Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

এটিএম বুথ থেকে বেরোচ্ছে জাল নোট

সম্প্রতি এটিএম বুথ থেকে তোলা টাকায় গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় বিল পরিশোধ করছিলেন দেশের বিশিষ্ট এক ব্যক্তি। তার দেয়া ৫০০ টাকার একটি নোট সে সময় জাল হিসেবে চিহ্নিত করেন রেস্তোরাঁর ক্যাশ কর্মকর্তা। বিষয়টি নিয়ে বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় তাকে।

chardike-ad

একটি বেসরকারি ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে গত মার্চে ৫০ হাজার টাকা তুলেছিলেন ফেনী শহরের বাসিন্দা হাজেরা খাতুন। পরদিন সেখান থেকে ২০ হাজার টাকা অন্য একটি ব্যাংকে জমা দিতে গেলে ১ হাজার টাকার একটি নোট জাল হিসেবে চিহ্নিত করেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। বিষয়টি নিয়ে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল হাজেরা খাতুনকে। পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের শাখায় গিয়ে এটিএম বুথ থেকে জাল টাকা বের হওয়ার বিষয়ে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাননি। উল্টো সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তার কাছ থেকে ভর্ত্সনা শুনতে হয়েছে তাকে। উপায়ান্তর না দেখে অগত্যা ওই জাল নোট ছিঁড়ে ফেলতে হয় তাকে।

হাজেরা খাতুন ও হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় বিল দিতে যাওয়া ওই বিশিষ্টজনের মতো আরো অনেকেই এটিএম বুথ থেকে টাকা উত্তোলনের সময় জাল নোট পাচ্ছেন। শুধু এটিএম বুথই নয়, জাল নোট পাওয়া যাচ্ছে ব্যাংক থেকে একসঙ্গে বেশি টাকা তুললেও। ‘জাল নোটের বাহকই অপরাধী’— আইনের এমন বিধানের কারণে গ্রাহকরা জাল নোট-সংক্রান্ত অধিকাংশ ঘটনাই হয়রানির ভয়ে চেপে যাচ্ছেন। কিছু ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে অভিযোগ জানিয়ে সমাধান হচ্ছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযোগ জানিয়ে ব্যাংকের কাছ থেকে গ্রাহকরা কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না।

ব্যাংকের এটিএম বুথে জাল টাকা কোথা থেকে আসছে— এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), জাল নোট প্রতিরোধে কর্মরত বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা, এটিএম বুথে টাকা সরবরাহকারী এজেন্সির শীর্ষ নির্বাহী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে বণিক বার্তা। তাদের কেউ বলেছেন, বুথে জাল টাকা সরবরাহ করার সঙ্গে আউটসোর্সিং এজেন্সির লোকেরা জড়িত থাকতে পারে। কারো মতে, ব্যাংকাররা জড়িত না থাকলে বুথে জাল টাকা প্রবেশের সুযোগ নেই। আবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরবরাহকৃত টাকার বান্ডিলে জাল টাকা থাকার কথাও বলেছেন কেউ কেউ।

সবার কথার সারমর্ম হলো, এটিএম বুথে জাল টাকা ঢুকিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে সংঘবদ্ধ একটি চক্র জড়িত। ব্যাংকার, সিকিউরিটি এজেন্সির লোকসহ সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশে চক্রটি গড়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে জালিয়াত চক্রের সদস্য বাংলাদেশ ব্যাংকেও থাকতে পারে। তবে ব্যাংকের শাখা থেকে গ্রাহককে দেয়া টাকার বান্ডিলে জাল নোট ঢুকিয়ে দেয়ার ঘটনার সঙ্গে ব্যাংকাররা সরাসরি জড়িত।

জানতে চাইলে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, এটিএম বুথ থেকে জাল টাকা বের হওয়ার দুয়েকটি ঘটনা শুনেছি। তবে ঢাকা ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে জাল টাকা বের হওয়ার কোনো অভিযোগ পাইনি। আমাদের ব্যাংকের বুথের সংখ্যা কম হওয়ায় এমনটি হতে পারে।

জাল নোট প্রতিরোধে গ্রাহকদের সচেতন হওয়ার উপদেশ দিয়ে তিনি বলেন, এটিএম বুথ থেকে টাকা বের হওয়ার পর তা যাচাই করে নিতে হবে। কোনো জাল নোট পেলে সঙ্গে সঙ্গে কল সেন্টারে অভিযোগ দিয়ে জানানো উচিত। দেশের সব এটিএম বুথেই সিসি ক্যামেরা লাগানো থাকে। জাল নোটটি ক্যামেরার সামনে ধরে অভিযোগ জানানো যায়। বুথের নিরাপত্তায় নিয়োজিত গার্ডকে সাক্ষী করে লিখিত অভিযোগ দেয়ারও সুযোগ রয়েছে। গ্রাহক ও ব্যাংকারদের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং অপরাধীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিতের মাধ্যমে জাল নোট প্রতিরোধ করা সম্ভব।

