Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

বিশ্বকাপে “ভাগ্য” ফ্যাক্টর

World-Cup-Trophyযেকোনো দলের বিশ্বকাপে সফল হওয়ার শর্ত কী? এমন প্রশ্নে সাধারণ যে কেউ বলে দেবে ব্যাটিং, বোলিং, আর ফিল্ডিং এই তিনটি ডিপার্টমেন্টে শ্রেষ্ঠ নৈপুণ্য প্রদর্শন। একটু বিচণ দর্শকরা হয়তো এর সাথে যোগ করবেন দলীয় সমন্বয় আর অধিনায়কের সময়োপযোগী রণকৌশল।

কিন্তু ইতিহাস বলছে এগুলোর পাশাপাশি বিশ্বকাপের সঙ্গে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে আছে আরোও একটি বিষয়- যার নাম ভাগ্য। বিশ্বকাপের অনেক সাফল্য-ব্যর্থতার উপাখ্যান রচিত হয়েছে এই ‘ভাগ্য’কে জড়িয়ে। ভাগ্যের কারণে বিশ্বজয়ের উচ্ছাস আর চোখের পানি দুটোই দেখেছে বিশ্বকাপের মাঠ।

chardike-ad

১৯৯২ অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপ। রঙিন জার্সি আর সাদা বলের যাত্রা শুরুর সে আসরে শুরুটা খুব বাজে ভাবেই হয়েছিল পাকিস্তানের। গ্রুপে প্রথম পাঁচ ম্যাচের তিনটিতে হেরে খাদের কিনারে চলে যায় দল। তবে এডিলেডে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচটাই পাল্টে দেয় পাকিস্তানের বিশ্বকাপ ভাগ্য। যদিও গুরুত্বপূর্ণ সে ম্যাচেও হারের চেষ্টার কমতি রাখেনি আনপ্রেডিক্টেবলরা! আগে ব্যাট করে অলআউট হয় মাত্র ৭৪ রানে। সহজ টার্গেট তাড়া করে ইংল্যান্ডের স্কোর যখন কোনো কোনো উইকেট না হারিয়ে ২৪ তখনই শুরু হয় প্রবল বৃষ্টি। সেই বৃষ্টিতে শুধু ম্যাচটাই ভেসে যায়নি, ভেসেছে চরায় আটকে যাওয়া ইমরান খানে বিশ্বকাপ স্বপ্নও। ভ্যাগ্যের দয়ায় পাওয়া সেই ১ পয়েন্টের কারণে সমান সংখ্যক জয় থাকার পরও ওয়েস্ট ইন্ডিজকে পিছনে ফেলে সেমিফাইনালে চলে যায় পাকিস্তান। বাকিটা তো ইতিহাস।

পাকিস্তান ’৯৯ ইংল্যান্ড আসরেও পেয়েছিল কিছুটা ভাগ্যের ছোয়া। গ্রুপে দুর্দান্ত খেললেও ওয়াসিম আকরামের দল সুপার সিক্সে হেরে যায় ভারত ও দণি আফ্রিকার বিপক্ষে জিম্বাবুয়ের বিপে পায় একমাত্র জয়। সেই আসরের নিময় ছিল প্রথম রাউন্ডের পয়েন্টের সাথে সুপার সিক্সের পয়েন্ট যোগ করে সেমিফাইনালের লাইনআপ করা হবে। যার কারণে প্রথম রাউন্ডে ভালো খেলা পাকিস্তান মাত্র একটি জয় নিয়ে উঠে যায় সেমিফাইনালে।

১৯৯৬ বিশ্বকাপ আসরের যৌথ আয়োজক ছিল এশিয়ার তিন ক্রিকেট শক্তি ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলংকা। ক্রিকেট বিশ্বে শ্রীলংকা তখনও দ্বিতীয় সারির দল। কিন্তু ভাগ্য ছিল তাদের সাথে। তামিল বিদ্রোহীদের বিশ্বকাপ বানচালের হুমকির কারণে সেবার শ্রীলংকায় খেলতে যায়নি অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বড় দুই দলের বিপে না খেলেই ওয়াকওভার পায় শ্রীলংকা। যা তাদের নিয়ে যায় সেমিতে। সেমিফাইনালে ভারতীয় দর্শকদের দাঙ্গার কারণে ম্যাচ পরিত্যাক্ত হলে শ্রীলংকাকে জয়ী ঘোষণা করে ম্যাচ রেফারি। সে ম্যাচে অবশ্য জয়ের কাছাকাছিই ছিল শ্রীলংকা। তবু ক্রিকেটে যখন শেষ বলের আগে কিছু বলার সুযোগ নেই তখন ভাগ্যের সুবিধার কথা স্বীকার করতেই হবে। ফলশ্রুতিতে ফেবারিটের তকমা গায়ে না থাকলেও শিরোপা জেতে রানাতুঙ্গার শ্রীলংকা।

২০০৩ বিশ্বকাপ আসরে ‘ভাগ্য’ সৌভাগ্যে পরিণত হয় দুই ‘ছোট দল’ জিম্বাবুয়ে ও কেনিয়ার জন্য। সেবারও নিরাপত্তা জনিত কারণে কেনিয়া ও জিম্বাবুয়েতে খেলতে যায়নি যথাক্রমে নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ড। ওয়াকওভার পেয়ে সুপার সিক্সে ওঠার পথ সহজ হয় উভয় দলের। সুপার সিক্সে আবার বাঘা বাঘা দল থাকতেও এই দুই দল পরস্পরের মুখোমুখি হয়। জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে ইতিহাস গড়ে কেনিয়া। প্রথম আইসিসির সহযোগী সদস্যদেশ হিসেবে উঠে যায় সেমিফাইনালে।

২০০৭ বিশ্বকাপে ভাগ্যের কিছুটা সহায়তা পেয়ে সুপার এইটে ওঠেছিল আরেক সহযোগী সদস্য দেশ আয়ারল্যান্ড। গ্রুপ পর্বের ম্যাচে জিম্বাবাবুয়ের বিপে ২২১ রান করে তারা। ২২২ রানের লে জয়ের পথেই হাটছিল জিম্বাবুয়ে। এক পর্যায়ে তাদের রান ছিল ৫ উইকেট ২০৩। এরপর মাত্র ১৮ রানে শেষ ৫ উইকেট হারালে টাই হয় ম্যাচ। এক পয়েন্ট নিয়ে অন্য ম্যাচে পাকিস্তানকে হারানো আয়ারল্যান্ড উঠে যায় সুপার এইটে। ভাগ্যের এই সুপ্রসন্নতার পাশাপাশি বিশ্বকাপ ইতিহাসে ভার্গের নির্মমতার নজিরও কম নয়। নিতান্তই দুর্ভগ্যের কারনে কখনও হাতছাড়া হয়েছে নিশ্চিত জয় কিংবা বিদায় নিতে হয়েছে টুর্মামেন্ট থেকেই। তবে বিশ্বকাপের ভাগ্য ফ্যাক্টরের সবচেয়ে বড় শিকার নিঃসন্দেহে দণি আফ্রিকা। একাধিকবার টুর্নামন্টের হট ফেবারিট হয়েও তাদের নিরাশ হতে হয়েছে ভাগ্যের কাছে।

১৯৯২ অস্ট্রেলিয়া আসরে দীর্ঘদিনের নির্বাসন কাটিয়ে ক্রিকেটে ফেরে প্রোটিয়ারা। ভালো দল হিসেবেই পৌছে যায় সেমিফাইনালে। সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে বৃষ্টির কারণে ছোট হয়ে আসা ম্যাচে ৪৫ ওভারে ২৫২ রান তোলে ইংল্যান্ড। জবাব দিতে নেমে দণি আফ্রিকার এক পর্যায়ে ১৩ বলে ২২ রান দরকার হাতে ৪ উইকেট। ক্রিজে তখন সেট হওয়া দুই ব্যাটসম্যান ব্রায়ান ম্যাকমিলান ও ডেভ রিচার্ডসন। দর্শকরা যখন জমজমাট এক ফিনিশিং দেখতে প্রস্তুত তখনই হানা দেয় বৃষ্টি। ১২ মিনিট পর বৃষ্টি থেমে গেলে সে সময়ের বৃষ্টি আইনে নতুন টার্গেট দেয়া হয় দণি আফ্রিকাকে। বর্তমান ডাক ওয়ার্থ লুইস পদ্ধতির প্রচলন হয়নি তখনও। অদ্ভুত বৃষ্টি আইন অনুযায়ি দণি আফ্রিকাকে ৭ বলে ২২ রানের টার্গেট দেয়া হয় শুরুতে। কিন্তু নিজেদের ‘হিসাবে’ সন্তুষ্ট হতে না পেরে আবারও হিসাব করতে বসেন ম্যাচ অফিশিয়ালরা। এবার মেগা স্ক্রীনে দেখা যায় আরও নির্মম ও হাস্যকর এক টার্গেট ১ বলে ২২ রান। সৌজন্য রার খাতিরে মাঠে নেমে একটি বল খেলে প্রোটিয়া ব্যাটসম্যানরা। শেষ হয় তাদের বিশ্বকাপ স্বপ্ন।

