Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

প্রিয় জিহাদ এবং একস্লিপ

পাইপের ভেতরে পড়ে গিয়ে গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়ে যায় শিশু জিহাদ। সরকারি সকল বাহিনী এবং সংস্থা হুমড়ি খেয়ে পড়ে উদ্ধারের জন্য। সারা পৃথিবীর বিবেকবান সকলেই কায়মনোবাক্যে চাইছিলেন, প্রার্থনা করছিলেন, আল্লাহর অশেষ রহমতে শিশু জিহাদ অক্ষত অবস্থায় তাড়াতাড়ি উদ্ধার হবে।

chardike-ad

কিন্তু আমাদের সকলের প্রার্থনা পেছনে ফেলে শিশু জিহাদ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো। যে বাবা মায়ের বুক খালি করলো কলিজার টুকরো নাড়ি ছেড়া ধন-সেই পিতা মাতাই জানে তাদের বুকের মানিক হারানোর যন্ত্রণা।

০১) চিলিতে যখন কয়লা খনির দুর্ঘটনায় শ্রমিকরা আটকা পড়েন, তখন বিকল্প পথে কূপ খনন করে শ্রমিকদের জীবিত উদ্ধার করা হয়েছিলো। স্যাটেলাইটের সুবাদে বিশ্ববাসী তা দেখেছিলেন। শ্রমিকদের যখন কূপের ভেতর থেকে উঠিয়ে আনা হচ্ছিলো, তখন কূপের  ভেতরে রেসকিউ টিম যাওয়া থেকে শ্রমিকসহ উঠে আসা সব কিছুই দেখানো হচ্ছিলো। বাংলাদেশের সাংবাদিক এবং ক্যামেরাম্যানরা শিশু জিহাদের তুলে আনার কোন দৃশ্যই কেন যে দেখাতে পারলেন না- সেটাও একটা বড় প্রশ্ন।

এটা কি এতোগুলো চ্যানেলের ক্যামেরাম্যানদের ব্যর্থতা নাকি তারা সেভাবে ট্রেনিংপ্রাপ্ত নন, নাকি অন্য কোনো ব্যবস্থা সেখানে সক্রিয় ছিলো?

০২) গাজীপুরে যখন খালেদা জিয়ার সমাবেশ নিয়ে টানটান উত্তেজনা চলছিলো, ঠিক তার কিছু আগে কাকতালীয়ভাবে শাহজাহানপুরে ৩০০ ফুট পাইপের নীচে শিশু জিহাদ পড়ে যায়। সারাদেশের চোখ তখন গাজীপুর থেকে ফিরে যায় শাজাহানপুরে। গাজীপুরে যতক্ষণ পর্যন্ত বিএনপি এবং ছাত্রলীগ থাকে মুখোমুখি এবং অনড় ততক্ষণ শিশু জিহাদ থাকে উদ্ধার অভিযানের কেন্দ্রে। গাজীপুরে যখনই ১৪৪ ধারা জারি হয়ে যায় এবং সেখানে কোন অঘটন বা খালেদা জিয়ার দ্বারা সরকারের জন্য কোন বিপদের সম্ভাবনা থাকেনা- তখনি শিশু জিহাদ উদ্ধার হয়ে যায় পরিত্যক্ত। বলা হয় তেলাপোকা ও পানি পাইপের নীচে ক্যামেরায় দেখা গেলেও জিহাদের অস্তিত্ব দেখা যায়নি। তাই সেখানে শিশু পড়া গুজবই হয়ে যায়।

০৩) শিশু জিহাদ যখন পাইপের নীচে পড়ে যায়, তখনো টুঙ্গীপাড়ায় সরকার প্রধানের কর্মসূচি অব্যাহত থাকে। চিলির প্রেসিডেন্ট শ্রমিকদের উদ্ধারের তদারকির জন্য কূপের খননস্থানে দিনরাত থেকে তদারকি করেন যেখানে, সেখানে ঢাকার সরকার প্রধান শিশু জিহাদের পাইপের মধ্যে কিভাবে কি হচ্ছে- তা দেখার বা তদারকির জন্য উপস্থিতি মানবিকভাবেই লক্ষণীয় না হলেও টুঙ্গীপাড়া জিয়ারত যথাযথভাবে বিদ্যমান থাকে।

ফলশ্রুতিতে খালেদা জিয়ার গাজীপুর ফ্লপের সাথে শাহজাহানপুরে জিহাদ উদ্ধারে যেমন জোর তৎপরতা ভাটা পড়ে, তেমনি টুঙ্গীপাড়া জিয়ারত হয়ে পড়ে আকর্ষণীয়। অর্থাৎ গাজীপুর যদি বিক্ষোভে ফুঁসে উঠতো, নির্ঘাত বলা যায় শাহজাহানপুরে শিশু জিহাদ উদ্ধারে রাষ্ট্র তার সর্বশক্তি শুধু নিয়োজিত করতোনা- বরং ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সারা জাতির চোখ যেন জিহাদের প্রতি নিবিষ্ট হয়- সেই ব্যবস্থাই করতো।

০৪) পৃথিবীর সব দেশেই যখন কোনো সংকট দেখা দেয়- তখন সেই সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ এবং সফলতার ট্র্যাক রেকর্ডধারীদের ডেকে আনা হয়। এতে দেখা হয়না তিনি কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা কোন প্রতিষ্ঠানের সেরা ব্যক্তিত্ব। বরং দেখা হয় সংশ্লিষ্ট কাজে সে কতটা দক্ষ। শিশুটি যখন পাইপের মধ্যে পড়ে যায়, তখন প্রাথমিক উদ্ধার অভিযানের জন্য যাদের ডাকা হয়, সেখানেই প্রশ্নের সৃষ্টি করে। তবে প্রাথমিকভাবে যে জুস এবং অক্সিজেন সাপ্লাই করা হয়- তা ছিলো প্রশংসনীয়। কিন্তু পরক্ষণেই যখন অক্সিজেন এবং আনুষঙ্গিক লজিস্টিক সাপোর্টধারীদের ও সংশ্লিষ্ট এক্সপার্টদের কোন সাহায্য না নিয়ে কেবলমাত্র ফায়ার সার্ভিস (যারা চূড়ান্ত মুহূর্তে অপারেশনের দায়িত্বে থাকার কথা)এর সাহায্যে উদ্ভট কতিপয় উদ্ধারকার্য করা- স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নের জন্ম দেয়। বুয়েটের ট্যাগ লাগানো বিশেষজ্ঞ বা ইঞ্জিনিয়ার এলেই যে শিশু উদ্ধারের কাজে দায়িত্ব সাড়া গেলো বা হয়ে যাবে এমন ভাবনা কেমন করে এলো?

পাইপের ভেতর থেকে শিশু উদ্ধারের ব্যাপারে যা যা করণীয়- যা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে এখন অনেকেই কিছু না কিছু অবগত, তার কিছুই করা হলোনা। সব চেয়ে আশ্চর্য লাগে। এতো বড় এক ক্রাইসিস অথচ অক্সিজেন সাপ্লাই এবং শিশুর জন্য বেঁচে থাকার ব্যবস্থা সেখানে কিভাবে করা হবে, তার কোন অগ্রিম ব্যবস্থা না করে, মিডিয়াকে যত্রতত্র কাজের সুযোগ করে দিয়ে উদ্ধার অভিযানে নিয়োজিত লোকজন শুধুমাত্র শিশুটিকে উদ্ধারের সকল বাহারি কৌশল অবলম্বনের ফোকাস-সব কিছুতেই একটা বিরাট ‘কিন্তু’ জন্ম দিয়েছে।

০৫) পাইপের মধ্যে শিশু থাকা বা কোন মানুষের অস্তিত্ব থাকার আর সম্ভাবনা নেই- এমন ঘোষণার পরেই সংবাদপত্রের এবং টেলিভিশন মিডিয়ার ভাষ্যমতে মাত্র ৫ মিনিটের মধ্যে (ধরেই নিলাম আধঘন্টার) শিশুটিকে পাইপের ভেতর থেকে সরাসরি একেবারে টেলিভিশনের লাইভ দৃশ্য অনুযায়ী একেবারে হাতের মধ্যে (কোলের) এসে গেলো- প্রশ্নটা মূলত এখানেই। কারণ একই সময়ের কিছু আগেই খালেদা জিয়ার সমাবেশ গাজীপুরে হবেনা- ঘোষিত হয়ে গেছে। এই সব প্রশ্ন কিছুতেই আসতোনা, সরকারের ভাষ্য, টেলিভিশনের লাইভ উদ্ধার দৃশ্য, ছেলেটির উদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গে ইমার্জেন্সি এবং তাৎক্ষণিক মেডিকেয়ার ব্যবস্থার পরিবর্তে সবাই মিলে ছবি উঠানো এবং প্রচার বা তাতেই ব্যস্ততা- সব কিছুতেই যেন অন্য রকম এক গন্ধ আপনা আপনিই এসে যায়।

০৬) শিশু জিহাদ উদ্ধারে শিশুটির মা বাবাকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যায় থানাতে। নিতেই পারে যদি অস্বাভাবিক বা নিখোঁজ কিংবা জখম বা মৃত্যুর সংবাদ বা অন্য কোনোধরণের সন্দেহ বা অভিযোগের তীর মা বাবার প্রতি উঠতো। কিন্তু যেখানে শিশুটি তখনো পাইপের  ভেতরে, এই সময়ে শিশুটির মা বাবাকে গ্রেফতার- কাজেই সরকারের প্রতি সন্দেহ আরো বাড়ে, জোরালো হয়। কারণ, সরকারি কাজের সব কিছুকেই জনগণ এখন সন্দেহের চোখে দেখে।