাগাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচন হতে পারে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে এ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলো। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির বলছে, এ সময়ে নির্বাচনে তাদের আপত্তি নেই। ডাকসুর যে সব সংস্কার প্রয়োজন, সেগুলো এই সময়ের মধ্যেই করা সম্ভব। অন্যদিকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের অভিমত, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে তাড়াহুড়া করে নির্বাচন করতে চাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
দীর্ঘ ২৮ বছর পর ডাকসুর সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৯ সালের মার্চ মাসে। ওই সংসদের মেয়াদ শেষ হয় ২০২০ সালের মার্চে। এরপর দীর্ঘ চার বছর ধরে বন্ধ রয়েছে নির্বাচন। বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীরা নির্বাচনের দাবি জানালেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর নতুন করে আবার ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি ওঠে। এরই মধ্যে গত রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ জানান, জানুয়ারির শেষে বা ফেব্রুয়ারিতে ডাকসু নির্বাচন হতে পারে।
নির্বাচন নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যেহেতু ডাকসু নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হয়েছে, তাই জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারির দিকেই নির্বাচন চায় তারা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু বাকের মজুমদার বলেন, ‘দীর্ঘদিন ডাকসুর নির্বাচিত প্রতিনিধি নেই। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এখন শিক্ষার্থীদের মধ্যে আবার সেই আকাঙ্ক্ষা আমরা দেখতে পাচ্ছি।’
আবু বাকের মজুমদার সোমবার গণমাধ্যমকে বলেন, ডাকসুর গণতান্ত্রিক সংস্কার প্রয়োজন, তবে সেটি এককেন্দ্রিক নয়। সংস্কারের জন্য ‘ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির প্রকৃতি ও ধরন’ বিষয়ক যে কমিটি আছে, তারা এটি নিয়ে কাজ করতে পারে। যৌক্তিক সংস্কার হতে হবে। তবে শিক্ষার্থীদের ডাকসুর প্রতি আগ্রহের কারণে জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন চায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি আবু সাদিক কায়েমও একই কথা বলেন। তিনি সোমবার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যে সময়সীমা দিয়েছে, এটাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। আমরা মনে করি, ডাকসুর যে সংস্কারগুলো প্রয়োজন, সেগুলো এই সময়ের মধ্যেই করা সম্ভব।’
তবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীনের বক্তব্য ভিন্ন। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ডাকসু নির্বাচনের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ফেব্রুয়ারির কথা বলছে। এমনটি হলে, তা হবে তাড়াহুড়া করে দেওয়া নির্বাচন। তিনি আরও বলেন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এমনটি করা হচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এই সময়সীমার কথা বলছে, আর শিবির এতে সায় দিচ্ছে।
নাছির উদ্দীন আরও বলেন, ডাকসু নির্বাচন নিয়ে আগে আলোচনা হওয়া উচিত। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা হতে পারে। কোন কোন বিষয় সংস্কার করা যায়, তা-ও আলোচনা হতে পারে; কিন্তু এসব বিষয়ে কারও সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনাই এখনো করা হয়নি।
এ বিষয়ে ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর মাত্র ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রসংগঠনগুলো বিচরণ শুরু করেছে। গত ১৫ বছর ছাত্রলীগের একক আধিপত্যের কারণে কোনো ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি। আমরা মনে করি, দ্রুততম সময়ের মধ্যেই নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন। তবে সংগঠনগুলো যেন ক্যাম্পাসে তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের বার্তা শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দিতে পারে, সেই সময়টুকু তাদের দেওয়া উচিত।’
এর আগে গত বুধবার রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে অন্যান্য ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, আগামী জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ অথবা ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে ঐকমত্যে পৌঁছেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ ক্রিয়াশীল ৩০টি ছাত্র সংগঠন।
ডাকসু নির্বাচন নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ফেব্রুয়ারির কথা উল্লেখ করার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কথা বলছে—ছাত্রদলের এমন ধারণা ঠিক নয় বলে জানান প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ। তিনি সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কে কী বলছে আমরা সেটি বিবেচনা করে ফেব্রুয়ারির কথা বলিনি। অনেক দিন ধরে ডাকসু নির্বাচন না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। তাই আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন দিতে চাই।’
বাম সংগঠনগুলো যা বলছে
ডাকসু নির্বাচনের বিষয়ে বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সাধারণ সম্পাদক জাবির আহমেদ জুবেল বলেন, নির্বাচন দেওয়ার আগে কিছু কাজ অবশ্যই করতে হবে। ডাকসুর গঠনতন্ত্রের ক্ষমতা কাঠামোয় পরিবর্তন আনতে হবে। এর গঠনতন্ত্র সংস্কার সবার মতামতের ভিত্তিতে করতে হবে। ডাকসু নির্বাচন হতে হবে অনুষদভিত্তিক। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি এই সংস্কারগুলো জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারির মধ্যেই শেষ করে ফেলতে পারে, তাহলে তাঁদের নির্বাচনে যেতে কোনো সমস্যা নেই।
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি মেঘমল্লার বসুও একই কথা বলেন। তিনি বলেন, ডাকসুর সংস্কার ছাড়া নির্বাচন করার কোনো মানে নেই। এবার সংস্কার না হলে আর কখনোই হবে না। সেই সংস্কার যদি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ফেব্রুয়ারির মধ্যে করতে পারে, তাহলে তাঁদের নির্বাচন যেতে সমস্যা নেই।
নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন সব শিক্ষার্থী ও ছাত্রসংগঠনের প্রত্যাশা—উল্লেখ করে বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সৈকত আরিফ গণমাধ্যমকে বলেন, ২০১৯ সালে সর্বশেষ অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনের আগেও ছাত্রসংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে ডাকসুর গঠনতন্ত্রের কিছু সংশোধনী প্রস্তাব করা হয়েছিল। ডাকসুর বর্তমান গঠনতন্ত্রে পদাধিকারবলে সভাপতি (উপাচার্য) সব মিটিংয়ের এজেন্ডা ঠিক করে দিতে পারেন, এমনকি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বহিষ্কারও করতে পারেন। এ ধরনের অগণতান্ত্রিক ধারাগুলোর সংস্কার অত্যন্ত জরুরি। ছাত্র সংসদের সভাপতিও অবশ্যই ছাত্র নেতৃত্বেরই হওয়া উচিত। সারা দেশে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এমন নির্বাচন বিবেচনা করা যেতে পারে।
সৈকত আরিফ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় যদি ফেব্রুয়ারির শেষেও নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয়, তারপরও সংস্কারের জন্য প্রায় দুই মাস সময় পাওয়া যাবে। এটিকে যথেষ্ট সময় বলেই মনে হয়। এসব সংস্কার করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে তাতে তাঁদের আপত্তি নেই। তবে ছাত্র সংসদ নির্বাচন যাতে প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময় হয়, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে নিশ্চিত করতে হবে।