Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

মালয়েশিয়ায় নির্যাতিত বাংলাদেশি কিশোরীর রোমহর্ষক বর্ণনা

Bangladeshi_girlরিনার (ছদ্মনাম) গ্রাম ঢাকা থেকে দুই ঘণ্টা। চৌদ্দ বছর বয়সে স্কুল ছাড়েন তিনি। তার জবানিতে, ‘বাবার শরীর ভাল ছিলো না। আমি নিজেই আর স্কুলে যেতে চাইনি বরং কাজে যোগ দিতে চাই।’

২০১২ সালে শিক্ষার্থী ভিসায় একজন বাংলাদেশি তাকে মালয়েশিয়া নিয়ে আসেন। এরপর মালিক এবং তার স্ত্রীর হিংস্র নির্যাতনের শিকার হন রিনা। রিনা এক সময় নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে রক্তাক্ত শরীর নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যান।

chardike-ad

সম্প্রতি ইউনাইটেড ন্যাশনস হিউম্যান রাইটসের ‘আই অ্যাম নট হেয়ার’ নামে একটি ভিডিওচিত্রে নির্যাতিত হওয়ার রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন রিনা। তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া নির্যাতনের বিরুদ্ধে মামলা লড়ছে মালয়েশিয়ায় অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা তেনেগানিতা।

মালয়েশিয়ায় কাজ করতে যাওয়া সেই বাসায় নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে রিনা ওই ভিডিওচিত্রে বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় আমি কখনো পাসপোর্ট হাতে পাইনি। একবার একটি ব্যাগে দেখেছিলাম। মালিক বলেছিলেন, আমারে প্লেনের টিকিট থেকে শুরু করে সব খরচ তিনি দিয়েছেন। কাজ করে যে বেতন পাবো, সেখান থেকে কেটে রাখা হবে।’

তেনেগানিতার পরিচালক ও কনসালট্যান্ট (মানবপাচার) এইজেল ফার্নান্দেজ বলেন, অবশ্যই যার পাসপোর্ট তার কাছে থাকার কথা। কিন্তু নির্যাতনকারীরা তার পাসপোর্ট রেখে দিয়েছিলো।

মালয়েশিয়ায় ওই পরিবার সম্পর্কে রিনা বলেন, দুই সন্তানসহ তাদের ৪ জনের সংসার। তাদের দেখে বেশ সুখী পরিবার মনে হয়েছিল। পুরুষ মালিক ছিলেন আমার মতোই বাংলাদেশি, তিনি একজন মালয় নারীকে বিয়ে করেছিলেন।’

নির্যাতনের শুরু থেকে হৃদয় বিদারক ঘটনার বর্ণনা দেন রিনা। তিনি বলেন, ‘একদিন রাতে ছোট শিশুটির ডায়াপার আমি দুবার পরিবর্তন করে দেই। এরপর থেকে নির্যাতনের শুরু হয়। পরিবারের কর্তা আমায় শক্ত করে ধরেন। তার স্ত্রী আমার প্যান্ট খুলে নেন এবং আমার যোনিপথে গরম পানি ঢেলে দেন।’

এ ধরনের নির্যাতনেও থামেনি তারা। রিনার বর্ণনায়, ‘তারা আমার কাপড় টেনে-হিঁচড়ে খুলে নিতেন, ছবি তুলতেন এবং ভিডিও করতেন। বলতেন, তাদের কথামতো না চললে, এসব ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়া হবে। আমার বাবা-মা ও গ্রামবাসী লজ্জায় মুখ দেখাতে পারবে না।’

নির্যাতনের বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘তারা ২ থেকে ৩ বার আমার পুরো শরীরে মরিচের গুড়ো মাখিয়ে দিয়েছিল। এমনকি যোনিপথে ঘষে দিতো। আবার কোন সময় আমাকে মরিচের গুঁড়া খেতে বলা হতো। খেতে না চাইলে মারধর করতো। উপায় না দেখে খাওয়ার পরে অনেক সময় বমি হতো। তখন তারা আমাকে নিজের বমি খেতে বাধ্য করতো।’

রিনা বলেন, ‘আমার মুখ বেঁধে বিছানায় ফেলে দেয়া হতো। পুরুষটি আমার বুকের ওপর বসে পা দুটো উপরে তুলে ধরতো। তার স্ত্রী আমার যোনিপথে একটি লাঠি ঢোকাতো এবং বের করতো।’

তেনেগানিতার প্রোগ্রাম ম্যানেজার লিভা শ্রোধারান বলেন, বাঁশের কঞ্চি ঢোকানো এবং বের করার ফলে তার যোনিপথ ছিড়ে যায়।’

রিনা বলেন, ‘আমার প্রস্রাবের রাস্তা এবং পায়ুপথ এক হয়ে যায়। আমি ওই বাসা থেকে পালিয়ে বের হতে পারতাম না। সকালে উঠে দেখলাম পুরো বিছানা রক্তে ভেসে আছে। তারা আমাকে সবকিছু পরিষ্কার করতে বলে এবং আমার শরীর ও রক্তও ধুতে বলে।’

এইজেল বলেন, মূল জায়গাটাই ছিল পাসপোর্ট। তারা রিনাকে এই বলে ভয় দেখাতো, ‘তোমার পাসপোর্ট নেই। ফলে বাসা থেকে বের হলেই তোমাকে ইমিগ্রেশন বা পুলিশ ধরবে। এরপর ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো হবে। সেখানে আরো বেশি নির্যাতনের শিকার হবে।’

রিনা বলেন, ‘আমার শরীর থেকে এতো বেশি রক্ত বের হতো যে আমাকে ডায়াপার পরে থাকতে হতো।

লিভা বলেন, ‘ডায়াপারের বিভিন্ন অংশ যোনিপথে আটকে যায়। সে স্থানটিকে ঠিক করতে ৩ মাস হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল।

তেনেগানিতার সিনিয়র স্বেচ্ছাসেবক প্রোগ্রাম অফিসার আশিকুর রহমান বুধবার সকালে বলেন, এমন অবস্থায় আর সহ্য করতে না পেরে বাসা থেকে দৌড়ে বের হয়ে আসেন রিনা। বাসার কাছেই একটি রেস্টুরেন্টে এলে একজন ইন্দোনেশিয়ান কর্মচারী তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। এর আগেই রিনা সেখানে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান। সেই বাসায় এক বছরের কম সময় ছিল রিনা।

রিনা বলেন, ‘হাসপাতালে যখন সবকিছু খোলা হলো প্রচুর রক্ত ঝরছিল। তারা আমার পাকস্থলি এবং যোনিপথ পরীক্ষা করলো। আমি জানি না তারা কি করছিল, তবে তাদের দেখে চিন্তিত দেখাচ্ছিল।’

এইজেল ফার্নান্দেজ বলেন, ‘তার তিনটি বড় ধরনের অস্ত্রপচার করা হয়। পাকস্থলি, যোনিপথ এবং কানে। কারণ নির্যাতনকারীরা তার কানের ওপরে প্রচুর আঘাত করেছিলো।’

রিনা বলেন, ‘আমি ভাবছিলাম, যদি মারা যাই তবে ঠিক আছে। কিন্তু আমি সেখানে আর ফেরৎ যেতে চাই না।’

তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে আমাকে দেখতে মালিকের শাশুড়ি ও শ্যালিকা আসেন। তারা মালিককে ফোন দিয়ে আমাকে কথা বলার জন্য ধরিয়ে দেন।

এইজেল বলেন, মালিক পক্ষ ছিলেন বিত্তশালী এবং সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাই সমাজ অভিবাসী শ্রমিকের থেকে তাদের কথাই বেশি শুনবে।

রিনা বলেন, মালিক আমাকে ফোনে বলেন- তুমি কি ভেবেছো আমি এখনো কারাগারে? আমি বাইরে। আমার টাকা আছে এবং সবাই আমার পক্ষে থাকবে। আমি চাই না তুমি আইনি প্রক্রিয়ায় যাও। আর তুমি যদি আমার বিরুদ্ধে মামলাও করো, আমার কিছুই করতে পারবে না। আমি যে কাউকে টাকা দিতে পারবো। এবং সবাইকে ম্যানেজ করে ফেলবো।’

রিনা বলেন, এ ঘটনার কিছুদিন পর আমাদের এলাকা থেকে একজন চেয়ারম্যান আসেন। আমার মা তাকে বলেছিলেন, আমার সঙ্গে দেখা করে কথা বলার জন্যে। আমি তাকে আমার ওপর বয়ে যাওয়া ঝড়ের বর্ণনা দেই। তিনি চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলেন এবং আমাকে মামলার জন্য বলেন।’

এইজেল বলেন, ‘মালিকপক্ষ পুরো মামলা ভেস্তে দিতে চায়।’

রিনা বলেন, ‘এরপর আমি ১৪ দিন তেনেগানিতার আশ্রয়ে ছিলাম। সেখান থেকে পুলিশ আমাকে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। একদিন মিমি নামে সরকারি আশ্রয় ক্যাম্পের একজন আমাকে ডাকেন। তিনি দুটি কাগজ দেন। একটি সাদা, অন্যটিতে কিছু লেখা। তিনি আমাকে কাগজগুলোতে স্বাক্ষর দেয়ার জন্যে জোর করতে থাকেন।’

এইজেল বলেন, ‘আমরা কোর্টে যাওয়ার পরে শুনতে পাই মেয়েটি মামলা উঠিয়ে নিয়েছে। এটা হতে পারে না। একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে তার মামলা উঠিয়ে নেবে, এটা কিভাবে মানা যায়?

রিনা বলেন, ‘আমার মনে হয়, যদি দেশে কিছু টাকা পাঠাতে পারতাম ভাল হতো। আমি দেশে যাওয়ার পক্ষে। তবে আমি পরিবারকে আমার বোনের মতোই কিছু সাহায্য করতে চাই। আমি অবশ্যই বাড়ি যেতে চাই, তবে এখন না। আমি তিন বছর ধরে এখানে আছি। অথচ বাড়িতে কোন টাকা পাঠাতে পারিনি।

আশিক বলেন, সব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে আবারো মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে তেনেগানিতা।(বাংলানিউজ)