মোঃ মহিবুল্লাহ, সিউল, ৫ এপ্রিল ২০১৪:
নগররূপে সিউলের সমৃদ্ধির শুরু খ্রিস্টপূর্ব সপ্তদশ শতকে। রাজধানী হিসেবে পথচলাও ছয়’শ বছর পেরিয়ে গেছে। জোসন রাজাদের আমল থেকে আজ অবধি ‘ক্যাপিটাল’ হওয়ার গৌরব ধরে রেখেছে দক্ষিণ কোরিয়ার সর্ববৃহৎ নগরীটি। এ অঞ্চলের অজস্র ইতিহাসের সাক্ষী এ শহরে দর্শনীয় স্থানের সংখ্যাটাও তাই নেহায়েত কম নয়। চলুন এ যাত্রায় পরিচিত হওয়া যাক সিউলের পাঁচটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনার সাথে, কালের পরিক্রমায় যাদের ইতিহাস একসূত্রে গাঁথা পড়ে আজ একক গল্প হয়ে গেছে।
দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলী নিয়ে শত শত বছরের সাক্ষী হয়ে সিউলের বুকে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচ পাঁচটি রাজপ্রাসাদ। দক্ষিণ কোরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট হাউস ‘চং ওয়া দে’ যেমন আধুনিক কোরিয়া রাষ্ট্রের উৎকর্ষের প্রতীক, এই রাজপ্রাসাদগুলোও জোসন আমলের রাজা-বাদশাদের জীবনযাত্রার ঐতিহাসিক নমুনা বহন করছে।
নির্মাণশৈলীতে ভিন্নতা থাকলেও প্রতিটি প্রাসাদেরই রয়েছে একটি সাধারণ কাঠামো। প্রতিটি স্থাপনাই কাঠের তৈরি, ছাদগুলো টালি দেওয়া। একেবারে মধ্যখানে রাজদরবার ও একটি সভাকক্ষ। দরবার হলে বড় বড় রাজকীয় অনুষ্ঠানগুলো আয়োজন করা হতো। দরবারের পশ্চাতে নিদ্রাকক্ষ আর পূর্বদিকে যুবরাজের ঘর। প্রাসাদের পিছন দিকের বাগানে রাজপরিবারের সদস্যরা কাজের ফাঁকে বিশ্রাম নিতেন। কক্ষগুলোর পিলার আর কড়িকাঠে রঙিন চিত্রকর্মে সংশ্লিষ্ট রাজার ক্ষমতা আর মর্যাদা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে।
খিয়ংবুকখুং 경복궁
জোসন রাজবংশের প্রথম প্রাসাদ। রাজা ইয় সিওং-গে ১৩৯২ সালে জোসন সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন এবং হানইয়াংকে (বর্তমান সিউল) রাজধানী ঘোষণা করে সেখানে একটি নতুন প্রাসাদ নির্মাণ করেন। তিনি এর নাম দেন খিয়ংবুকখুং(পরম আশীর্বাদ)।খিওংবকের অবস্থান বর্তমান ন্যাশনাল ফোক মিউজিয়াম ও প্রেসিডেন্ট হাউস চং ওয়া দে’র একদম পাশেই। ষোড়শ শতাব্দীর একেবারে শেষভাগে জাপানী ঔপনিবেশিক আমলে এটি পুড়িয়ে দেয়া হয়। পরবর্তীতে ১৮৬৭ সালে পুনঃনির্মাণ করা হয়। কোরিয়ার সর্ববৃহৎ এই প্রাসাদটিতে দরবার হলের পাশাপাশি উৎসব আয়োজনের জন্য রয়েছে একটি আলাদা কক্ষ যার অবস্থান একটি লেকের উপরে। রয়েছে একটি কৃত্রিম দ্বীপও, এখানে রাজা বিচারকার্য পরিচালনা করতেন। দর্শনার্থীদের জন্য প্রাসাদের প্রধান ফটকে প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত প্রতি ঘণ্টায় ‘রয়্যাল গার্ড চেঞ্জিং সেরেমনি’ প্রদর্শন করা হয়।
দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকেঃ- মার্চ-অক্টোবরঃ সকাল ৯টা–বিকেল ৬টা; নভেম্বর-ফেব্রুয়ারীঃ সকাল ৯টা-বিকেল ৫টা। প্রতি মঙ্গলবার বন্ধ।
প্রবেশমূল্যঃ- ৩ হাজার উওন (প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য)।
যেভাবে যাবেনঃ- খিয়ংবুকখুং সাবওয়ে স্টেশনের (সিউল সাবওয়ে লাইন নং ৩) ৫ নং বহির্গমন পথ (এক্সিট) অথবা খোয়াংহোয়ামুন সাবওয়ে স্টেশনের (সিউল সাবওয়ে লাইন নং ৫) ২ নং বহির্গমন পথ দিয়ে বের হয়ে হাঁটা পথে পাঁচ মিনিট।
ছাংদকগুং 창덕궁
সিংহাসনের দখল নিয়ে রাজনীতির কবলে পড়ে মাত্র এক দশক বাদেই রাজপ্রাসাদের মর্যাদা হারায় খিয়ংবুকখুং। ১৪০৫ সালে নির্মিত হয় জোসন সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় প্রাসাদ ছাংদকগুং বা ‘সৌভাগ্যের প্রসূতি’, নির্মাতা রাজা সেজং। এটিও জাপানী ঔপনিবেশিকরা পুড়িয়ে দেয়। ১৬০৯ সালে একে রাজকার্যে ব্যবহার উপযোগী করে পুনঃনির্মাণ করা হয়। এর দরবার প্রাঙ্গণে দুই সারিতে প্রয়াত রাজাদের নামসহ পাথরফলক বসানো রয়েছে; মাঝের পথটি কেবল রাজা ব্যবহার করতেন। ছাংদকের অন্যতম আকর্ষণ এর সুবিশাল বাগান। নজরকাড়া সৌন্দর্য আর আভিজাত্যই বলে দেয় বাগানটির প্রতি রাজপরিবারের সদস্যদের বাড়তি যত্ন ছিল। ১৯৯৭ সালে একে ইউনেস্কো কর্তৃক ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ ঘোষণা করা হয়।
দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকেঃ- এপ্রিল-অক্টোবরঃ সকাল নয়টা–বিকেল সাড়ে পাঁচটা; ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারিঃ সকাল নয়টা-বিকাল চারটা; নভেম্বর/মার্চঃ সকাল নয়টা-বিকেল সাড়ে চারটা। প্রতি সোমবার বন্ধ।
প্রবেশমূল্যঃ- ৩ হাজার উওন (প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য)।
যেভাবে যাবেনঃ- আনগুক সাবওয়ে স্টেশনের ৩ নং লাইনের ৫ নং বহির্গমন পথ দিয়ে বের হয়ে হেঁটে পাঁচ মিনিটের মতো লাগবে।
ছাংগিয়ংগুং 창경궁
ছাংগিয়ংগুং বা ‘সমৃদ্ধির আনন্দ’, নির্মাণকাল ১৪৮৩। জোসন রাজাদের প্রথম প্রাসাদ খিয়ংবুকখুংয়ের পূর্বদিকে অবস্থিত হওয়ায় এটির অপর নাম ‘প্রাচ্যের প্রাসাদ’। এর পিছনভাগে মনোরম দুটি পুকুর রয়েছে। ছাংগিয়ংয়ের রাজকীয় মর্যাদা খাটো করার জন্য জাপানীরা প্রাসাদ এলাকার অভ্যন্তরে একটি চিড়িয়াখানা, একটি বোটানিক্যাল গার্ডেন আর একটি যাদুঘর নির্মাণ করেছিল। ১৯৮৪ সালে সংস্কারের সময় এগুলো বাদ দেয়া হয়।
দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকেঃ- এপ্রিল-অক্টোবরঃ সকাল নয়টা–বিকেল সাড়ে ছয়টা; ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারিঃ সকাল নয়টা-বিকাল পাঁচটা; নভেম্বর/মার্চঃ সকাল নয়টা-বিকেল সাড়ে পাঁচটা। প্রতি সোমবার বন্ধ।
প্রবেশমূল্যঃ- ১ হাজার উওন (প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য)।
যেভাবে যাবেনঃ- জোংনো ৩গা সাবওয়ে স্টেশনের ৩ নং লাইন থেকে কিছুটা পথ হাঁটলেই প্রাসাদের প্রধান ফটক পাওয়া যাবে।
খিয়ংহুয়েগুং 경희궁
খিয়ংহুয়েগুং’র বাংলা অর্থ হতে পারে প্রশান্তির সুর। আদি নাম খিওংদেওক; খিয়ংবুকখুংয়ের পশ্চিমে অবস্থান হওয়ায় ‘সওগোল’ বা ‘পশ্চিমের প্রাসাদ’ নামেও পরিচিত। ১৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত প্রাসাদটি কেবলমাত্র জরুরী অবস্থায় বিকল্প রাজদরবার হিসেবে ব্যবহৃত হত।
দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকেঃ- সাপ্তাহিক ছুটির দিনঃ সকাল নয়টা–বিকেল ছয়টা; অন্যান্য দিনঃ সকাল নয়টা-বিকাল ছয়টা; সোমবার বন্ধ।
প্রবেশমূল্যঃ- নেই।
যেভাবে যাবেনঃ- সদেমুন সাবওয়ে স্টেশনের ৫ নং লাইনের ৪ নং বহির্গমন পথ দিয়ে বেরিয়ে মিনিট দশেক হাঁটতে হবে।
দকসুগুং 덕수궁
এটি পাঁচ প্রাসাদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। প্রকৃত নাম খিয়ংগুণ; প্রাথমিকভাবে রাজা সেওংজোং’র (১৪৫৭-১৪৯৪) বড় ভাই যুবরাজ উলসানের বাসভবন ছিল। জাপানী আগ্রাসনের সময় সবক’টি প্রাসাদ পুড়িয়ে ফেলা হলে সপ্তদশ শতকের শুরুতে এটি অস্থায়ীভাবে প্রাসাদের মর্যাদা লাভ করে। জসন আমলের শেষভাগে ১৯০৭ সালে এ বংশের শেষ ও কোরিয়া সাম্রাজ্যের প্রথম রাজা গোজং (১৮৫২-১৯১৯) রাজত্ব দীর্ঘজীবী করার শেষ চেষ্টা হিসেবে এ প্রাসাদে আশ্রয় নেন এবং এর নতুন নাম দেন দকসু বা ‘বিশুদ্ধ দীর্ঘায়ু’। এর নির্মাণকাজে ঐতিহ্যবাহী কাঠের ব্যবহার ও পশ্চিমা স্থাপত্যশৈলীর ছাপ লক্ষণীয়। খিয়ংবুকখুং মতো এখানেও প্রতিদিন তিনবার করে ‘রয়্যাল গার্ড চেঞ্জিং সেরেমনি’র প্রদর্শনী হয়।
দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকেঃ- প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে রাত নয়টা। সোমবার বন্ধ।
প্রবেশমূল্যঃ- ১০০০ উওন (প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য)।
যেভাবে যাবেনঃ- সাবওয়ে লাইন ১ অথবা ২, সিটি হল স্টেশনের ৩ নং বহির্গমন পথ দিয়ে বের হয়ে সামান্য হাঁটলেই প্রাসাদ।
প্রত্যেকটি প্রাসাদেরই রয়েছে নিজস্ব গল্প, ভিন্ন ইতিহাস, আলাদা সৌন্দর্য। কোনটার রূপ আপনাকে মুগ্ধ করবে; আবার কোনটা নিয়ে যাবে শত বছরের পুরনো অতীতে, ধারনা দেবে বিভিন্ন সময়ের কোরীয় জীবনধারা সম্পর্কে। সবমিলিয়ে নতুন কিছুই আবিষ্কার করবেন- এতে কোন সন্দেহ নেই!