বৃহস্পতিবার । ডিসেম্বর ১৮, ২০২৫
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৮:২৬ অপরাহ্ন
শেয়ার

নেপালের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জেন জি প্রজন্মের পছন্দের নেতা, কে এই বালেন


Balen

বালেন্দ্র শাহ। স্কেচ: নেপাল নিউজ

কঠোর কারফিউ, সেনাবাহিনী মোতায়েন আর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ- তবুও তরুণদের মাত্র দুদিনের বিক্ষোভেই পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি। হেলিকপ্টারে করে কাঠমান্ডু ছেড়েছেন তিনি। অন্তত ১৯ জনের প্রাণহানি আর কয়েকশ আহতের রক্তমাখা সেই আন্দোলন এখন এক নতুন নামের দিকে নেপালের রাজনীতিকে ঠেলে দিচ্ছে। তিনি- বালেন্দ্র শাহ।

‘জেন-জি প্রোটেস্ট’ নামে পরিচিত এই বিক্ষোভের নেতৃত্বে ছিলেন মূলত ২৮ বছরের নিচের তরুণরা। কেউ কেউ স্কুল ইউনিফর্ম পরা অবস্থাতেই সংসদের বাইরে হাজির হয়েছিল। পুলিশের গুলিতে যখন সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে, তখনই স্পষ্ট হয়ে ওঠে- এটি কেবল এক সরকারের পতন নয়, বরং প্রজন্মের পরিবর্তনের ডাক। আর সেই ডাকের প্রতীক হয়ে উঠছেন কাঠমান্ডুর মেয়র বালেন্দ্র, যিনি বালেন নামেই বেশি পরিচিত।

বালেন্দ্র শাহ বা বালেন কে?
বালেন শাহ জন্মগ্রহণ করেন ২৭ এপ্রিল ১৯৯০ সালে কাঠমান্ডুতে। তিনি একটি মৈথিল-মধেশি পরিবার থেকে এসেছেন। বালেন্দ্রের পড়াশোনা নেপালের ভিএস নিকেতন উচ্চমাধ্যমিক স্কুল থেকে। হিমালয়ান হোয়াইটহাউস ইন্টারন্যাশনাল কলেজ থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ভারতের কর্ণাটকের বিশ্বেশ্বরীয়া টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি (ভিটিইউ) থেকে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন বালেন্দ্র।

নেপালে হিপ-হপ ও র‍্যাপ সঙ্গীতের একজন পরিচিত মুখ তিনি। নিজের সুরারোপ করা গানেও দুর্নীতি এবং আর্থিক বৈষম্য নিয়ে বিদ্রুপ করেছেন বালেন্দ্র। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার বালেনের রাজনৈতিক উত্থান উল্কার গতিতে। র‌্যাপার হিসাবে পাওয়া জনপ্রিয়তাকে অস্ত্র করেই ভোটে দাঁড়ান তিনি। ২০২২ সালে কাঠমান্ডুর মেয়র নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয় পান। তিনিই শহরটির প্রথম স্বতন্ত্র মেয়র।

বালেন শাহ দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার জন্য খ্যাতি পেয়েছেন। রাস্তা পরিষ্কার করা, সরকারি স্কুল উন্নয়ন, কর ফাঁকি দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা- সবই তাঁকে নাগরিকদের কাছে নতুন ধাঁচের নেতা হিসেবে পরিচিত করেছে। বিতর্ক আছে, কিন্তু তাতে তাঁর জনপ্রিয়তা কমেনি, বরং বেড়েছে।

আন্দোলনের প্রতি সমর্থন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তরঙ্গ
একসময় র‌্যাপ গানের মঞ্চে জনপ্রিয় ছিলেন বালেন। রাজনৈতিক স্লোগান নয়, বরং ছন্দে ভরা গানের কথায় মুগ্ধ করতেন তরুণদের। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই মঞ্চ বদলেছে। আজ তিনি শুধু শিল্পী নন, বরং রাজনীতির অঙ্গনে এক আলোচিত চরিত্র। আন্দোলনের দিনগুলোতে তার সমর্থন আর দৃঢ় অবস্থান তাকে তরুণ প্রজন্মের কাছে নতুন আশা হিসেবে তুলে ধরেছে।