১৯৯৯ তে বিশ্বকাপের আসর বসে ইংল্যান্ডে। যথারীতি গ্রুপ পর্বে ‘মারমার-কাটকাট’ স্টাইলে খেলতে থাকে দক্ষিণ আফ্রিকা। সুপার সিক্সে তারা মুখোমুখি হয় স্টিভ ওয়াহর অস্ট্রেলিয়ার। অস্ট্রেলিয়ার জন্য সেটা ছিল ডু অর ডাই ম্যাচ- অর্থ্যাৎ হারলেই উঠতে হবে দেশের বিমানে। দ্বিতীয় ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকার দেয়া ২৭১ রানের টার্গেট তাড়া করতে গিয়ে দ্রুত টপ অর্ডারের ব্যাটসম্যানদের হারায় অসিরা। স্টিভ ওয়াহ ব্যক্তিগত ৫৬ রানে ক্যাচ তুলে দেন হার্শেল গিবসের হাতে। কিন্তু আনন্দের অতিশয্যে হাতে জামনোর আগেই ক্যাচ উদযাপন করতে গিয়ে গিবসের হাত ফসকে পরে যায় বল। তারপর ১১০ দশ বলে অপরাজিত ১২০ রানের ইনিংস খেলে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়েন স্টিভ। কথিত আছে ঐ ঘটনার পর স্টিভ ওয়াহ নাকি হার্শেল গিবসকে বলেছিলেন-‘তুমি হাত থেকে বিশ্বকাপটাই ফেলে দিলে।’ সেই ম্যাচ জিতে সেমিফাইনালে চলে যায় অস্ট্রেলিয়া। ফাইনালে যাওয়ার লড়াইয়ে আবারও তাদের মুখোমুখি হয় দক্ষিণ আফ্রিকা। দুর্ভাগ্যও যেন ওত পেতেই ছিল তার চুড়ান্তা রূপটা দেখানোর জন্য। সেমিফাইনালে ব্যাট করতে নেমে ডোনাল্ড আর শন পোলকের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে ২১৩ রানের বেশি তুলতে পারেনি স্টিভ ওয়াহর দল। জবাব দিতে নেমে শুরুতে দ্রুত উইকেট হারালেও জ্যাক ক্যালিস আর জন্টি রোডসের জুটিতে ভালো অবস্থানে পৌছে যায়। শেষ দিকে পুরো বিশ্বকাপে দুর্দান্ত খেলা ল্যান্স কুজনারের ১৬ বলে ৩১ রানের ঝড়ো ইনিংসে জয়ের কাছাকাছি পৌছে যায় তারা। দুই দলের রান সমান হওয়ার পরও হাতে ছিল তিনটি বল। অর্থাৎ তিন বলে দরকার ১ রান, উইকেটে শেষ জুটি কুজনার ও ডোনাল্ড। কিন্তু সেই সহজ কাজটি করতে গিয়েই বিপত্তি বাধায় চোকার্সরা। ডেমিয়েন ফেমিংয়ের চতুর্থ বলটি কুজনার ঠেলে দিতেই ননস্ট্রাইকে থাকা এলান ডোনাল্ড দিলেন ভো দৌড়, কিন্তু কজনার ক্রিজ ছাড়লেন না। রান আউট হয়ে গেলেন ‘শ্বেতবিদ্যুত’। ম্যাচ টাই হলো আগের ম্যাচগুলোতে মুখোমুখি লড়াইয়ে এগিয়ে থাকায় অস্ট্রেলিয়া চলে যায় ফাইনালে। আর বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পেলেও কুজনার হয়ে যান ট্রাজিক হিরো। তবে ডোনাল্ড কেন যে অমন দৌড় দিয়েছিলেন আর কুজ কেনই বা ক্রিজ ছাড়েননি তার কোন ব্যাখ্যা আজও পাওয়া যায়নি।

