Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

১৬ বছর ধরে হয়রানিতে কোরিয়ান ইপিজেড

korean-epz
ফাইল ছবি

১৬ বছর ধরে হয়রানির মধ্যে আছে কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা বা কেইপিজেড। বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের পথিকৃৎ ইয়াংওয়ান-এর ব্যবস্থাপনায় থাকা কেইপিজেডকে জমি দেওয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু দেওয়া হয়নি মালিকানার স্বত্ব। পরিবেশ ছাড়পত্র দিতে ঘোরানো হয়েছে ১০ বছর। ভূমির উচ্চতা নিয়ে ঘোরানো হয়েছে এক বছর। দীর্ঘ বিলম্বের গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে তা বিচ্ছিন্নও করা হয়েছে একাধিকবার। তারপরও ইপিজেডকে বিনিয়োগ উপযোগী করতে ইতিমধ্যে কোরিয়ান কোম্পানিটি বিনিয়োগ করেছে হাজার কোটি টাকা। কাজও শেষ ৮৩ শতাংশ।

এখন সেই জমির মধ্যে দুই হাজার একর ফিরিয়ে নিয়ে ৫০০ একর জমি রাখার কথা বলা হচ্ছে। আর স্থানীয় প্রভাবশালীরা জবরদখল করেছে ৬০ একর। অথচ এখানেই বিনিয়োগ হওয়ার কথা বলেছে আট হাজার কোটি টাকা। ফলে হুমকিতে পড়েছে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ। যার প্রমাণ ইতিমধ্যে কেইপিজেডে আগ্রহ নিয়ে বিনিয়োগ করতে আসা বিশ্বখ্যাত ইলেকট্রনিক্স প্রতিষ্ঠান স্যামসাংয়ের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া।
অবশ্য এখনো অপেক্ষায় আছে সুইজারল্যান্ড, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার বেশ কিছু কোম্পানি। কিন্তু সব কোম্পানিই তাদের বিশাল বিনিয়োগের আগে জমির মালিকানা স্বত্ব কেইপিজেডের নামে আছে কি না, তা নিশ্চিত হতে চায়।

chardike-ad

বিনিয়োগ বোর্ড সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়ার সরকারের যৌথ সমঝোতার পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার ১৯৯৮ সালে ইয়াংওয়ান করপোরেশনকে কেইপিজেড পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। পরে ১৯৯৯ সালে ইয়াংওয়ান করপোরেশনকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরে দুই হাজার ৪৯২ দশমিক ৩৫ একর জমির দখল বুঝিয়ে দেয়। তখন বেঁধে দেওয়া দর হিসাব করে কেইপিজেড সরকারকে ৬৫ কোটি টাকা পরিশোধও করে। একই বছর ৭ অক্টোবর কেইপিজেডের গেজেট প্রকাশ করা হয়। ৩০ অক্টোবর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেইপিজেড আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন।

কিন্তু কারখানা ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের জন্য যে পরিবেশগত ছাড়পত্র দরকার, তা পেতে লেগে যায় ১০ বছর। ২০০৯ সালের নভেম্বরে পরিবেশ ছাড়পত্র পাওয়ার পর কেইপিজেড অবকাঠামো নির্মাণ শুরু করে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অভাবে অন্ধকারে দীর্ঘ সময় পড়ে থাকা কেইপিজেড ঘিরে একটি মহাপরিকল্পনার (মাস্টারপ্ল্যান) আওতায় এ পর্যন্ত দেড় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। ইতিমধ্যে কেইপিজেডে ইয়াংওয়ান কারখানা স্থাপনের জন্য ২৫ লাখ বর্গফুট আয়তনের সাতটি ভবন নির্মাণ করেছে। আরও ২২টি ভবনের নির্মাণ কাজ প্রায় শেষের দিকে বলে জানা গেছে।

ইতিমধ্যে ২৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ হয়েছে। ১৬ কিলোমিটার বৈদ্যুতিক সংযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। পাঁচ হাজার নারীশ্রমিক থাকার জন্য ১২টি আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এতে কর্মসংস্থান হয়েছে ১১ হাজার মানুষের। এক বছরের মধ্যে আরও ৪৩ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে তারা আশা করছেন। আগামী আট বছরের মধ্যে আরও আট হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আনার পরিকল্পনাও করেছে ইয়াংওয়ান। এই পরিকল্পনা সফলভাবে এগোলে এখানে মোট তিন লাখ মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান গড়ে উঠবে। ইয়াংওয়ানের চেয়ারম্যান কিহাক সাং গত সপ্তাহে বলেছেন, আমরা অনেক জমি নিয়ে বসে আছি বলে একটি ধারণার কথা শোনা যায়। কিন্তু এখানে ২০ লাখ গাছ লাগানো হয়েছে। জলাধার তৈরি করা হয়েছে। ২৫ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি হয়েছে। কারণ পরিবেশ অধিদফতরের নিয়মানুযায়ী বাধ্যতামূলকভাবে ৩৩ শতাংশ জমিতে বনায়ন করতে হয়েছে, ১৯ শতাংশ জমি জলাধার ও খালি জায়গার জন্য রাখতে হয়েছে। ফলে কারখানা ও অন্যান্য অবকাঠামোর জন্য জমি থাকবে এক হাজার ২০০ একরের মতো। এ জমির আবার ৩০ শতাংশ (৩৬০ একর) রাস্তা, পরিসেবা ও আনুষঙ্গিক সহযোগী অবকাঠামোর জন্য ব্যয় হবে। অর্থাৎ কারখানা করা যাবে সর্বসাকুল্যে ৮৪০ একর জমিতে। কিহাক সাং বলেন, কারখানার জন্য ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। আর একটা শুষ্ক মৌসুম পেলেই উন্নয়ন কাজ শেষ হয়ে যাবে।

