Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

৩ লাখ বিদেশী নাগরিকের বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার রেমিটেন্স

TK
টাকা – ছবি : সংগৃহীত

দেশে চার কোটি ৮২ লাখ মানুষ প্রকৃত বেকার। বেকারত্বের কারণে ৭৮ লাখ বাংলাদেশী বর্তমানে বিদেশে কর্মরত। কাজের অভাবে ভিটেমাটি বিক্রি করে এবং ধারদেনা করে হলেও বিদেশে যাওয়ার জন্য হন্যে হয়ে ফিরছেন লাখ লাখ তরুণ বেকার। সংসারের অভাব মেটাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নানা উপায়ে বিদেশের পথ পাড়ি দিতে গিয়ে অহরহ মারা যাচ্ছেন অনেক বাংলাদেশী। একটি সংস্থার তথ্যানুযায়ী দেশে উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে শতকরা ৪৭ ভাগ বেকার। বেকারত্বের এমন চিত্র যে দেশে সে দেশে তিন লাখ বিদেশী নাগরিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত রয়েছেন। বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা তারা নিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশ থেকে। এক দিকে বাংলাদেশী শ্রমিকেরা বিদেশে কঠোর শ্রম আর ঘাম ঝরিয়ে দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন। অপর দিকে তাদের পাঠানো প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ পরিমাণ টাকা প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছেন এখানে কর্মরত বিদেশীরা। বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল এবং বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত দেশে এ বিপরীত চিত্র মেনে নিতে পারছেন না অনেকে।

চলতি বছরের শুরুতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের শ্রমশক্তি জরিপের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে বেকারের সংখ্যা বলা হয়েছে মাত্র ২৬ লাখ ৮০ হাজার। বেকারের এ সংখ্যা নির্ণয় করা হয়েছে জাতিসঙ্ঘের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞা অনুযায়ী। আইএলওর সংজ্ঞা অনুসারে মাসে এক ঘণ্টা কাজ করে এমন লোকও বেকার নয়। তবে বিবিএসের জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রকৃত বেকারের সংখ্যা চার কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজার।
গত বছর ৮ জুলাই আইডিইবি ভবনে ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স (আইডিইবি) আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দেশে তিন লাখ বিদেশী কর্মরত। দ জনবলের অভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তারা কর্মরত।

chardike-ad

২০১৬ সালে জাতীয় সংসদে উত্থাপিত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ‘বর্তমানে ৭০ লাখেরও বেশি বাংলাদেশী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত রয়েছেন এবং তারা প্রতি বছর গড়ে প্রায় এক হাজার ৫০০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠান। এর বিপরীতে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২ লাখ বিদেশী কাজ করে। বেতনভাতা বাবদ তারা প্রতি বছর প্রায় ৫০০ কোটি ডলার নিয়ে যায়।’
২০১৩ সালের ২১ মে সিলিকন ইন্ডিয়া নিউজ নামে একটি ওয়েবসাইটে ভারতের রেমিট্যান্স অর্জনবিষয়ক একটি খবরে উল্লেখ করা হয়, উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ লাখ ভারতীয় কর্মরত রয়েছে। তাতে ভারত থেকে সে দেশের নাগরিকদের অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশের তথ্যও তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়, ভারতের যেসব অঞ্চল থেকে অবৈধভাবে ভারতীয় নাগরিকেরা বাংলাদেশে প্রবেশ করে সেগুলো হলো পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, আসাম, মিজোরাম এবং ত্রিপুরা। খবরটিতে সরকারি কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে বলা হয়, ভারতীয় নাগরিকেরা বাংলাদেশের গার্মেন্টস, টেক্সটাইলস এবং বিভিন্ন এনজিওতে কর্মরত রয়েছেন।

গত বছর ৫ অক্টোবর ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিকের খবরে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য তুলে ধরে বলা হয় বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশীরা বছরে ৫ বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাচ্ছেন। ২০১৫ সালে শুধু ভারতীয়রা বাংলাদেশ থেকে তিন দশমিক দুই বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স নিয়ে গেছে।