২০০৩ বিশ্বকাপের ইতিহাস আরও বেদনাদায়ক। সেবার দক্ষিণ আফ্রিকা ছিল বিশ্বকাপের আয়োজক। প্রতিটি আসরে ভালো খেলেও শিরোপা জিততে না পারার দুঃখ ভুলতে দেশের মাটিতে শিরোপা জিততে মরিয়া হয়ে মাঠে নামে তারা। তবে সেবারও তাদের বিদায় নিতে হয় প্রথম রাউন্ড থেকেই। সেখানেও পারফরম্যান্সের চেয়ে বেশি ছিল দুর্ভাগ্যের মারপ্যাচ। গ্রুপ পর্বের শুরুটা খারাপ হওয়ায় শেষ ম্যাচে শ্রীলংকার সাথে ডু অর ডাই ম্যাচে মাঠে নামে তারা। জিতলে পরের রাউন্ড, হারলে বিদায়। আতাপাত্তুর সেঞ্চুরিতে আগে ব্যাট করে ৯ উইকেটে ২৬৮ রান তোলে সনাথ জয়সুরিয়ার দল। দক্ষিণ আফ্রিকা ভালোই খেলছিল। ইনিংসের শেষ দিকে ডারবানের আকাশ ছেয়ে যায় কালো মেঘে। ৪৬তম ওভারে হালকা ভাবে দু’এক ফোটা বৃষ্টি নামতে শুরু করে। বৃষ্টি আইনের হিসাব করে দক্ষিণ আফ্রিকা দল তখন ক্রিজে থাকা ব্যাটসম্যান মার্ক বাউচারের কাছে খবর পাঠালো ৪৬তম ওভার শেষ তাদের রান ২২৯ হলে তারা এগিয়ে থাকবে। এরপর বৃষ্টি নামলেও সমস্যা নেই। মুরালিধরনের পঞ্চম বলে বাউচার ছক্কা মারলে তাদের রান দাড়ায় ২২৯, বাউচার ভাবলেন প্রয়োজনীয় রান হয়ে গেছে। তাই শেষ বলটি মিড উইকেটে খেলেও কোন রান নিলেন না। সাথে সাথেই নামলো তুমুল বৃষ্টি। তখন জায়ান্ট স্ক্রীনে দেখানো হলো ১ রানে পিছিয়ে আছে দক্ষিণ আফ্রিকা, তাদের দরকার ছিল ২৩০ রান। আর কোন বল মাঠে গড়াতে পারেনি। যার ফলে ঐ ১ রানেই হেরে যায় স্বাগতিকরা। হিসেবে ভুল করার মাশুল তাদের দিতে হয় চোখের পানিতে। বিশ্বকাপে ভাগ্যের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে একটি কারণে। ব্রিসবেনে বাংলাদেশ বনাম অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচটি বৃষ্টিতে ভেসে গেছে। দল হিসেবে অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে। বিশ্বকাপে শিরোপারও প্রধান দাবিদার তারা। তাই অস্ট্রেলিয়ার সাথে পয়েন্ট ভাগাভাগি করে নেয়াটা বাংলাদেশের ভাগ্যই বলতে হবে। আর ভাগ্যের সেই সুযোগটা

কাজে লাগবে বাংলাদেশ ইংল্যান্ড অথবা নিউজিল্যান্ডের সাথে কোন একটি মাত্র ম্যাচ জিতলেই। পৌছে যাবে কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়ার। গ্রুপে বাংলাদেশের মূল প্রতিদ্বন্দীতা হবে ইংল্যান্ডের সাথে। ইংলিশরা পরবর্তী দুটি ম্যাচ জিতলে তাদের পয়েন্ট হবে ৬, আর বাংলাদেশ যে কোন একটি জিতলে হবে ৭।

আর এই নতুন সমীকরণকে সামনে নিয়েই ক্রিকেট বিশ্বে নতুন করে আলোচিত হচ্ছে ভাগ্য ফ্যাক্টর। রান রেটে ইংল্যান্ডকে টপকে পরের রাউন্ডে যাওয়া টাইগারদের জন্য কঠিনই বটে, তবে ভাগ্যের সহায়তা যখন পাওয়াই গেছে সেটা কাজে লাগিয়ে বাজিমাত করতে পারলে ভালো কিছুর আশা করতে দোষ কী!