Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ ও এক শিশুর করুণ মৃত্যুর গল্প

america
১৪ বছর বয়সি জর্জ স্টিনি, ৭০ বছর আগে ইলেকট্রিক শক দিয়ে যার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়

যুক্তরাষ্ট্রের লেখিকা এলিস ম্যালসিনিয়র ওয়াকারের জীবনী থেকে থেকে জানা যায়, কী ভয়ঙ্কর বর্ণবাদী সমাজে বেড়ে উঠেছেন তিনি। তার মাকে তাদের শেতাঙ্গ ভূস্বামী বলেছিলেন, ‘কালো ছেলেমেয়ের পড়াশোনার কোনো দরকার নেই।’ ওয়াকার তার সাড়া জাগানো বই ‘দ্য কালার পারপেল’-এ আফ্রিকান আমেরিকানদের ওপর শেতাঙ্গদের নির্মম নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেছেন।

ওয়াকারের বেড়ে ওঠার সময় (১৯৪৪-বর্তমান) সে দেশে ‘জিম ক্রো আইন’ বহাল ছিল। শুধু দেহের বর্ণের ওপর ভিত্তি করে সাদা ও কালোদের জন্য এই আইনে আলাদা জীবন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে দেওয়া হয়। কৃষ্ণাঙ্গরা হয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। ১৮৯০ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গপ্রধান রাজ্যগুলোতে এই আইন বহাল ছিল। একই সময়ে ছিল নির্বিচারে কৃষ্ণাঙ্গ হত্যায় শেতাঙ্গদের ‘লিঞ্চিং’ প্রথা, যা ‘নিগ্রো লিঞ্চিং’ নামে পরিচিত। এই প্রথায় শেতাঙ্গদের জন্য আত্মরক্ষার অজুহাতে কৃষ্ণাঙ্গ হত্যা জায়েজ ছিল। এ সব নিয়ে উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় এলিস ওয়াকারের বইয়ে।

chardike-ad

এবার ১৯৪৪ সালের একটি ঘটনার দিকে আলোকপাত করা যাক। স্থান যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ক্যারোলিনা। সে সময় লিঞ্চিং প্রথা ও জিম ক্রো আইন বহাল ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ওই রাজ্যে।

জর্জ স্টিনি। ১৪ বছরের এক শিশু। সাউথ ক্যারোলিনার অ্যাকোলুতে ছিল তাদের বাড়ি। হঠাৎ একদিন তাকে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, সাত ও ১১ বছর বয়সি দুই মেয়েকে পিটিয়ে হত্যা করেছে সে। আদালতে প্রমাণ হিসেবে যে তথ্য হাজির করা হয়, সে অনুযায়ী- ওই দুই মেয়ে খুন হওয়ার আগের দিন স্টিনি ও তার বোনকে তাদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়।

এই তথ্যকে হত্যার প্রমাণ হিসেবে ধরে নিয়ে আদালত জর্জ সিস্টিকে মৃত্যুদণ্ড দেন। মাত্র একদিনে দুই ঘণ্টা স্থায়ী আদালত শুনানি শেষে ১০ মিনিটে মৃত্যুদণ্ডের রায় পড়ে শোনান। রায়ের বিরুদ্ধে কোনো আপিল করেননি স্টিনির আইনজীবী। আপিল করার প্রশ্নই ছিল না। কারণ বিচার প্রক্রিয়ার শুরু থেকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর পর্যন্ত যারা যুক্ত ছিল, তারা সবাই শেতাঙ্গ। এক কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেকে বাঁচাতে তাদের এতটা ঝুটঝামেলা পোহানোর সময়ই নেই!

মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় ইলেকট্রিক শক দিয়ে। স্টিনির মৃত্যুদণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শীরা যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা এক কথায় বিভৎস। ইলেকট্রিক শকের জন্য যে উচ্চতা প্রয়োজন হয়, স্টিনির তা ছিল না। পরে একটি বাইবেলের ওপর দাঁড় করিয়ে তার শরীরে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে গত ১০০ বছরের মধ্যে এত অল্প বয়সি কোনো শিশুর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়নি।

america-black

সেই ১৯৪৪ থেকে আজ ২০১৪ সাল। এর মধ্যে অতীত হয়েছে ৭০টি বছর। এতদিন পরে জানা গেল, জর্জ স্টিনি নামের সেই শিশুটি ছিল নিষ্পাপ, নিরাপরাধ। বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ আদালত তাকে নির্দোষ বলে রায় দিয়েছেন। তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে এবং সে সময়ের প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে বিচারক কারমেন মুলেন তার রায়ে বলেন, ‘জর্জ স্টিনির বিরুদ্ধে নজিরবিহীন অবিচার করা হয়েছিল।’

বর্ণবাদের এই নির্মম নিষ্পেষণ যুক্তরাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গেঁথে রয়েছে। জিমি ক্রো আইন বহাল থাকার বছরগুলোতে নির্বিচারে মরেছে অনেক কৃষ্ণাঙ্গ। জর্জ স্টিনি যেন তাদেরই এক প্রতিনিধি।

বর্ণবাদবিরোধী মহান নেতা মার্টিন লুথার কিংয়ের অগ্রণী নেতৃত্বে বর্ণবাদ খাতা-কলম থেকে বিদায় নিলেও শেতাঙ্গ মার্কিনদের মগজ থেকে তা দূর হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে নির্বিচারে যুক্তরাষ্ট্রে কয়েকটি কৃষ্ণাঙ্গ হত্যাকাণ্ড তার প্রমাণ দেয়। সবশেষ ওহাইও রাজ্যে এক ছোট্ট শিশুর হাতে খেলনা পিস্তল দেখে, তাকে সন্ত্রাসী সন্দেহে গুলি করে হত্যা করে শেতাঙ্গ পুলিশ। এর আগে নিউ ইয়র্কে এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে রাস্তায় খোলা সিগারেট বিক্রির দায়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে পুলিশ। মিসৌরির ফার্গুসনে নিরস্ত্র কৃষ্ণাঙ্গ তরুণকে গুলি করে হত্যা করে এই শেতাঙ্গ পুলিশই। কিন্তু এসব হত্যাকাণ্ডে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিতে অস্বীকার করে দেশটির জুরিবোর্ড। এই হলো যুক্তরাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থা, মানবাধিকার পরিস্থিতি। আর সামাজিক অবস্থা? সে কথা না বলাই ভালো। প্রতিটি ক্ষেত্রেই কৃষ্ণাঙ্গরা শোষিত, নির্যাতিত ও বঞ্চিত।

শেতাঙ্গদের বর্ণবাদী এই আচরণে হতাশা প্রকাশ করে দেশটির কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, ‘বর্ণবাদ এ দেশের গভীরে প্রোথিত।’ অর্থবিত্ত, শাসন-প্রশাসন, প্রতিরক্ষা সবই যখন শেতাঙ্গদের দখলে, তখন অসহায়ের মতো এমন দার্শনিক বক্তব্য দেওয়া ছাড়া ওবামার আর কি-ই বা করার থাকে!

আর ওবামার ভাষ্যকে যদি গুরুত্ব দেই, তাহলে জর্জ স্টিনির করুণ মৃত্যু সামনে চলে আসে। ১৮৫০ সালের আগে তো কালো মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে দাস হিসেবে হাঁটে কেনাবেচা হতো। সাদা মানুষেরা তাদের ইচ্ছা মতো ব্যবহার করতো কালোদের। সেই সমাজের মস্তিষ্ক থেকে বর্তমানে কৃষ্ণাদের প্রতি ঘৃণা দেখানোর দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে মাত্র, ঘৃণা উঠে যায়নি।

বর্তমানে বর্ণবাদবিরোধী যে আওয়াজ উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রে, তাতে নতুন মাত্রা যোগ করবে জর্জ স্টিনির ছোট্ট জীবন মিথ্যা অভিযোগে শেষ হওয়ার গল্প। ৭০ বছর আগে ফিরে গিয়ে জর্জ স্টিনির জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে একজন মানুষ হিসেবে হোক, সে কৃষ্ণাঙ্গ কি শেতাঙ্গ, সম-অধিকারের ভিত্তিতে বিচার পাওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠায় স্টিনির ঘটনা পথ দেখাবে আজকের যুক্তরাষ্ট্রকে।

সৌজন্যেঃ রাইজিংবিডি