Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

কে এই ধর্মগুরু গুরমিত রাম রহিম সিং?

gurumitভারতের ধর্মগুরু গুরমিত রাম রহিম সিংকে শুক্রবার হরিয়ানার একটি আদালত ধর্ষণের মামলায় দোষী সাব্যস্ত করার পর সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত ৩১ জন নিহত হয়েছে। এছাড়া আরও দুই শতাধিক লোক আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

ধর্ষণের দায়ে গুরমিতের সাজা কী হবে, সোমবার আদালত সেই সিদ্ধান্ত জানাবে। তার অাগেই রাস্তায় রাস্তায় গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করছেন রাম রহিম সিংয়ের ভক্তরা। একাধিক রেলওয়ে স্টেশন ও পেট্রোল পাম্পে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় রাজধানী নয়াদিল্লিতেও এই বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে একাধিক বাসে অগ্নিসংযোগের খবর পাওয়া গেছে।

chardike-ad

হরিয়ানা-পাঞ্জাবে অন্তত পাঁচ লাখ সরাসরি ভক্ত রয়েছে গুরমিত রাম রহিম সিংয়ের। তাদের দাবী, সারাবিশ্বে গুরু রাম রহিমের ছয় কোটি ভক্ত রয়েছে।

তবে বিতর্ক সবসময় রাম রহিম সিংকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে; তিনি নিজেও বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। ডেরা সাচ্চা সৌদা নামের একটি সম্প্রদায়ের নেতা তিনি; হরিয়ানার সিরসায় তার প্রকাণ্ড হাই-টেক আশ্রম রয়েছে। তাকে সবসময় ঘিরে থাকে সশস্ত্র ব্যক্তিগত রক্ষীর দল।

শিখ, হিন্দু, মুসলিম সব ধর্মের চেতনার মিশেলেই তৈরি হয়েছে তার ধর্মীয় সম্প্রদায়। ডেরা সাচ্চা সৌদার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। শাহ মস্তানা নামের এক ধর্মগুরু এর পত্তন করেন।

বর্তমান প্রধান গুরমিত সিং ১৯৯০ সালে সম্প্রদায়ের নেতৃত্বের ভার নেন। তিনি একাধারে ধর্মপ্রচারক, সমাজ সংস্কারক, গায়ক, চলচ্চিত্রের নায়ক ও পরিচালক।

gurumitঅনেকগুলো চলচ্চিত্র তিনি প্রযোজনা করেছেন, আর সেই সব চলচ্চিত্রে নিজেই নানা রকম স্টান্ট দেখান তিনি। যেগুলো হরিয়ানা, পাঞ্জাবসহ উত্তর প্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের যুবক, নারীদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়।

বছর কয়েক আগে দেয়া একটি সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন, যুব সমাজ যদি ধর্মীয় আলোচনা সভাগুলোতে আসতে না চায়, তারা সেই সময়ে লুকিয়ে হয়ত সিনেমা দেখতে চলে যায়। তাই আমি সিনেমাহলেই তাদের কাছে পৌঁছে গেছি।

হরিয়ানার সিরসায় তার ডেরা সাচ্চা সৌদা আশ্রমের প্রাঙ্গণে নিয়মিত বসে পপ কনসার্ট। সেখানে গান গেয়ে থাকেন ডেরার প্রধান গুরমিত রাম রহিম সিং নিজেই; তার তুমুল জনপ্রিয় ‘ইউ আর মাই লাভ চার্জারে’র মতো আরও অনেক গান!