২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতের দি ইকোনমিক্স টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবরের তথ্য অনুযায়ী ভারত যেসব দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স (বিদেশে কর্মরতদের পাঠানো অর্থ) আয় করে তার তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। বাংলাদেশ থেকে ভারত বছরে চার বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আয় করে। গার্মেন্ট, টেক্সটাইল ও অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কয়েক লাখ ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশে কর্মরত রয়েছেন। তাদের মাধ্যমেই ভারত বাংলাদেশ থেকে এ বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স অর্জন করছে প্রতি বছর।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয় ২০১২ ও ২০১৩ সালে ভারত সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আয় করে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। তালিকার দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তৃতীয় সৌদি আরব, চতুর্থ যুক্তরাজ্য ও পঞ্চম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৩ সালে ভারত সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১১ বিলিয়ন ডলার, সৌদি আরব থেকে ৮ বিলিয়ন ডলার, যুক্তরাজ্য থেকে ৪ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার ও বাংলাদেশ থেকে ৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আয় করেছে।

২০১৩ সালে বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশী শ্রমিকেরা ১৪ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠিয়েছেন। আর বাংলাদেশে কর্মরত ভারতীয়রা ৪ বিলিয়ন ডলার এ দেশ থেকে নিয়ে গেছেন।
একটি তথ্যমতে বাংলাদেশের গার্মেন্টে ২২ হাজার গুরুত্বপূর্ণ পদে ভারতীয় নাগরিক কর্মরত রয়েছেন।

বাংলাদেশের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ গার্মেন্ট শিল্পের উঁচু পদগুলো বিদেশীদের দখলে রয়েছে মর্মে প্রায়ই খবর প্রকাশিত হচ্ছে। এর মাধ্যমে তারা যে বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স নিয়ে যাচ্ছেন, তা নয়; বরং এ শিল্পের নিয়ন্ত্রণও অনেকটা তাদের হাতে মর্মে অভিযোগ রয়েছে।
দক্ষ জনবলের অভাবে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ পদে দীর্ঘকাল ধরে ভারতীয়সহ বিদেশীরা কর্মরত থাকলেও এ অবস্থা থেকে উত্তরণ তথা দক্ষ জনবল গড়ে তোলার বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। অথচ বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যেই বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি। উচ্চশিক্ষার সাথে বাস্তবতার সমন্বয়হীনতা ও শিক্ষার মানের ক্রমাবনতি কয়েক বছর ধরে বহুল আলোচিত একটি বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

২০১৬-১৭ বিবিএসের জরিপের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারের হার ১৩ দশমিক ৪ ভাগ। অন্য দিকে যারা কখনো স্কুলে যায়নি তাদের বেকারত্বের হার সবচেয়ে কম যথা ১ দশমিক ৫ ভাগ।

২০১৬ সালের বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী দ্রুত বেকারত্ব বাড়ছে এমন ২০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান ১২তম।

২০১৪ সালে প্রকাশিত বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্টের ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার। ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে উচ্চশিার সুযোগ বাড়লেও মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অনেক েেত্রই তা বাজারের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এ কারণে বাড়ছে শিতি বেকারের সংখ্যা।
ইকোনমিস্টের এ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক দশকে বাংলাদেশে উচ্চশিায় বিনিয়োগ বাড়লেও শিার গুণগত মান বাড়েনি। এর ফলে শিতি বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। আর শ্রমবাজার ও শিাসংশ্লিষ্টদের মধ্যে সমন্বয় নেই। স্থানীয় ও বিশ্ববাজারের চাহিদানুযায়ী উচ্চশিায় শিতিদের কারিগরি ও কাজ করার মতো দতা কম। তাই উচ্চশিতি স্নাতকদের অনেকে বেতন পান অনেক কম।
সম্প্রতি সংসদ অধিবেশনে প্রশ্নোত্তরকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, বিদেশী নাগরিকেরা বিশেষজ্ঞ, কান্ট্রি ম্যানেজার, কনসাল্ট্যান্ট, কোয়ালিটি কন্ট্রোলার, মার্চেন্ডাইজার, টেকনিশিয়ান, সুপারভাইজার, চিকিৎসক, নার্স, ম্যানেজার, প্রকৌশলী, প্রোডাকশন ম্যানেজার, ডিরেক্টর, কুক, ফ্যাশন ডিজাইনার ও শিক ক্যাটাগরিতে কাজ করেন।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ইউজিসি বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৬ সালে ৩৬টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় (ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য ১১টি অধিভুক্ত/অঙ্গীভূত কলেজের শিক্ষার্থী ব্যতীত) স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়সহ বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের সর্বমোট সংখ্যা ৫ লাখ ৮ হাজার ৯৪৬ জন। অন্য দিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও প্রতি বছর লক্ষাধিক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা নিয়ে বের হচ্ছেন।

প্রতি বছর এভাবে লাখ লাখ তরুণ উচ্চশিক্ষা নিয়ে বের হলেও দেশে অবস্থিত আন্তর্জাতিক ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে তারা খুব কম সুযোগ পান।