রাজধানীর শাহজাহানপুরে প্রায় আড়াই শ ফুট গভীর পাইপে আটকে পড়া শিশু জিহাদকে উদ্ধারের ঘটনা দেশের ইতিহাসে বিরল। এমন সময় শিশুটি উদ্ধার হলো যখন কৌশলগত সব চেষ্টা শেষ করে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হলো উদ্ধার অভিযান স্থগিতের। প্রায় ২৩ ঘণ্টা পর কয়েকজন তরুণের উদ্ভাবিত দেশীয় প্রযুক্তিতে শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়। কিন্তু ততক্ষণে শিশুটি আর বেঁচে নেই।
শুক্রবার বিকালে শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনির একটি পানির পাইপে পড়ে যায় সাড়ে তিন বছর বয়সী জিহাদ। পাইপটির ব্যাস মাত্র ১৬ ইঞ্চি। বিকাল পাঁচটার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে উদ্ধার অভিযান শুরু করে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা যেতে থাকলেও সেখান থেকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা যখন শিশু জিহাদকে উদ্ধার করতে পারছিলেন না, তখন একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল দেশ-বিদেশের দর্শকদের কাছ থেকে পরামর্শ আহ্বান করে। এর পর থেকে মোবাইল ফোন ও ফেসবুকের মাধ্যমে অনেকে পরামর্শ পাঠাতে শুরু করেন। সেসব পরামর্শ প্রচার করা হয় টিভি পর্দায়।
ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) মো. আব্দুল হালিম নতুন বার্তা ডটকমকে জানান, এ ধরনের ঘটনার উদ্ধারকাজে এর আগে কখনো তাদের যেতে হয়নি। তাই এটি সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা। পাইপের মতো কম জায়গা থেকে একটা শিশুকে উদ্ধার করার বিষয়টি আসলেই অনেক কঠিন ব্যাপার। এ ধরনের কাজের জন্য তাদের বিশেষ কোনো সরঞ্জামও নেই।
শুক্রবার রাতে অভিযানের একপর্যায়ে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে রামপুরার ‘আইকন ইঞ্জিনিয়ারিং’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। ঘটনাস্থলে ওয়েল্ডিং মেশিন ও অন্যান্য সরঞ্জামসহ তাদের একটি টিমকে নিয়ে আসা হয়। ফায়ার সার্ভিসের পরামর্শে লোহার রড দিয়ে একটি প্রযুক্তি তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়।
খাঁচার মতো করে তৈরি তিন-চার ফুট দৈর্ঘ্যের প্রযুক্তিটি দিয়ে শিশু জিহাদকে উদ্ধার করার কয়েক দফা চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
রাত ১২টার দিকে মিরপুর ১১ নম্বর সেক্টর থেকে ঘটনাস্থলে ছুটে যান মো. আবু বকর সিদ্দিক নামের এক ব্যবসায়ী। তিনি ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পরে তার উদ্ভাবিত কৌশল নিয়ে সবার সঙ্গে আলোচনা করা হয়। সেই হিসেবে আগের তৈরি ‘খাঁচার মতো ডিভাইসটি’ তার পরিকল্পনামতো করে রূপান্তরের কাজ শুরু হয়। সারা রাত সেখানেই কাটে আবু বকরের।
ঘটনাস্থলে সারা রাত কাটে মিরপুর ১০ নম্বরের ফারুক ও রাহুলসহ আরো কয়েকজনের। তারা শনিবার সকালে একটি নতুন ভাবনা নিয়ে এগিয়ে যান। তাদের সঙ্গে আলাপ করে দুপুরের কিছু সময় আগে নিজের ডিভাইসটির কাজ স্থগিত রাখেন আবু বকর সিদ্দিক। তাকে সঙ্গে নিয়ে ফারুক-রাহুলরা দুপুরের পর নতুন ডিভাইসটি তৈরি করেন।
লোহার রড দিয়ে তৈরি ডিভাইসটির সামনের অংশে রাখা হয় তিনটি রড। এগুলোর প্রতিটির মাথায় বড়শির মতো আঁকশি। সেই আঁকশিগুলোর সঙ্গে জালের মতো করে রশি বাঁধা হয়। নরম বাধা পেরিয়ে যাতে ডিভাইসটি নামতে পারে সে জন্য তার মাঝখানে দেয়া হয় ভারী একটি লোহা। ওই লোহার সঙ্গে লাগানো হয় সিসি ক্যামেরা। এরপর এটি নামানো হয় পাইপে।
বেলা তিনটার দিকে ডিভাইসটি পাইপে নামানো হয়। আড়াই শ ফুটের বেশি গভীরে নামিয়ে সেটি আস্তে আস্তে তুলে আনা হয়। ওপরে আনার পর দেখা যায় ডিভাইসটির জালে উঠে এসেছে শিশু জিহাদের লাশ।
শুক্রবার বিকালে জিহাদ ওই পাইপের মুখে পড়ে যায়। পার্শবর্তী এলাকার সহোদরা ফাতেমা আক্তার ও জাহিদা ইয়াসমিন নতুন বার্তা ডটকমকে জানায়, তখন তারা কয়েকজন ওই পাইপের একটু দূরে ব্যাডমিন্টন খেলছিল। তাদের ককটি পাইপের পাশে পড়ে যাওয়ায় সেটি আনতে গেলে কান্নার শব্দ শুনে ছুটে যায় তারা। পাইপের কাছে গিয়ে তারা জিহাদের পড়ে যাওয়ার বিষয় নিশ্চিত হয়। পরে আশপাশের লোকজনকে ডেকেে আনে তারা।
তারা জানায়, ১৬ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপটির মুখ খোলা ছিল। শুধু সেটির মুখে একটি সিমেন্টের বস্তা দেয়া ছিল। জিহাদ পড়ে যাওয়ার পর একটু ফাঁকা ছিল ওই পাইপের মুখ। নতুনবার্তা।