চাক-চিক্যময় পোশাক-পরিচ্ছদ পরে গানের ভিডিওতে পারফর্ম করার জন্য তাকে অনেকে ‘রকস্টার বাবা’ নামে অভিহিত করেছেন। তিনি তিনটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন; যেগুলো অনেক বিতর্কের পর কয়েকটি ভারতীয় ভাষায় মুক্তি পায়।

এই সিনেমাগুলোর একটি, এমএসজি : মেসেঞ্জার অফ গড’। চলচ্চিত্রটির ট্রেইলারে সিংকে দেখা যায় বিভিন্ন স্টান্ট পারফর্ম করতে, অন্য গ্রহের বাসিন্দা, ভুত এবং হাতির সঙ্গে লড়াই করতে এবং খলনায়কদের শায়েস্তা করতে।

‘তার সদম্ভে চলা-ফেরাটা নিঃসন্দেহে বলিউডি ধাঁচের, যেটা তাকে ‘সব হিরোর বাপ’ বলে চালাতে যথেষ্ট, দ্য হিন্দুস্তান টাইমস-এর এক পর্যালোচনায় বলা হয়। ‘এমএসজি: মেসেঞ্জার অব গড’ সিরিজের যে সিনেমাগুলোতে বাবা রাম রহিম নিজেই নায়ক গুরুজির অভিনয় করেছেন, হাজার হাজার গাড়ির কনভয় নিয়ে সেই ছবি দেখতে এসে তার ভক্তরা একাধিকবার দিল্লির কাছে গুরগাঁও অচল করে দিয়েছেন!

gurumitভক্তদের সৃষ্ট অশান্তি: তাঁর ভক্ত সমর্থকরা যে সবসময়ে শান্তিপূর্ণ জমায়েত করে, তা নয়। এর আগেও দাঙ্গা হাঙ্গামা থেকে শুরু করে তাদের গুরুজীকে নিয়ে প্রশ্ন তোলায় খুন পর্যন্ত হতে হয়েছে বেশ কয়েকজনকে, এমনটাই অভিযোগ রয়েছে।

১৯৯৮ সালে বেগু গ্রামের একটি শিশু ডেরার জীপে চাপা পড়ে মারা যায়। গ্রামবাসীদের সঙ্গে ডেরার বিরোধ শুরু হয়। আর সেই খবর প্রকাশ করায় সাংবাদিকদের ধমক দেয়া হয়, হুমকি দেয়া হয়। পরে ডেরা সাচ্চা সৌদা আর সাংবাদিকদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির মিটমাট হয়।

যৌন নির্যাতনের অভিযোগ: ২০০২ সালের মে মাসে ডেরা সাচ্চা সৌদার এক নারী ভক্ত গুরমিত রাম রহিমের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ তুলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বেনামি চিঠি পাঠান। তার একটি প্রতিলিপি পাঠানো হয় পাঞ্জাব-হরিয়ানা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছেও।

দু’মাসের মধ্যেই ডেরা সাচ্চা সৌদার পরিচালন সমিতির এক সদস্য রণজিৎ সিং খুন হয়ে যান। পরিচালন সমিতির সদস্যরা সন্দেহ করতেন যে রণজিৎ তার বোনকে দিয়ে ওই বেনামি চিঠি লিখিয়েছিলেন। তার বোন ওই আশ্রমের এক সাধিকা ছিলেন। ওই চিঠির ভিত্তিতেই হাইকোর্ট সিবিআই কে তদন্তের নির্দেশ দেয়।

সাংবাদিক হত্যা: ২০০২ সালে সিরসা থেকে প্রকাশিত সান্ধ্য দৈনিক ‘পুরা সাচ’ (সম্পূর্ণ সত্য) এর সম্পাদক রামচন্দ্র ছত্রপতিকে তার বাড়ির সামনেই গুলি করা হয়। অভিযোগের আঙ্গুল সেই ডেরার দিকেই ওঠে।

সাংবাদিকরা বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ করতে থাকেন। একমাস পরে, দিল্লির একটি হাসপাতালে মৃত্যু হয় ছত্রপতির।

আবারও পাঞ্জাব-হরিয়ানার হাইকোর্ট সাংবাদিক ছত্রপতি এবং রণজিৎ সিং হত্যার মামলা দুটি একত্র করে সিবিআই’কে তদন্ত করতে নির্দেশ দেয়।

সুপ্রিম কোর্টও যখন ওই মামলা চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়, তারপরে গুরমিত রাম রহিমের হাজার হাজার ভক্ত-সমর্থক বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছিল।