জানা যায়, দক্ষিণ কোরিয়ার বিশ্বখ্যাত কোম্পানি স্যামসাং ২০০৯-১০ সালে কেইপিজেডে বিনিয়োগের জন্য আসে। তারা সেখানে ইলেকট্রনিক পণ্য তৈরির কারখানা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য জমি চায়। পরে সুইজারল্যান্ড, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার আরও কয়েকটি কোম্পানি কেইপিজেডে কারখানা স্থাপনের জন্য জমি চায়। কিন্তু সব কোম্পানিই জমির মালিকানা স্বত্ব কেইপিজেডের নামে আছে কি না, তা নিশ্চিত হতে চায়। পরে স্যামসাং জমির নিশ্চয়তা না পেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চলে যায় ভিয়েতনামে। শুধু তাই নয়, স্যামসাংকে দেখে দক্ষিণ কোরিয়ার অনেক প্রতিষ্ঠান ভিয়েতনামে যাচ্ছে। পরে ইয়াংওয়ান করপোরেশন নিজেরাই ২০১১ সালে এশিয়ার বৃহত্তম জুতার কারখানা কর্ণফুলী সু ইন্ডাস্ট্রি স্থাপনের কাজ শুরু করে সেখানে। এ ছাড়া তৈরি পোশাক, ব্যাগ ও নানা ধরনের শিল্পপণ্য তৈরির কারখানা স্থাপন করা হয়েছে। ২০১৮-১৯ সালের মধ্যে তারা মোট ৪০ লাখ বর্গফুট কারখানা স্থাপন করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, স্যামসাং বিনিয়োগ করবে না-এমন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো জানায়নি। অর্থাৎ তাদের আগ্রহ এখনো আছে। জমির সমস্যা মিটে গেলে তারা আবার আসতেও পারে। শুধু স্যামসাং নয়, দক্ষিণ কোরিয়ার এলজি ছাড়াও জাপান ও ভারতের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছেন। এ ছাড়া সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, নরওয়ে, নেদারল্যান্ডসসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা কেইপিজেড ঘুরে দেখার পর সেখানে বিনিয়োগের সম্ভাবনা নিয়ে তাদের উৎসাহের কথা জানান। বিশেষ করে সেখানে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ব্যবস্থা তাদের আকৃষ্ট করেছে। রাষ্ট্রদূতরা জানিয়েছেন, তারা তাদের বিনিয়োগকারীদের এখানে আসতে উৎসাহিত করবেন। কেইপিজেডের সাফল্য বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি মডেল হতে পারে বলেও মনে করেন রাষ্ট্রদূতরা।
সূত্রমতে, জমির মালিকানা সমস্যার জন্য যেখানে বিনিয়োগ আটকে আছে সেখানে জমির সমস্যা সমাধান না করে উল্টো জমি ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে।

সম্প্রতি কেইপিজেডকে ৫০০ একর জমির মালিকানা দিয়ে বাকি জমি ফেরত নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কেইপিজেডের চেয়ারম্যান কিয়াক সুং কোরিয়ান সরকার বাংলাদেশ ও কোরিয়ান ইপিজেডের সহায়তা করতে অঙ্গীকারবদ্ধ উল্লেখ করে বলেন, আমি মনে করি না জমি ফেরত নেওয়ার যে খবর পত্রিকায় এসেছে, তা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। কেননা- কেইপিজেড একটি সমন্বিত প্রকল্প। আমরা জমি ৫০০ একর করে নিতে পারি না। এভাবে এটা সম্ভব নয়। এখানে আমরা সংযোগ শিল্প করতে চাই। গত ১৬ বছরে আমরা এখান থেকে কোনো টাকা কামাতে পারিনি। এক্ষেত্রে আমি সরকারের সহায়তা চাই। এ ছাড়া সরকার আইনত জমি ফেরত নিতে পারে না। আমরা আইন ও চুক্তি দিয়ে সুরক্ষিত। এটা খুবই অবাস্তব সিদ্ধান্ত হবে। এটা দেশকে আঘাত করবে। এটা আত্মঘাতী হবে। ঢাকার দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ীরাও বলছেন, এমনিতেই দেশে বিদেশি বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভালো নয়। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশের বিনিয়োগ এবং শিল্প পরিস্থিতি নিয়ে ভাবমূর্তির সংকট তৈরি হয়েছিল। এটা কাটাতে আমাদের অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে। এর সঙ্গে যদি কোরিয়ান ইপিজেডের কাছ থেকে জমি কেড়ে নেওয়ার বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলে যায়, তাহলে তা দেশের বিনিয়োগে বিদেশিদের নিরুৎসাহিত করবে।

সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন


korean-epz কোরিয়ান ইপিজেডে দেড় যুগের হতাশা
কোরিয়ান ইপিজেড বাংলাদেশ-দক্ষিণ কোরিয়া সম্পর্কের সেতুবন্ধন হতে পারত। কোরিয়ান ইপিজেড দিয়েই কোরিয়া হতে পারত বাংলাদেশের এক নম্বর বিনিয়োগকারী দেশ। দেড় যুগ ধরে শুধু সম্ভাবনার কথা শুনে যেতে হচ্ছে। নানা সমস্যা আর হতাশার মধ্য দিয়ে চলতে থাকা কোরিয়ান ইপিজেডকে নিয়ে…