সম্প্রতি জাল নোট পাওয়ার আরেকটি ঘটনা ঘটে একটি বেসরকারি ব্যাংকের গুলশান শাখায়। শাখা থেকে ১০ লাখ টাকা উত্তোলন করেন একজন চাকরিজীবী। উত্তোলিত টাকার বান্ডিলের মধ্যে একটি জাল নোট চিহ্নিত করেন তিনি। পরে বিষয়টি লিখিতভাবে শাখাকে জানাতে চাইলে ব্যাংকাররা তাকে নোটটি পরিবর্তন করে দেন।

দেশে জাল টাকা তৈরি ও বিপণনকারীদের বিরুদ্ধে নিয়মিতই অভিযান চালায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিভিন্ন সময়ে বিপুল অর্থের জাল নোট জব্দও করা হয়। গত তিন বছরে প্রায় ৫ কোটি টাকার জাল নোট চিহ্নিত করা হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত প্রায় ৯০০টি জাল নোট ধরা পড়ে। জাল করা এসব নোটের বেশির ভাগই ১০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকার। এর সঙ্গে যুক্ত অর্থের পরিমাণ প্রায় ৭ লাখ টাকা। এরই মধ্যে এসব জাল নোটের কারবারিদের বিরুদ্ধে প্রায় ৩০টি মামলা হয়েছে। বর্তমানে সারা দেশে জাল নোট-সংক্রান্ত ৬ হাজার ৬০৬টি মামলা ঝুলে আছে। এর মধ্যে নতুন মামলা হচ্ছে। ফলে প্রতিদিনই জাল নোট-সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা বাড়ছে।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) মুখপাত্র ও অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, এখন পর্যন্ত এটিএম বুথসহ ব্যাংকিং চ্যানেলে জাল টাকা সরবরাহের অভিযোগ আমরা পাইনি। তবে জাল নোট প্রস্তুতকারী ও বিপণনকারীদের বিরুদ্ধে নিয়মিতই ব্যবস্থা নেয়া হয়ে থাকে। ব্যাংকিং চ্যানেলে জাল টাকা সরবরাহের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বেশির ভাগ ব্যাংক সিকিউরিটি এজেন্সিগুলোর মাধ্যমে এটিএম বুথে টাকা সরবরাহ করে। বর্তমানে দেশে অরনেট সিকিউরিটি সার্ভিস, জি-৪, সিকিউরেক্স, মানিপ্লান্ট নামের চারটি নিরাপত্তা এজেন্সি এটিএম বুথে টাকা সরবরাহের কাজ করে। এসব প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্ট থেকে টাকা সংগ্রহ করে নিজেদের প্রসেসিং সেন্টারে নিয়ে যায়। সেখানে টাকার স্তর বিন্যাস ও এটিএম বুথে ঢোকানোর অযোগ্য নোট পৃথক করা হয়। তারপর সে টাকা এটিএম বুথে নিয়ে যাওয়া হয়।

এটিএম বুথে টাকা সরবরাহের কাজ করা একটি নিরাপত্তা এজেন্সির শীর্ষ নির্বাহী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ভল্ট থেকে টাকা এনে এটিএম বুথে ঢোকানো পর্যন্ত অনেক মানুষ জড়িত থাকে। এক্ষেত্রে কোনো স্তরের যে কেউ অনৈতিকতার আশ্রয় নিতে পারেন। এটিএম বুথে জাল নোট পাওয়ার একাধিক অভিযোগ পেয়ে আমরা এ কাজ ছেড়ে দিয়েছি। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্ট থেকেও জাল টাকা সরবরাহের নজির আছে। এক্ষেত্রে নিরাপত্তা এজেন্সিগুলোর কিছু করার থাকে না। বুথে জাল টাকা সরবরাহের পরিমাণ খুবই কম। যান্ত্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার কারণে দিন দিন এ ধরনের অপরাধ হ্রাস পাচ্ছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

জাল নোট প্রতিরোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা উদ্যোগ রয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের কারেন্সি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মো. সুলতান মাসুদ আহমেদ। তিনি বলেন, কোনো গ্রাহক এটিএম বুথসহ ব্যাংকিং চ্যানেলে জাল নোট পেলে সে বিষয়ে অভিযোগ জানানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেস্ক রয়েছে। যদিও এক্ষেত্রে অভিযোগ প্রাপ্তির সংখ্যা নেই বললেই চলে। এটিএম বুথে টাকা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে জাল টাকা বুথে ঢুকতে পারে। এ বিষয়ে গ্রাহকদের যেকোনো অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে আমরা প্রস্তুত রয়েছি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বলেন, সরষের মধ্যে ভূত থাকলে জাল নোট প্রতিরোধ হবে না। ব্যাংক টাকার বান্ডিল যেখান থেকে সংগ্রহ করে, সেখান থেকে অনেক সময় জাল নোট ঢুকিয়ে দেয়া হয়। আগে টাকার বান্ডিল সরবরাহকারীদের ঠিক হতে হবে। এ কথার মধ্য দিয়ে তিনি পরোক্ষভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের দিকেই ইঙ্গিত করেন। সূত্রঃ বণিকবার্তা।