২৮ বছরের বয়সসীমার কারণে বিক্ষোভে সরাসরি অংশ নিতে পারেননি বালেন। কিন্তু তার ফেসবুক পোস্ট ঝড় তোলে তরুণদের মনে। তিনি লিখেছেন, “আমার পূর্ণ সহানুভূতি রয়েছে তরুণদের সঙ্গে এবং তাদের দাবি ন্যায্য।” একই সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের সতর্ক করেছেন যেন আন্দোলনকে ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বার্থে ব্যবহার না করা হয়। তার এই বক্তব্য আন্দোলনের ভিড়ে নতুন আস্থা জাগিয়েছে, যেন তরুণদের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছেন তিনি নিজেই।

এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অলি সরকারের পতনের পর আন্দোলনকারীদের অনেকে বালেনকে নেতৃত্বে দেখতে চান। এক্স (টুইটার)-এ ট্রেন্ড করছে হ্যাশট্যাগ “বালেন দাই, টেক দ্য লিড”। আন্দোলনের সময় তরুণদের প্রতি সমর্থন জানানোয় তার প্রতি আস্থা বেড়েছে তরুণ প্রজন্মের।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও তরুণদের আস্থা
টাইম ম্যাগাজিন তাঁকে শীর্ষ ১০০ উদীয়মান নেতার তালিকায় রেখেছে, আর দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে তার স্বচ্ছ ও তৃণমূলধর্মী নেতৃত্বের প্রশংসা। বিদেশি গণমাধ্যমে এমন স্বীকৃতি বালেনকে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আলোচনায় নিয়ে এসেছে।

এই খ্যাতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেকটি দিক- তরুণদের আস্থা। আন্দোলনের সময় সশরীরে না থাকলেও তিনি খোলাখুলিভাবে সমর্থন জানিয়েছেন। বলেছেন, “আমি তাদের আকাঙ্ক্ষা, উদ্দেশ্য এবং চিন্তাভাবনা বুঝতে চাই। দলীয় স্বার্থে এই আন্দোলন ব্যবহার করা যাবে না।”

Balen

সম্পদ ও পেশাগত পরিচয়
রাজনীতির বাইরেও বালেনের পরিচয় সমৃদ্ধ। তার হাতে আছে বালেন কনসাল্টিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন প্রাইভেট লিমিটেড। এছাড়া পদ্মা গ্রুপে ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছেন। প্রায় ৫ থেকে ৬ কোটি নেপালি রুপি সম্পদ আর প্রতি মাসে তিন লাখ রুপি আয়ের মালিক তিনি।

আহ্বান শান্তির
অলির পদত্যাগের পর বালেন শাহ ফেসবুকে তরুণদের উদ্দেশে আহ্বান জানান, “জাতীয় সম্পদের ক্ষতি মানে আমাদের সবার ক্ষতি। দয়া করে শান্ত থাকুন। এখন থেকে আপনার প্রজন্মই দেশ পরিচালনা করবে।” তার এই বার্তায় যেমন সংযমের পরামর্শ, তেমনি নেতৃত্ব নেওয়ার ইঙ্গিতও স্পষ্ট।

অজানা ভবিষ্যৎ
বালেন ও অন্যান্য স্বাধীন প্রার্থী জাতীয় রাজনীতির বৃহত্তর জটিলতা সামলাতে পারবেন কি না- সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। কিন্তু একটি বিষয় স্পষ্ট যে নেপালের তরুণ প্রজন্ম এখন পুরনো দলীয় নেতাদের আর বিশ্বাস করে না। তারা চাইছে নতুন এক রাজনৈতিক বাস্তবতা, যার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছেন একজন সাবেক র‌্যাপার—বালেন্দ্র শাহ।

প্রতিবেদনটি তৈরিতে কাঠমান্ডু পোস্টের তথ্য নেওয়া হয়েছে