Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

ফেসবুকিস্তান নামে নতুন রাষ্ট্র তৈরি হচ্ছে!

facebookনতুন রাষ্ট্র তৈরি হচ্ছে। নাম ‘ফেসবুকিস্তান’। পৃথিবীর প্রায় সব দেশ থেকেই কিছুটা করে অংশ নিয়ে তৈরি হবে এই ‘ফেসবুকিস্তান’। এখনই জনসংখ্যা দেড়শো কোটি। রাষ্ট্রসংঘের বিরোধিতা করারও প্রশ্ন নেই। রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার আগে তার ভাবী শাহেনশা কিছু দিন আগেই ভারত ঘুরে গেলেন।

বিরোধীরা ইতিমধ্যেই জিগির তুলেছেন, কেবল একটা দেশ গড়েই ক্ষান্ত হবেন না এই শাহেনশা। গিলে খাবেন গোটা বিশ্বকেই। যদিও এদেশে এসে ‘ফেসবুকিস্তানে’র ভাবী শাহেনশা মার্ক জুকারবার্গ অবশ্য বলে গিয়েছেন, “ভারতের সঙ্গে তাঁর কোম্পানির সম্পর্ক বহু পুরানো।” একবার নাকি চরম বিপদে পড়েছিলেন। চলছিল আর্থিক টানাটানি। ভারতেই সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে পেয়েছিলেন। তাই ভারতের গরিব মানুষের জন্য কিছু করতে চান।

chardike-ad

তা ঠিক কী করতে চান তিনি? ২০১৫ সালের শুরুতে মার্ক জুকারবার্গের সংস্থা ফেসবুক একটা প্রকল্প নেয়। যার মূল কথা, কম খরচে উন্নয়নশীল দেশে ইন্টারনেট পরিষেবা দেওয়া। নাম দিয়েছিলেন internet.org। কী আছে এই প্রকল্পে? এটি মূলত একটি ইন্টারনেট পরিষেবা। যার মাধ্যমে বিনামূল্যে বেসিক ইন্টারনেট পাবেন মানুষ। ফেসবুকইহ্নডিয়া তো বটেই, সঙ্গে মিলবে উইকিপিডিয়া, হোয়াটসঅ্যাপের মতো কয়েকটি ওয়েবসাইটের প্রাথমিক সংস্করণ। ভারতে এসে গত মাসে জুকারবার্গ জানালেন, “আফ্রিকা মহাদেশে এই প্রকল্প সফল। ভারতের উন্নয়নেও আমরা সাহায্য করতে চাই।”

তবে জুকারবার্গ দেশ ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ‘সাম্রাজ্যবাদ’-বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছেন। মূলত চারটি প্রশ্ন তাঁদের।

এক, বেসিক ইন্টারনেটের অছিলায় আসলে ডিজিটাল জাতপাত তৈরির চেষ্টা করছেন জুকারবার্গ। যুক্তি হিসাবে তাঁরা বলছেন, ২০১৫ সালে ভারতে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা সাড়ে ১৩ কোটি। ২০১৯ সালে গিয়ে তা দাঁড়াবে ২৭ কোটিতে। অর্থাৎ ফেসবুক ব্যবহারকারী অগ্রসর দেশগুলির মধ্যে ভারত এই মুহূর্তে প্রথম তিনে না থাকলেও ২০১৯ সাল নাগাদ পরিস্থিতি বদলাবে। ফেসবুক ব্যবহারকারী দেশ হিসাবে প্রথম হবে ভারত।
এখানেই বিরোধীদের প্রশ্ন। তার মানে নিজের সাম্রাজ্য নিশ্চিত করতে ‘বিনামূল্যে’ (প্রাথমিকভাবে বিনিপয়সায়, পরে টাকা লাগবে) ইন্টারনেট দেবে ফেসবুক। হিসাবটা পরিষ্কার। যত বেশি ক্রয়ক্ষমতা তত বেশি বিক্রি। ঠিক সেভাবেই যত বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী তত বেশি ফেসবুক গ্রাহক। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পরিকল্পনার মাস্টারস্ট্রোক। কী রকম? বিনামূল্যের বেসিক প্যাকেজে থাকছে হাতে গোনা তিন-চারটি ওয়েবসাইটের ছাড়পত্র। এর মধ্যে ফেসবুক আবশ্যিক। অর্থাৎ যা-ই চান না কেন, তা কখনই ফেসবুককে বাদ দিয়ে নয়। আর এখানেই রয়েছে সূক্ষ্ম প্যাঁচ, আজ যা ফ্রি কালই তার জন্য গুনতে হবে নগদনারায়ণ। ফ্রিতে যা পাবেন তা সর্বস্ব নয়। অর্থাৎ পরোক্ষে, ফেল কড়ি, তবেই মাখো ‘সম্পূর্ণ’ তেল। শেষ পর্যন্ত, কেউ পাবে সব, কেউ পাবে কম। ‘সাম্রাজ্যবাদ’-বিরোধীদের মতে, এখানেই ডিজিটাল জাতপাত। উচ্চ জাতের (ট্যাঁকের জোরের ভিত্তিতে) কাছে সব খোলা, আর ছোটো জাতের কাছে সীমিত।

