Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

১২ দেশ থেকে কমেছে রেমিট্যান্স প্রবাহ

remittance-dropদেশের ৯৪ ভাগ রেমিট্যান্স আসে বিশ্বের ১৮টি দেশ থেকে। এর মধ্যে ১২টি দেশ থেকেই রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেছে। রেমিট্যান্সে দুই-তৃতীয়াংশ অবদান রাখা মধ্যপ্রাচ্যের সাতটি দেশের ছয়টি থেকেই রেমিট্যান্স প্রবাহ ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। আর এর সামগ্রিক প্রভাব পড়েছে গত মাসের রেমিট্যান্সের ওপর। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এক দিকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে, কিন্তু কাক্সিক্ষত হারে বাড়ছে না রফতানি আয়। এতে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ কমে যাচ্ছে। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা কমছে না, বরং বেড়ে যাচ্ছে। এতেই বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে। বাজার স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার লেনদেনের ওপর সীমা বেঁধে দিলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় নীতিমালার ফাঁকফোঁকর দিয়ে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দরে ডলার লেনদেন করছে ব্যাংকগুলো। বাজার বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বাড়বে না, বরং চলমান ধারায় কমে যেতে পারে। বিপরীতে আমদানির নামে ডলারের চাহিদা বেড়ে যাবে। চাহিদা ও জোগানের মধ্যে বিস্তার ফাঁরাক দেখা দেবে। এতে সামনে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের অস্থিতিশীলতা আরো বেড়ে যাবে বলে তারা আশঙ্কা করছেন।

chardike-ad

রেমিট্যান্স প্রবাহের এ পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, গত আট বছর মধ্যপ্রাচ্য থেকে যে হারে শ্রমিক ফিরে এসেছে ওই হারে যায়নি। এর প্রভাব পড়েছে রেমিট্যান্স প্রবাহে। রেমিট্যান্স প্রবাহের এ অব্যাহত ধসের পরিণতি সম্পর্কে বিশ্লেষকরা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির স্থবিরতার আভাস দিয়েছেন। এটা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে বলে তারা আশঙ্কা করছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানিয়েছে, আশঙ্কার কারণ মধ্যপ্রাচ্য থেকে অব্যাহতভাবে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়া। কেননা মধ্যপ্রাচ্য থেকেই দেশের দুই-তৃতীয়াংশ রেমিট্যান্স আসে। এখান থেকে কমে যাওয়ার অর্থ হলো সামগ্রিকভাবেই কমে যাওয়া। এ কারণে গত অক্টোবরের চেয়ে নভেম্বরে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেছে প্রায় সাড়ে ৫ শতাংশ। গত মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১১৭ কোটি ৮২ লাখ ডলার, আগের মাসে এসেছিল প্রায় ১২৪ কোটি ডলার।

দেশভিত্তিক রেমিট্যান্স প্রবাহের চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের ৭ দেশ থেকে অক্টোবরে রেমিট্যান্স এসেছিল সাড়ে ৭৩ কোটি ডলার, যা নভেম্বরে কমে নেমেছে ৬৯ কোটি ডলারে। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে সাড়ে ৫ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে সৌদি আরব থেকে। এ দেশ থেকেই রেমিট্যান্স কমেছে সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সৌদি আরব থেকে গত অক্টোবরে রেমিট্যান্স এসেছিল সাড়ে ২৪ কোটি ডলার, সেখানে নভেম্বরে তা কমে নেমেছে ২২ কোটি ডলারে। একই ভাবে বাহরাইন, ওমান, কাতার, আরব আমিরাত ও লিবিয়া থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেছে। বাহরাইন থেকে সাড়ে তিন কোটির স্থলে তিন কোটি ডলার, ওমান থেকে সাড়ে ৭ কোটি ডলারের স্থলে সাড়ে চার কোটি ডলার, আরব আমিরাত থেকে ১৯ কোটি ডলারের স্থলে ১৮ কোটি ডলারে নেমেছে।

মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে বিশ্বের ১০টি দেশ থেকে বেশি রেমিট্যান্স আসে। গত মাসে এ ১০টি দেশের মধ্যে ছয়টি থেকেই রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেছে। গত অক্টোবরে এ ১০টি দেশ থেকে রেমিট্যান্স এসেছিল সাড়ে ৪২ কোটি ডলার, গত মাসে এসেছে ৪০ কোটি ডলার। অর্থাৎ একক মাসের ব্যবধানে এ ১০টি দেশ থেকে রেমিট্যান্স কমেছে প্রায় ৫ শতাংশ। এর মধ্যে এক মাসের ব্যবধানে হংকং থেকে ১৬ লাখ ডলারের স্থানে ১৩ লাখ ডলার, ইতালি থেকে সাড়ে ছয় লাখের স্থলে ছয় লাখ ডলার, মালয়েশিয়া থেকে ৯ কোটি ডলারের স্থলে থেকে আট কোটি ডলার, যুক্তরাজ্য থেকে আট কোটি ২৬ লাখের স্থলে আট কোটি ডলার, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৪ কোটির স্থলে ১২ কোটি ডলার, আর জার্মানি থেকে ৫৪ লাখের স্থলে ৩৭ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ, গ্যাস সঙ্কটের পাশাপাশি চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে স্থবির হয়ে পড়েছে বিনিয়োগ। সেই সাথে মধ্যপ্রাচ্য থেকে শ্রমিক ফিরে আসা ও হুন্ডি তৎপরতা বেড়ে গেছে। এর সামগ্রিক প্রভাব পড়েছে রেমিট্যান্সের ওপর। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা বেড়ে গেছে। চাপ বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকগুলোর আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ের কারণে বছরের শুরুতেই বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। ডলারের সংস্থান না করেই অতিমাত্রায় পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলে কিছু কিছু ব্যাংক। কিন্তু পণ্যের আমদানি ব্যয় পরিশোধের সময় এসে বাধে বিপত্তি। একসাথে চাহিদা অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। বিপরীতে সরবরাহ ওই হারে বাড়েনি। এ কারণে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অস্থিতিশীলতা বেড়ে যায়। বাজার স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক এক দিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে সঙ্কটেপড়া ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করতে থাকে। অপর দিকে ব্যাংকগুলোর ওপর তদারকি কার্যক্রম জোরদার করা হয়। একই সাথে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের সীমা বেঁধে দেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলারের জন্য মূল্য বেঁধে দেয়া হয় ৮৩ টাকা ৭৫ পয়সা। এ দর প্রায় তিন মাস ধরে চলছে।

কিন্তু বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক বেঁধে দেয়া ডলারের দর কার্যকর হচ্ছে না। দেশের তৃতীয় প্রজন্মের একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, কিছু কিছু ব্যাংকের ডলার সঙ্কট রুটিনে পরিণত হয়েছে। কারণ বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বাড়ছে না। কাক্সিক্ষত হারে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করতে পারছে না। আবার রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ কম। এ দিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকও আর আগের মতো ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে না। ফলে পণ্য আমদানির দায় পরিশোধ করতে বাজার থেকে হয় তাদের ডলার কিনতে হচ্ছে, অথবা একটি নির্ধারিত কমিশনের বিপরীতে ধার নিতে হচ্ছে। আর এ সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে কিছু কিছু ব্যাংক। তারা ইচ্ছেমাফিক ডলার মূল্য আদায় করছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের তেমন করার কিছু নেই। বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ যে হারে বাড়ছে সে অনুযায়ী আমদানি ব্যয় কমছে না। বরং সামনে এ দায় বেড়ে যাচ্ছে।

বিশেষ করে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জ্বালানি তেল সরবরাহ করতে তেল আমদানিতে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। অপর দিকে ডিসেম্বরে পণ্য আমদানি বাবদ বৈদেশিক মুদ্রায় বিভিন্ন দায় পরিশোধের চাপ বেড়ে যাবে। একই সাথে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এক ধরনের অস্থিরতা বেড়ে যাবে। ফলে ডলারের সরবরাহ কাক্সিক্ষত হারে বাড়বে না। এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমতে শুরু করেছে। বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ কমে যাওয়ার ধারা অব্যাহত থাকলে সামনে এ অস্থিরতা আরো বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।

সৌজন্যে- নয়া দিগন্ত