Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

সৌদিতে অমানবিক নির্যাতনের শিকার গৃহকর্মী ছাবেরা

saudi-saberaব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিজয়নগর উপজেলার লক্ষীপুর পত্তন গ্রামের বাসিন্দা ছাবেরা। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় দেড় বছর আগে দালালের মাধ্যমে সৌদি আররে পাড়ি জমান তিনি। ঢাকার একটি ট্রাভেল এজেন্সি তাকে হাসপাতালের ক্লিনারের ভিসা দেয়ার কথা বলে তার কাছ থেকে এক লাখ টাকা নেয়। এ সময় তাকে মাসিক ১ হাজার ২০০ সৌদি রিয়াল বেতন দেয়া হবে বলে চুক্তি বলা হয়। তবে সৌদিতে এসে তিনি বুঝলেন তার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে।

ছাবেরা জানান, সৌদিতে পৌঁছালে বিমানবন্দর থেকে তাকে গ্রহণ করেন এক সৌদি নাগরিক (তার নিয়োগকর্তা)। তখন তার আর বুঝতে বাকি থাকে না যে, তার ভিসাটা ছিল গৃহকর্মীর (খাদ্দামার)। তিনি নিরুপায় হয়ে নিয়োগকর্তার সঙ্গে তার বাসায় চলে যান এবং সেখানে কাজ শুরু করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, গৃহকর্মীর ভিসাগুলোতে কোনো টাকা দিতে হয় না। সব খরচ বহন করে নিয়োগকর্তা।

chardike-ad

তিনি বলেন, ‘হঠাৎ একদিন তার নিয়োগকর্তা তাকে কাচের বোতল থেকে কিছু খেয়ে (তার ভাষায় সম্ভবত মদ জাতীয় কিছু) কু-প্রস্তাব দেন এবং তাকে টাকা-পয়সার লোভ দেখান। তিনি প্রস্তাবে রাজি না হলে তার ওপর নেমে আসে অমানবিক নির্যাতন।’

নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্না ধরে রাখতে পারেননি ছাবেরা। ক্রন্দনরত অবস্থায় তিনি বলেন, ‘যখন আমি তার কু-প্রস্তাবে সাড়া দিতে অসম্মতি জানাই তখন আমাকে আমার পরনের সব কাপড় খুলে বিবস্ত্র করে একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে আবদ্ধ করে রাখে। আমার মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়া হয় যাতে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারি। এভাবে প্রায় ২-৩ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর আমাকে পুনরায় কু-প্রস্তাব দেন তিনি। এতে আমি আবারও অসম্মতি জানালে পর তিনি আমার গায়ে ক্লোরক্স (কাপড় কাচার এক ধরনের কেমিক্যাল) ঢেলে দেন এবং ইলেকট্রিক আয়রন গরম করে আমার পুরো শরীরে ছ্যাঁকা দেন। এরপর বুকের ওপর জোরে জোরে লাথি ও কিল-ঘুষি মারতে থাকেন।’

‘এভাবে কয়েকদিন অতিবাহিত হলে আমাকে বিবস্ত্র অবস্থায় নির্জন একটি পাহাড়ের ওপরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে নিয়ে আমাকে বলা হয়, প্রস্তাবে রাজি না হলে পাহাড় থেকে ফেলে দেয়া হবে। তারপরও আমি তার প্রস্তাবে রাজি হয়নি। তার কু-প্রস্তাবের জবাবে আমি বলি-আমি এই পাহাড় থেকে লাফ দিয়ে মরে যাব তবুও আমার ইজ্জত দেব না। এ অবস্থায় পাহাড় থেকে নেমে বাসায় যাওয়ার পথে এক সৌদি নারী আমাকে তার একটি পুরাতন ম্যাক্সি (কাপড়) দিলে আমি তা দিয়ে লজ্জা নিবারণ করি’-যোগ করেন ছাবেরা।

ছাবেরা বলেন, ‘পথিমধ্যে পুলিশের গাড়ি দেখে চিৎকার দিলে পুলিশ আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতলে নিয়ে যায় এবং আমার কপিলকে গ্রেফতার করে। এরপর আমি আর কিছু মনে করতে পারছি না। প্রায় ২২ দিন পর আমি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসলে আমাকে জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। আমি জানতে পারি যে, আমার নামে বিভিন্ন অজুহাতে তিনটা মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। আমি আরবি ভাষায় পারদর্শী না হওয়ায় এবং আত্মপক্ষ সমর্থন দিতে না পারায় মিথ্যা মামলায় প্রায় ১১ মাস জেলখানা এবং সেফহোমে কাটাতে হয়।’

