শনিবার । জুন ২১, ২০২৫
বাংলা টেলিগ্রাফ ডেস্ক বিজনেস ১২ মে ২০২৫, ৩:৫২ অপরাহ্ন
শেয়ার

লোকসান কাটাতে ৯০০ কোটি টাকার সরকারি সহায়তা চাইছে ইন্টারকন্টিনেন্টাল


লোকসান কাটাতে ৯০০ কোটি টাকার সরকারি সহায়তা চাইছে ইন্টারকন্টিনেন্টাল

 

সরকারি মালিকানাধীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঢাকা আর্থিক সংকটে পড়ায় ৯০০ কোটি টাকার সহায়তা চেয়েছে। ব্যয়বহুল সংস্কারের পর প্রতিষ্ঠানটি এই সংকটের কথা জানায়।

হোটেলটি পরিচালনাকারী রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ সার্ভিসেস লিমিটেড (বিএসএল) সরকারের নামে শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকা মূলধন এবং সুদমুক্ত বা কমসুদের ৫০০ কোটি টাকার দীর্ঘমেয়াদি ঋণের প্রস্তাব দিয়েছে।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় বিএসএলের পক্ষে অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে হোটেলটি অনুদান না পেলে দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে বলে সতর্ক করেছে।

শেয়ার ইস্যুর বিপরীতে ৪০০ কোটি টাকা অগ্রিম ও কোম্পানির আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঋণ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে প্রস্তাবে।

বিএসএলের দাবি, সহায়তা পেলে তারা ২০৩০ সালের মধ্যে বকেয়া ঋণ পরিশোধ এবং লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারবে।

তারা আগামী ১০ বছরে ৭৩০ কোটি টাকার নগদ প্রবাহের পূর্বাভাস দিয়েছে, যা থেকে লভ্যাংশ প্রদান ও ঋণ আগেভাগে পরিশোধ সম্ভব হতে পারে।

সংকটের শুরু

বিএসএলের এই আর্থিক চাপের মূল কারণ ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের ব্যয়বহুল সংস্কার।

আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে সংস্কারের লক্ষ্যে হোটেলটি ২০১৪ সালের আগস্টে বন্ধ করা হয় এবং চার বছর পর, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে চালু হয়।

সংস্কারে মোট ব্যয় হয় ৭২৮ কোটি টাকা, যার মধ্যে অগ্রণী ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ ৫৭৪ কোটি টাকা ও বিএসএলের নিজস্ব তহবিল থেকে ছিল ১৫৪ কোটি টাকা।

তবে, হোটেল চালুর সময়ই শুরু হয় কোভিড-১৯ মহামারি, যা কার্যক্রমে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটায় এবং সংস্কারের ব্যয় পুনরুদ্ধারে দেরি হয়।

বিএসএলের হিসাব ও অর্থ বিভাগের ব্যবস্থাপক আলী ইমাম হোসেন বলেন, ‘ঋণ নিয়ে হোটেল সংস্কার করা হয়েছিল। কিন্তু, হোটেল চালুর পরই মহামারি ছড়িয়ে পড়ে, ফলে আবার কার্যক্রম ব্যাহত হয়। এতে রাজস্ব ব্যাপকভাবে কমে যায়, যার কারণে ঋণের কিস্তি পরিশোধে অনিয়ম ঘটে।’

ঋণ ও লোকসানের চিত্র

২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত বিএসএলের মোট বকেয়া ঋণ দাঁড়িয়েছে ৮৯৭ কোটি টাকা, যার মধ্যে মূল ঋণ ৫০৩ কোটি এবং সুদ ৩৯৪ কোটি টাকা। কোম্পানিটি প্রতিবছর প্রায় ৮০ কোটি টাকা সুদ দেয়।

নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান হোদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোং জানিয়েছে, ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বিএসএলের পুঞ্জীভূত লোকসান ৬১৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা এবং বর্তমান সম্পদের ঘাটতি ৩০৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই পরিস্থিতি কোম্পানির ভবিষ্যৎ কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা নিয়ে গুরুতর সন্দেহ সৃষ্টি করছে।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিএসএলের রেভিনিউ ছিল ১৯৩ কোটি টাকা, আগের বছরের তুলনায় ১৪ শতাংশ বেশি। এই সময়ে এটি মোট মুনাফা দেখায় ১১০ কোটি টাকা। তবে প্রশাসনিক ও আর্থিক খরচ বাদ দেওয়ার পর নিট লোকসান হয়েছে ৭৮ কোটি টাকা।

চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) প্রথম ছয় মাসে লোকসান হয়েছে ৫১ কোটি টাকা। এতে শেয়ারপ্রতি লোকসান দাঁড়ায় ৫ টাকা ২০ পয়সা।

সাম্প্রতিক অবস্থা ও শেয়ার ইস্যুর পরিকল্পনা

হোটেল বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত বিএসএল একটি লাভজনক কোম্পানি ছিল এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ‘এ’ ক্যাটাগরিতে তালিকাভুক্ত ছিল।

তারা সর্বশেষ ২০১৪ সালে ১৫ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ দেয়। গত ১২ বছরে কোনো লভ্যাংশ দেয়নি কোম্পানিটি।

১৯৯৬ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বিএসএল সরকারকে ১০১ কোটি টাকা লভ্যাংশ দিয়েছে। ১৯৯৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ভ্যাট, কর ও আমদানি শুল্ক বাবদ জমা দিয়েছে ৮৪০ কোটি টাকা। ২০১৯ সাল থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় আয় হয়েছে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা।

বর্তমান সংকট মোকাবিলায় নভেম্বরে সরকারের নামে শেয়ার ইস্যুর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে বিএসএল একটি কমিটি গঠন করে। এখন সেই সুপারিশ অনুযায়ী এগোতে চায় তারা।

তবে, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি হওয়ায় বিএসএলকে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের অনুমোদন নিতে হবে এবং শেয়ারহোল্ডারদের সম্মতি নিতে একটি বিশেষ সাধারণ সভার (ইজিএম) আয়োজন করতে হবে।

পুঞ্জীভূত লোকসানের কারণে কোম্পানিটি রাইটস ইস্যু বা রিপিট পাবলিক অফারের মতো প্রচলিত উপায়ে মূলধন তুলতে পারছে না, যেগুলো কেবল লাভজনক কোম্পানির জন্য প্রযোজ্য।

এ কারণে সরকারের কাছে শেয়ার ইস্যুকেই মূলধন সংগ্রহের একমাত্র কার্যকর উপায় হিসেবে দেখছে বিএসএল।

গঠনগত সীমাবদ্ধতা ও দেউলিয়ার আশঙ্কা

অর্থ মন্ত্রণালয়কে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, চলমান লোকসানের কারণে পাবলিক ইস্যু রুলস ২০১৫ অনুযায়ী শেয়ার ইস্যুর শর্ত পূরণ করতে পারছে না বিএসএল, ফলে প্রচলিত তহবিল সংগ্রহে বাধা তৈরি হয়েছে।

তাৎক্ষণিক আর্থিক সহায়তা না পেলে কোম্পানির কার্যক্রম গুরুতরভাবে ব্যাহত হতে পারে এবং হোটেলটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে সতর্ক করেছে তারা।

বর্তমানে বিএসএলের পরিশোধিত মূলধন ৯৭ কোটি ৭৮ লাখ টাকা, যার ৯৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ সরকারের মালিকানায়। বাকি শেয়ার রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারী, বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন ও সুইস নাগরিক প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খানের হাতে।

হোটেলটির ব্যবস্থাপনার ইতিহাসে ইন্টারকন্টিনেন্টাল (১৯৬৬-১৯৮৩), শেরাটন (১৯৮৪-২০১১) এবং রূপসী বাংলা (২০১১-২০১৪) নাম রয়েছে।

২০১২ সালে বিএসএল যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলস গ্রুপের সঙ্গে ৩০ বছরের চুক্তি করে, যার আওতায় ২০১৮ সালে হোটেলের কার্যক্রম আবার শুরু হয়।

সাম্প্রতিক কিছু অগ্রগতি থাকলেও বিএসএল বলছে, ঋণের চাপে, বিশেষ করে সুদের বোঝায় তারা আর্থিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। তাই দ্রুত সরকারি হস্তক্ষেপ চাচ্ছে কোম্পানিটি।

সরকার এখনো বেইলআউট অনুরোধের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি।