Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

তীব্র অভিমানে বাংলা ছেড়ে গেলেন মিঠুন!

mithunসত্তরের দশকে ‘নকশাল’ ছেলেটা পুলিশের গুঁতো খেয়ে কলকাতা ছেড়ে পালিয়েছিল। ফিরে এসেছিল মুখ উজ্জ্বল করে। নিজের মুখ। বাংলার মুখও। সেই পলায়নের ৪৫ বছর পর আজ আবার তিনি বাংলা-ছাড়া। যে রাষ্ট্রের নজর এড়াতে যৌবনে শহর ছেড়েছিলেন, রাজনীতি আর সারদার হাত ধরে রাষ্ট্রের সেই ভ্রূকুটি-ই আবার ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়েছে তাঁর জীবনে। বৃত্ত সম্পূর্ণ, অতএব আবার প্রস্থান।

এ বার অবশ্য তাঁকে কেউ চলে যেতে বলেনি। বরং ঘনিষ্ঠরা, পরিচিতরা তাঁকে চাইছেন বাংলায়। কিন্তু তিনি কোথাও নেই। ফোনে যোগাযোগ করা যায় না। দেখা পাওয়া যায় না। সোশ্যাল মিডিয়ায় নেই। বিলকুল বেপাত্তা। এমনকী তাঁর স্ত্রী যোগিতা, ছেলে মিমো বা পরিবারের অন্যরাও আর কলকাতার পথ মাড়াচ্ছেন না। তিনি মিঠুন চক্রবর্তী। এক সময়ে ছিলেন জোড়াবাগানের গৌরাঙ্গ। পরে বলিউডের সুপারস্টার মিঠুন। শেষমেশ তৃণমূলের টিকিটে রাজ্যসভার সাংসদ। গত লোকসভা নির্বাচনে বাংলা জুড়ে ঝড়ের মতো প্রচারাভিযান। তার পর হঠাৎ তিনি সবার নেটওয়ার্কের বাইরে।

chardike-ad

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বৃহস্পতিবারই বলেছেন, তাঁর দলের সাংসদ মিঠুন তাঁর সঙ্গে এখন কোনও যোগাযোগই রাখেন না। এই অনুযোগ আরও অনেকেরই। দীর্ঘ দিনের পরিচিত সাংবাদিক, সহকর্মী, ঘনিষ্ঠ-সহ কলকাতার অনেকেই বহু চেষ্টাতেও আর নাগাল পাচ্ছেন না মিঠুনের। ফোন তো করেনই না, ধরেনও না। সংসদে প্রত্যেকটি অধিবেশন শুরুর আগে মিঠুন চক্রবর্তীর কাছ থেকে অনুপস্থিতির কারণ দর্শিয়ে একটি চিঠি আসে রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের কাছে। তাতে শারীরিক অসুস্থতার কথা বলা হয়।

অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেটের (ইডি) মিঠুন-ঘনিষ্ঠ অফিসারকে ধরে বহু কসরতে ‘মহাগুরু’র সঙ্গে সামান্য যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছে কখনও সখনও। সম্প্রতি সংসদের প্রোটোকল দফতরে সাংসদ হিসাবে পাওয়া বিশেষ পাসপোর্টটিও (ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্ট) ফেরত দিয়েছেন মিঠুন। জানিয়েছেন, সাধারণ পাসপোর্টে সফর করতেই তিনি বেশি স্বচ্ছ বোধ করবেন।

কেন এই মুখ ফেরানো? কীসের এত অভিমান? এই মিঠুন কি সেই মিঠুন যিনি— বালসাহেব ঠাকরে যখন মরাঠা হৃদয়পুরের একমেবমাদ্বিতীয়ম অধিপতি, ‘আমচি মুম্বই’ স্লোগানে যখন মুম্বইয়ের অলিগলি সরগরম, ঠিক তখনই সৌরভকে বাদ দিয়ে কাম্বলীকে ভারতীয় দলে নেওয়ার প্রতিবাদে মুম্বইয়ে বসেই গর্জন করেছিলেন! হকচকিয়ে গিয়েছিলেন বালসাহেবও। মিঠুনের সঙ্গে সুসম্পর্কের সুবাদে তাঁকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, মুম্বইয়ে বসে মরাঠি ক্রিকেটারের বিরুদ্ধে মুখ খোলার মতো হঠকারিতা কেন? মিঠুন জানিয়েছিলেন, মরাঠি ক্রিকেটারের বিরুদ্ধে নয়, বাঙালি ক্রিকেটারের প্রতি বঞ্চনার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন তিনি।