পরবর্তী ঘটনা প্রসঙ্গে বি.বাড়িয়ার এই নারী বলেন, ‘আবহা সেফহোমে থাকাকালীন একদিন বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল জেদ্দার আসির প্রদেশ প্রতিনিধি আব্দুল হকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে আমি ওনাকে সব খুলে বলি। তিনি জেদ্দা কনস্যুলেটকে বিষয়টি অবহিত করেন। মামলার শুনানিতে আব্দুল হক এবং জেদ্দা কনস্যুলেটের কয়েকজন শ্রম কাউন্সিলর আমার পক্ষে অংশ নিয়ে আমাকে মামলা থেকে খালাস করতে সহযোগিতা করেন। পরবর্তীতে জেদ্দা কনস্যুলেটের আর্থিক সহায়তায় আমাকে আবহা-ঢাকার বিমান টিকিটের ব্যবস্থা করে দেন।’

‘জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর জেল কর্তৃপক্ষ আমাকে আমার কপিলের নিকট হস্তান্তর করলে আবার আমার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চলতে থাকে। আমি আব্দুল হক ভাইকে বিষয়টি অবহিত করলে আব্দুল হক ভাইয়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং জেদ্দা কনস্যুলেট জেনারেল সহায়তায় আমি জালেম কপিলের হাত মুক্ত হতে পেরেছি। বাংলাদেশ সরকারের সাহায্যের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে অকপটে স্বীকার করছি এবং সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি’-যোগ করেন তিনি।

জীবিকার তাগিদে যেসব নারী সৌদিতে পাড়ি জমাতে চান তাদের জন্য পরামর্শ দিয়েছেন নির্যাতিতা ছাবেরা। তিনি বলেন, ‘আমার বাংলাদেশি মা-বোনদের উদ্দেশ করে বলছি, তারা যেন এদেশে গৃহকর্মীর ভিসায় না আসেন। যদিও জীবিকার তাগিতে নিতান্তই আসতে হয় তাহলে সৌদি আরবে অবস্থানরত কোনো আপনজনদের কাছ থেকে যেন সবকিছু যাচাই করে নেয়া হয়। ভিসায় পেশাসহ অন্যান্য ডকুমেন্টগুলো শ্রম আইন জানা আইন বিশারদের নিকট গিয়ে পর্যালোচনা করে তারপর যের সৌদি আরবে আসেন তারা।’

এ ব্যাপারে জেদ্দা কনস্যুলেট প্রতিনিধি আব্দুল হকের নিকট জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি প্রায়ই আবহা সেফহোমে যাই। একদিন নির্যাতিত ছাবেরা আমাকে ওখানে দেখলে তিনি আমাকে তার নির্যাতনের কথা সব খুলে বলেন। আমি বিষয়টি বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল, জেদ্দা কর্তৃপক্ষের নিকট অবহিত করলে ওখান থেকে আমাকে নির্যাতিতার জন্য সব রকমের সহযোগিতার আশ্বাস দেয়া হয়।’

তিনি বলেন, ‘জেলখানায় তার ফাইল তালাশ করে দেখতে পাই তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অজুহাতে তিনটি মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। এরপর থেকে আমি কোর্টের বিভিন্ন শুনানিতে অংশ নিতে থাকি। এমনকি একটি শুনানিতে জেদ্দা কনস্যুলেটের শ্রম কাউন্সিলর আমিনুল ইসলাম, কাজী সালাউদ্দীন ও আলতাফ হোসেন অংশ নেন। এভাবে দিনের পর দিন অপেক্ষা করে তাকে খালাস করে আনি এবং তার কপিলের কাছ থেকে পাসপোর্ট সংগ্রহ করি।’

আজ দেশে ফিরবেন ছাবেরা। জেদ্দা কনস্যুলেট তার সম্পূর্ণ আর্থিক খরচ বহন করে আবহা-ঢাকা বিমানের টিকিট করে দিয়েছে। তার পাসপোর্ট নম্বর BP 0843267।

সৌজন্যে- জাগো নিউজ