দ্বিতীয় অভিযোগ, এই প্রকল্প আসলে গোটা ইন্টারনেট দুনিয়ার দখল নেওয়ার ফিকির। প্রশ্ন উঠছে, পশ্চাদপদ দুনিয়ার তথ্য জানার অধিকারের দাবিতে রাষ্ট্রসংঘের গঠিত ম্যাকব্রাইড কমিশন থেকে আজ পর্যন্ত ফ্রি বলতে সত্যিই কি কিছু বোঝায়? এক অক্সিজেন ছাড়া! সে রকমই ফেসবুকই বা ফ্রি দিচ্ছে কোথায়? আজ বাদে কাল ঠিক টাকা নেবে। ‘সাম্রাজ্যবাদ’-বিরোধীদের মতে, বিনিময়ে ইউজেস অ্যান্ড গ্র্যাটিফিকেশন তত্ত্ব মেনে ইন্টারনেট ব্যবহার করার স্বাদ পাইয়ে আসলে গ্রাহক ধরে ইন্টারনেট দুনিয়াটাকেই গিলে খেতে চাইছেন ‘ফেসবুকিস্তানে’র শাহেনশা।

তৃতীয় অভিযোগ, ফেসবুক আসলে কিছুই করছে না। সব ঝক্কি তো যাবে মোবাইল পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থার ঘাড় দিয়ে। যুক্তি, গ্রামেগঞ্জে ইন্টারনেট বেলুন বা টাওয়ার যাই বসাক ফেসবুক, সবটাই করবে টেলি অপরেটর সংস্থাগুলি।

চতুর্থ অভিযোগ, সবার জন্য ইন্টারনেট দিতে ফেসবুকের দরকার নেই। সরকারি স্তরেই তো সকলের জন্য ইন্টারনেট দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

মজার ব্যাপার, এই চার দফা চোখা প্রশ্নের মুখে পড়েও ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা উত্তর দিয়েছেন অবলীলায়, তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে। বলেছেন, বর্তমান ভারতে ই-বাণিজ্য এক অদ্ভুত অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। জনসংখ্যা প্রচুর, তবে এখনও পর্যন্ত সেখানে ইন্টারনেট পরিষেবা সর্বব্যাপী নয়। ফলে ই-ক্রেতাও নেই। ক্রেতা বাড়াতে সুযোগ দেওয়া উচিত। শাহেনশার মতে মত দিয়ে ফেসবুকপ্রেমীরাও বলছেন, যে দেশে ৮০ শতাংশ মানুষ এখনও ইন্টারনেট পরিষেবার আওতার বাইরে সেখানে প্রাথমিক পাওয়া বা কিছুটা পাওয়াও কি ভালো কথা নয়? একবার স্বাদ পেলে মানুষ তার নিজের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে ইন্টারনেটকে আপন করে নেবে। আর জাতপাত নিয়ে ফেসবুকপ্রেমীদের দাবি, আসল জাতপাত তো ৮০ শতাংশের (ইন্টারনেট পরিষেবা) নেই, আর ২০ শতাংশের আছে। বিভেদ এই অসাম্যের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে। আর দুনিয়া দখল নেওয়া প্রসঙ্গে ফেসবুকপ্রেমীদের বক্তব্য, দুনিয়ার দখলদারি নিয়ে এমনিতেই বহুজাতিক সংস্থাগুলির কারবার চলছে বহু দিন ধরে৷প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে দুনিয়া দখল করে নেওয়াই তাদের ধ্যানজ্ঞান। এদেশের ‘সাম্রাজ্যবাদ’-বিরোধীরা এত দিন গলা ফাটিয়েও তো তা আটকাতে পারেননি (কিংবা হয়তো আসলে চানওনি)৷ সেক্ষেত্রে ফেসবুক বেশিটা দখল করলে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং মিডিয়ার চরিত্র হিসাবে অন্তত নিজের কথা নিজে বলার সুযোগ পাবেন গ্রাহকেরা। আর টেলিকম সংস্থাগুলি তো এখানে অনুঘটক। রাস্তা তো বানান রাস্তা বানাতে জানা দক্ষ মানুষই। সেই রাস্তায় হাঁটেন সাধারণ মানুষ। আর সরকারি প্রকল্প বিষয়ে তাঁদের বক্তব্য, যেভাবে কিছুদিন আগেই চাইল্ড পর্ন ও ভয়্যার ওয়েবসাইট বন্ধ করার জন্য হুইপ জারি করেছিল সরকার তাতে করে সাধারণ মানুষের খুব একটা ভয় পাওয়ার কারণ নেই। আর মোদীর ডিজিটাল ইন্ডিয়া যে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, সে ব্যাপারে সন্দেহ থাকার কথা নয়।

অভিজ্ঞতা বলছে, কর্পোরেট ব্যাবসার নামে নোংরামি-মারামারি এক জিনিস, কিন্তু সুস্থ বাণিজ্যের লাভের পথেই উন্নয়ন ক্রমে সর্বজনীন হয়। সেখানে সরকারি অনুদান মারফত ভোটবাক্সের রাজনীতির চাইতে প্রফেশনাল এফিসিয়েন্সি, এক্সেলেন্স এবং তার হাত ধরে ইকোনমিক অ্যাফ্লুয়েন্স অনেক অনেক ভালো। আর, কেবল টিভির প্যাকেজিং থেকে শুরু করে মেডিক্লেমের দাক্ষিণ্যে বেসরকারি অভিজাত হাসপাতালে মোটা খরচ সেভিংয়ের যুগে ফেসবুক খানিকটা ব্যবসা করলে ‘উন্নয়ন’ অন্তত ভিরমি খাবে না। অনেক কিছু না-পাওয়ার দেশের নাগরিক যারা, ‘ফেসবুকিস্তানে’র নাগরিকত্ব নিতে তাদের বাধা কোথায়?

সূত্রঃ কল্কাতা২৪x৭