শিখ সম্প্রদায়ের সঙ্গে বিরোধ: ২০০৭ সালে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায় যে গুরমিত রাম রহিম এমন পোশাক পরছেন, যেগুলো দশম শিখ ধর্মগুরু গোবিন্দ সিংয়ের পোশাকের মতো। শিখ সম্প্রদায়ের মানুষরা বিক্ষোভ শুরু করেন, রাম রহিমের কুশপুত্তলিকা জ্বালিয়ে দেন।

সেখানেই ডেরা সমর্থকরা ওই শিখদের ওপরে হামলা চালায়। তারপর থেকে গোটা উত্তর ভারত জুড়েই ডেরা সমর্থক আর শিখদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে।

ডেরা সমর্থকের গুলি চালানো: এরকমই একটা শিখ সম্প্রদায়ের বিক্ষোভ কর্মসূচিতে গুলি চালানো হয়। ডেরা সমর্থকদের দিকে আবারও অভিযোগ ওঠে।

ওই গুলি চালানোর ঘটনায় এক শিখ যুবক মারা গিয়েছিলেন। শিখ সম্প্রদায় গুরমিত রাম রহিমের গ্রেফতারের দাবীতে আন্দোলন শুরু করেন। তখন থেকেই ডেরা প্রধান গুরমিত রাম রহিমের ওপরে পাঞ্জাবে প্রবেশ নিষিদ্ধ।

বিচারককে হুমকি: দুজনকে হত্যা আর ধর্ষণের মামলার তদন্ত করে সিবিআই যখন গুরমিত রাম রহিমকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালতে রিপোর্ট দাখিল করে, বিচারক তাকে আদালতে হাজিরার নির্দেশ দেন ২০০৭ সালের ৩১ অগাস্টের মধ্যে। ওই বিশেষ আদালতের বিচারককে হুমকি দিয়ে চিঠি দেয়া হয়। তার প্রেক্ষিতে তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়।

প্রাক্তন ম্যানেজারের গুম-খুন: ২০১০ সালে ডেরার প্রাক্তন সন্ন্যাসী রামকুমার বিষ্ণোই হাইকোর্টের কাছে অভিযোগ জানিয়ে বলেন যে আশ্রমের প্রাক্তন ম্যানেজার ফকির চাঁদকে গুম-খুন করা হয়েছে। তিনি ওই ঘটনায় সিবিআই তদন্ত দাবী করেন।

ডেরা প্রধান রাম রহিমই ওই গুম-খুনের আদেশ দিয়েছিলেন বলেও অভিযোগ করা হয়।

আদালত সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয়ার পরে ডেরা সমর্থকরা পাঞ্জাব, হরিয়ানা আর রাজস্থানে ব্যাপক হাঙ্গামা চালায়, প্রচুর সরকারী সম্পত্তি ধ্বংস করা হয়, বহু বাসে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। তবে সিবিআই ওই ঘটনায় কোনো প্রমাণ যোগাড় করতে পারেনি।

ডেরার সাধুদের নপুংসক করে দেয়ার অভিযোগ: হংসরাজ চৌহান নামের এক ব্যক্তি ২০১২ সালে হাইকোর্টে মামলা করেন এই অভিযোগে যে ডেরা প্রধান রাম রহিমের নির্দেশে আশ্রমের চারশ সাধুকে নপুংসক করে দেয়া হয়েছে। সাংবাদিক ছত্রপতি হত্যায় অভিযুক্ত দুই ব্যক্তিও ডেরার নপুংসক সাধু ছিলেন বলেও সেই মামলায় জানানো হয়। তারা তখন জেলে বন্দি ছিল। তাদের জেরা করে জানা যায় যে সত্যিই ওই দুই সাধুকে নপুংসক করে দেয়া হয়েছিল। তবে তারা এটাও বলে যে তারা স্বেচ্ছায় নপুংসক হয়েছে।

এই মামলাটি এখনও বিচারাধীন, তবে রাম রহিম সিং অভিযোগটি সরাসরি অস্বীকার করেছেন। ‘এই কথা শতভাগ মিথ্যা। আমি কাওকে এসব করতে বলিনি’, টাইমস অফ ইন্ডিয়াকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি ওই দাবি করেন। বিবিসি বাংলা।