বাংলা বঞ্চিত হচ্ছে দেখলেই তিনি গর্জন করবেন, বলে এসেছিলেন সোজাসাপটা। মিঠুনের এই আবেগকে সম্মান না দিয়ে পারেননি বালসাহেবও। শিবসেনার স্বভাবসিদ্ধ উগ্রতা মিঠুনকে আর আঘাত করেনি। মানুষটা এক সময় বাঙালি ফৌজ গড়ার স্বপ্ন দেখতেন। বাংলার মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য টাকা জোগাড় করতেন নানা উপায়ে। উন্নয়নের কাজে, মানুষের ব্যক্তিগত বিপদে মুম্বইবাসী মিঠুনকে বহু বার পাশে পেয়েছে এই বাংলা। ঘনিষ্ঠরা বারণ করতেন। কানে তোলেননি।

এখন ঘনিষ্ঠরা কাছে পেতে চাইছেন তাঁকে। কিন্তু তিনি ৩৬০ ডিগ্রি বিমুখ। কেন? মিঠুনের কাছের মানুষদের দাবি, তিনি নিজেকে প্রতারিত মনে করছেন। সারা জীবন ধরে অপার বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছিলেন মিঠুন চক্রবর্তী। বছরের পর বছর তিনি ছিলেন বলিউডের সর্বোচ্চ করদাতা। নিজের স্বচ্ছতাকেই নিজের আসল স্টারডম বলে মনে করতেন। তাঁর মনে হচ্ছে, সেই বিশ্বাসযোগ্যতায় আজ তুমুল ধাক্কা লেগেছে। আর্থিক কেলেঙ্কারির মামলায় ইডি জেরা করেছে মিঠুনকে! তাঁর নামে নানা গুঞ্জন ছ়়ড়িয়েছে। সইতে পারেননি মিঠুন। সারদা থেকে পাওয়া সমস্ত টাকা ফিরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তার পরেও ফিরে পাননি পুরনো আত্মবিশ্বাস।

গুটিয়ে নিয়েছেন নিজেকে। কারও মুখোমুখি হতে চান না। মিডিয়ার মুখদর্শন করেন না। নিজের ফিল্মের প্রোমোশনেও যান না। আশঙ্কা, যদি অস্বস্তিকর প্রশ্নটা করে বসে কেউ? যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে— আপনি কি বেআইনি টাকার ভাগীদার? মিঠুন-ঘনিষ্ঠ এক নেতার কথায়, ‘‘প্রথম দিন সংসদে শপথ নিতে এসেই মিঠুন বলেছিলেন যে তিনি হাসতে ও হাসাতে পছন্দ করেন। সংসদ তাঁর কাছে একটু গা ছমছমে ঠেকছে! বাস্তবেও সাংসদ পদটি যে তাঁর কাছে ভীতিপ্রদ হয়ে দাঁড়াবে কে ভেবেছিল!’’ কাছের লোকেরা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, কেউ এত বড় ভিলেন ভাবছে না প্রিয় নায়ককে! কিন্তু মিঠুন নিশ্চিন্ত হতে পারেননি।

হবেন কী করে? এ বঙ্গে বহু লব্ধপ্রতিষ্ঠ মানুষের সঙ্গে দীর্ঘ সুসম্পর্ক তাঁর। তাঁদের কেউ তো মিঠুনের হয়ে মুখ খুলতে এগিয়ে আসেননি। মিঠুনের ঘনিষ্ঠ মহলের দাবি, সেই তীব্র অভিমানেই বাংলা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন মিঠুন। যে রাজ্যের জন্য এত কিছু করেছেন, সেই রাজ্য দুঃসময়ে এমন মুখ ফেরাল! তা হলে কেন আসব এই রাজ্যে? কেন যোগাযোগ রাখব এখানকার মানুষগুলোর সঙ্গে? নিজের প্রশ্নেই আজ বিদ্ধ তারকা! যদিও এই আচম্বিত বানপ্রস্থের এত সহজে ব্যাখ্যা হয় না।

বাম আমলে রাজ্যের দাপুটে মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর ঘনিষ্ঠ ছিলেন মিঠুন। সুভাষবাবুর মধ্যস্থতায় বা অনুরোধে দীর্ঘকাল নিজেকে অকাতরে বিলিয়েছেন। কিন্তু বামফ্রন্ট সরকারের কাছ থেকেআনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাননি। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভাল ছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। কলকাতায় একটা বাসস্থানের দাবি ছিল মিঠুনের। পাননি। আপনার না মাইসোরে বাড়ি রয়েছে! আপনার না উটিতে হোটেল রয়েছে— কলকাতায় স্থায়ী ঠিকানা চাইলেই এমন কথা শুনতে হয়েছে মিঠুনকে। নিজেকে বঞ্চিত মনে করতে শুরু করেছিলেন মিঠুন।

বাম জমানার শেষ দিকে তাই বাংলার সরকারের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ তলানিতে পৌঁছে যায়। এমনই সন্ধিক্ষণে তৃণমূলের অভিষেক। অনেকেই মিঠুন চক্রবর্তীকে বোঝাতে শুরু করেন, জীবনে যা কিছু পাননি, তার জন্য লড়বে তৃণমূল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবমূর্তি তখন আপসহীন সংগ্রামীর। ভরসা খুঁজে পেয়েছিলেন মহাগুরু। আসলে সরকারি স্বীকৃতি একটা বড় ব্যাপার তাঁর জন্য। যে ছেলেটা রাষ্ট্রের গুঁতো খেয়ে শহর ছেড়ে পালিয়েছিল, রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায় করা তার কাছে আকুতির মতো। এখনও একটা ‘পদ্ম’ সম্মান জোটেনি। বলিউডে তাঁর চেয়ে সব অর্থেই যাঁরা অনেক জুনিয়র, তাঁরা যে সব পদক গলায় ঝুলিয়ে ঘুরছেন, মিঠুনের নাম বারবার সে সবের দোরগোড়ায় পৌঁছেও ফিরে এসেছে।

ঘনিষ্ঠরা বলেছিলেন, বাঙালির অন্যতম সেরা ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডরের জন্য রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আদায় করা মমতার পক্ষেই সম্ভব। যাঁরা মিঠুনকে এ কথা বুঝিয়েছিলেন, শোনা যায় কুণাল ঘোষ তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। মমতার সঙ্গে মিঠুনের দেখাও করিয়েছিলেন কুণালই। সেই কাছে আসা শুরু। তার পর তৃণমূলের টিকিটে মিঠুনের সংসদে পৌঁছনোর ইতিহাস সকলেরই জানা। কিন্তু তার পর? রাষ্ট্রীয় সম্মান অধরাই থেকে গিয়েছে। বাঙালির জন্য, বাংলার জন্য কাজ করার স্বপ্ন ছিল। হয়নি। ‌

যখের ধনের মতো আগলে রাখা বিশ্বাসযোগ্যতাটুকু ছিল। রাজনীতির ছোবল গিলে খেল তাকেও। মানতে পারছেন না মিঠুন। মুম্বইতে মাড আইল্যান্ডের বাংলো থেকেও আজকাল বেরতে দেখা যায় না মিঠুনকে। ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে যান না। কলকাতায় শেষ বার শ্যুটিংয়ে এসে রাজারহাটের শ্যুটিং ফ্লোরেই থেকে গিয়েছিলেন। হোটেলে ওঠেননি। পরিচিতদের সঙ্গে দেখা করেননি। কিছু দক্ষিণী ছবিতে কাজের কথাবার্তা চলছে। কিন্তু সন্তর্পণে, অতি লো প্রোফাইলে। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় এত রক্তাক্ত হতে বলিউডের আর কাউকে দেখা যায়নি। কিন্তু তিনি মিঠুন চক্রবর্তী। তাই তাঁকে ঘিরে এখন ভেঙে যাওয়া স্বপ্নের ছড়াছড়ি। তাঁর চার পাশে বিভীষিকার সাম্রাজ্য। (আনন্দবাজার পত্রিকা)