Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

৪০ দিনে সহিংসতা ও বন্দুকযুদ্ধে নিহত ৮৪

strick

বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকা চলমান হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বন্দুকযুদ্ধ ও রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় গত ৪০ দিনে অন্তত ৮৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ হিসেবে প্রতিদিন গড়ে দুইজন নিহত হচ্ছেন।

chardike-ad

এই সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে কথিত বন্দুকযুদ্ধে অন্তত ২৬ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৫ জনই বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী।

বিরোধী রাজনৈতিক জোটের প্রধান দল বিএনপি এর অঙ্গ সংগঠন ছাত্রদল এবং জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন শিবিরের দাবি, তাদের সাড়ে তিন`শ এর বেশি নেতাকর্মীকে হত্যা ও গুম করা হয়েছে। গুমের ঘটনায় অনেক নেতাকর্মীদের খোঁজ মিলছে না বলে দাবি তাদের।

তবে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যারাই নাশকতা করবে তাদের বিরুদ্ধেই কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। রাষ্ট্র বিজ্ঞানী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে গত ১৫ বছরে বন্দুকযুদ্ধ, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় সারাদেশে আড়াই হাজার ছাড়িয়ে গেছে নিহতের সংখ্যা।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকারের দুই মেয়াদে সবচেয়ে বেশি নিহতের ঘটনা ঘটেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ৬ বছরে আন্দোলন, অবরোধ, হরতাল, নির্বাচনী সহিংসতা ও দলগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং বিশেষ করে বন্দুকযুদ্ধের নামে এক হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।

এর মধ্যে গত নির্বাচনের আগের বছর ২০১৩ সালে ৫০৭ জন এবং ২০০১ সালেও নির্বাচনকালীন সময়ে ৫০০ জন নিহত হয়।

আসকের হিসেব অনুযায়ী, ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার বছরেই রাজনৈতিক সহিংসতায় সারাদেশে নিহত হয় ৪২ জন। ২০১০ সালে ৭৬ জন। ২০১১ সালে কমে ৫৮ জন হলেও ২০১২ সালে ৮৪ জন নিহত হয়। তবে সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায় পরের বছর ২০১৩ সালে। বেড়ে দাঁড়ায় ৫০৭ জনে। এরপর ২০১৪ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৪৭ জন।

অপরদিকে চারদলীয় জোট সরকারের পাঁচ বছরেও (২০০১-২০০৬) নিহতের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। রাজনৈতিক সহিংসতা ও বন্দুকযুদ্ধের নামে নিহতের ঘটনা সাত শতাধিক। এর মধ্যে ২০০৬ সালেই নিহত হয় ১২০ জন।

চারদলীয় জোটের শাসনামলে ২০০২ সালে ৩২০ জন, ২০০৩ সালে ২০৩ জন, ২০০৪ সালে ৫২ জন ও ২০০৫ সালে ৩৪ জন নিহত হয়। তবে রাজনৈতিক সহিংসতায় সবচেয়ে কম নিহত হয় তত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরে (২০০৭-০৮)। এ সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় ১১ জন নিহত হয়েছে। ২০০৭ সালে ৭ জন এবং ২০০৮ সালে ৪ জন নিহত হয়েছে ।

চলতি বছরে রাজনৈতিক সহিংসতা :

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল ২০১৪ সালের মানবাধিকার পর্যালোচনা প্রতিবেদন প্রকাশ শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘দেশে এক বছরে ৬৬৮টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রথম ছয়দিনেই সহিংসতায় ২৪ জন নিহত হয়েছেন।’

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনকালীন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে সহিংসতা। নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছিল না কখনো। চলতি বছর ৫ জানুয়ারিকে গণত্ন্ত্র রক্ষা দিবস ও আওয়ামী লীগের বিজয় দিবস ঘোষণা ও কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠে রাজনৈতিক অঙ্গন।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে না পারা এবং বিএনপির গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে বেগম খালেদা জিয়াকে বের হতে না দেয়াকে কেন্দ্র ৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হয় অবরোধ। সে অবরোধ এখনো চলছে। এবং এর সাথে সারাদেশ ও স্থানীয় পর্যায়েও চলছে হরতাল। এই বিগত ৪০ দিনে সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়েছে সহিংসতা।

সরকার দল ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অনড় অবস্থানের কারণে বেড়েই চলেছে নিহতের সংখ্যা। এই সময়ে রাজনৈতিক হামলা, পেট্রলবোমা হামলা, ককটেল বিস্ফোরণ ও বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় নিহত হয়েছে ৫২ জন। অন্যান্য ঘটনায় নিহত হয়েছে অন্তত ৩০ জন।

এর মধ্যে রাজধানী ঢাকা, গাইবান্ধা, রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ, রংপুর, বগুড়া ও কুমিল্লাসহ বেশ কয়েকটি জেলায় নাশকতার ঘটনায় নিহতের সংখ্যা যেমন বেশি তেমনি এসব এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে কথিত `বন্দুকযুদ্ধে` নিহত হয়েছেন উল্লেখ্যযোগ্য সংখ্যক মানুষ।

নিহত সাধারণ মানুষদের মধ্যে রিকশাচালক, দিনমুজর আবার কেউ পোশাক শ্রমিক। অপরদিকে বন্ধুকযুদ্ধে বিরোধী ২০ দলীয় জোটভুক্ত নেতাকর্মীর সংখ্যাই বেশি। অবরোধ ও হরতালে দেশের বিভিন্ন স্থানে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১১ জন। চিকিৎসা নিয়ে ফিরে গেছেন আরও অন্তত ৬৫ জন। বর্তমানে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৭০ জন দগ্ধ মানুষ।

চলছে অবরোধ বেড়ে চলেছে খুন-গুম :

চলতি বছরের গত ৪০ দিনে সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে কথিত `বন্দুকযুদ্ধে` অন্তত ২৬ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৫ জনই বিরোধী দলের নেতাকর্মী। এ সময়ে শুধু রাজধানীতেই নিহত হয়েছেন ১০ জন।

এর বাইরে আরও চারজনকে পুলিশ পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ করেছে নিহতদের পরিবার। এই সময়ে রাজধানীর রূপনগর থানা এলাকা থেকে এক ছাত্রদল নেতার গুলিবিদ্ধ মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পরিবার বলছে, পুলিশ আটকের পর তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে।

শিবিরকর্মী জসীমকে শেরেবাংলানগরে ডিবি পুলিশ আটকের পর পরিকল্পতিভাবে হত্যা করেছে বলে দাবি করেছে শিবির।

সোমবার ভোরেও রাজধানীর কালশী এলাকার লোহার ব্রিজের পাশে গুলিবিদ্ধ এক যুবকের (২৫) মরদেহ পাওয়া গেছে। মরদেহের পাশে একটি ব্যাগের ভেতর থেকে সাতটি পেট্রলবোমা ও সাতটি ককটেল উদ্ধার করে ক্যান্টনমেন্ট থানা পুলিশ। এটি ‘হত্যাকাণ্ড’ না ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার ঘটনা, তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানাতে পারেনি।

ক্যান্টনমেন্ট জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) কুদরত–ই–খুদা বলেন, ‘ঘটনাটি সম্পর্কে কিছু বোঝা যাচ্ছে না আমরা, খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’

অন্যদিকে রাজধানীর ডেমরা এলাকায় ডিবি পুলিশের সাথে `বন্দুকযুদ্ধে` একজন গুরুতর আহত হয়েছেন। ডিবি পুলিশ দাবি করেছেন আহত ওই ব্যক্তি চোরাগোপ্তা হামলাকারী।

এছাড়া চাপাইনবাবগঞ্জ ও যশোরে তিনজনকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। এসব ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে বরাবর `বন্দুকযুদ্ধের` বিষয়টি জোড়ালোভাবে উপস্থাপন করে আসছে।

বিএনপির পক্ষ থেকে বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, গত ২৬ ডিসেম্বর থেকে ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত মাত্র এক মাসে সারাদেশে প্রায় তিন`শ রাজনৈতিক নেতাকর্মী খুন ও গুম হয়েছেন। দলটির অভিযোগ, রাষ্ট্রীয় বাহিনী দিয়ে বিরোধী দলকে দমন করার চেষ্টা করছে সরকার।

ছাত্রদল ও শিবির দাবি করেছে, চলতি বছর অন্তত ৩০ জন কর্মীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটক করার পর আর খোঁজ মিলছে না।

নাশকতাকারীদের সাবধান করে দিয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, `নাশকতাকারী যেই হোক কোনো ধরনের ছাড় দেয়া হবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারের বিরুদ্ধে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগও অস্বীকার করেন তিনি জানিয়েছেন, সরকার বিরোধীদের আন্দোলন দমন করা সরকারের উদ্দেশ্য নয়। আন্দোলনের নামে যারা নাশকতা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে।’

এব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশে বর্তমানে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার নামে দেওলিয়াত্বই প্রকাশ করে চলেছে। দেশে একটি হত্যাকেণ্ডে পর তা বৈধতা দেয়ার জন্য অথবা প্রতিশোধের নেশায় আরেকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে।

দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধানগণ ও সরকারদলীয় নেতারা যেভাবে কথা বলছেন তাতে কে যে রাজনৈতিক আর কে যে আইনশৃংখলা বাহিনীর লোক তা বোঝা দায়। এ অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যত অন্ধকারে পতিত হবে বলে মনে করেন তিনি।

এই অবস্থা থেকে বেড়িয়ে আসার সমাধান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সমাধানের চাবি তো দুজনেরই হাতে। সেজন্য তাদের ত্যাগ স্বীকার করে আলোচনায় বসার আহবান জানান তিনি।

তিনি বলেন, বর্তমানে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণ রাজনৈতিক সংকট। সেজন্য আগে রাজনৈতিক সমঝোতার প্রয়োজন। রাজনৈতিকভাবে সমস্যার সমাধান করা গেলে দেশের পরিস্থিতিরও উন্নতি ঘটবে বলে মনে করেন তিনি।