Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

সংকটে অভিবাসী; বঞ্চনা আর ক্রন্দন দেশে দেশে

bangladeshi_labour

থাইল্যান্ডের গহীন অরণ্য থেকে কিছু বাংলাদেশিকে উদ্ধার করা হয়েছে। যাদের ক্রন্দনরত মুখ অনাহারে নির্যাতনে মলিন হয়ে গেছে। জনা পঁয়ত্রিশেক এরই মাঝে বিক্রি হয়ে গেছে। যারা মুক্তি পেয়েছে তাদেরও পুলিশ বিচারের আওতায় এনে জেলে পাঠানোর চেষ্টা করছে।

chardike-ad

জেল থেকে তাদের আবারো ফিরে যেতে হচ্ছে দাস ব্যবসায়ীদের হাতে। কারণ ওখানে দাস ব্যবসায়ীদের হাত অনেক লম্বা। থাইল্যান্ড সি-ফুড রফতানিতে বিশ্বে তৃতীয়। এই বিপুল সমুদ্র সম্পদ আহরণে নিয়োজিত শ্রমিকের সদা সংকট। ভয়াবহ পরিশ্রমের এ কাজে তাই নিয়োজিত করা হয় কৃতদাস। এরা আর কেউ নয়, আপনার ও আমার ভাই। পশু নয়, ওরাও মানুষ। কাঁদছে ওরা- সে সাথে কাঁদছে সভ্যতাও।

মালয়েশিয়ার অবৈধ যাত্রী
বহু বাংলাদেশি কাজ করছেন মালয়েশিয়ায়। সংবাদ মাধ্যমের খবরে দেখা যায়, মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে যাওয়ার সময় মারা যাচ্ছে অনেকে। সম্প্রতি থাইল্যান্ডের সমুদ্র রক্ষীর হাতে অনেকে গ্রেফতারও হয়েছেন। ছবিতে দেখা গেল সারিবদ্ধভাবে বালুকাবেলায় শুয়ে আছেন তারা। আসলে শখ করে সূর্যস্নান নয়, সমুদ্র রক্ষীর নির্মম নির্যাতনে মাটিতে পড়ে আছেন তারা।

সংকুচিত শ্রমবাজার
প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিটেন্স বাংলাদেশের আয়ের অন্যতম উৎস। বর্তমানে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই শ্রমিক রফতানী বন্ধ। আবুধাবিতে অল্প কিছু শ্রমিক যাচ্ছে। বেসরকারিভাবে যে কয়টা ওয়ার্ক পারমিট যোগাড় হচ্ছে তার ত্রিশ ভাগই হাতিয়ে নিচ্ছে সরকারি দফতর। শ্রম বাজারে ব্যাপক ধসের পরও মন্ত্রীর দেয়ালে সাটা পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে, শ্রমিক রফতানীর ঊর্ধ্বগতি। সাধারণ মানুষ জটিল পরিসংখ্যান বোঝে না।তারা নিজেদের শ্রম বেচে স্ত্রী-সন্তান পরিজনের মুখে হাসি ফোটাতে চায়। অভাগা দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর পদ আগলে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বেয়াই সাহেব।

ব্যর্থ পররাষ্ট্রনীতি
ব্যর্থ পররাষ্ট্রনীতির কারণে ধীরে ধীরে বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। সাবেক এক মহিলা মন্ত্রী দীপু মণি খামোখা বিশ্ব ভ্রমণে বিশ্বরেকর্ড স্থাপনের চেষ্টায় রাষ্ট্রীয় কোষাগার শূন্য করেছেন। সাথে ফলাফলও এসেছে শূন্য। ব্যর্থ পররাষ্ট্র নীতিতে দিনে দিনে সংকুচিত হয়েছে শ্রমবাজার। অভাবী মানুষের বাঁচার আকুতি হয়েছে বাধাগ্রস্ত। অবৈধ উপায়ে বিদেশ যাবার চেষ্টায় কত শত-সহস্র যে প্রাণ হারিয়েছেন তার কোন হিসাব নেই।

কিছুদিন আগেও ইউরোপে যাওয়ার পথে নাইজেরিয়ার গহীন অরণ্যে দুষ্কৃতকারীদের নির্মম নির্যাতনের শিকার হন বেশ কিছু বাংলাদেশি। প্রাণও হারান অনেকে। জীবনের ঝুঁকি নিয়েও অভিবাসনের এ প্রচেষ্টা, তীব্র অভাব থেকে মুক্তিরই এক প্রাণান্তকর চেষ্টা।

সরকার প্রধানের বেকার বিদেশ ভ্রমণ
সরকার প্রধান সাধারণত অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজে বিদেশ ভ্রমণ করেন। অথচ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বেলারুশ সফর নিয়ে দুর্মুখেরা বলেন যে, তিনি নাকি ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে আজীবন রাষ্ট্রপতি শাসন পর্যবেক্ষণ করতেই বেলারুশ সফর করেছেন। যুক্তরাজ্যে সরকারি ব্যয়ে পারিবারিক অনুষ্ঠানে হাজিরা দেয়া, অসম মর্যাদার অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও উপস্থিত হওয়া, তাকে যুক্তরাজ্যের স্বীকৃতি হিসেবে উপস্থাপন, অবশেষে যুক্তরাজ্যের সরকারি নোটে তাদের অবস্থানের ব্যাখ্যা সরকারের মিথ্যাচার উন্মোচন করেছে। আমেরিকা সফরে উন্মোচন হয়েছে অন্য একটি স্পর্শকাতর বিষয়। ইটালি ভ্রমণে সফরসঙ্গী আটজনের ভিসা না দেয়া অপ্রয়োজনীয় মানুষেরা যে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হন সেটাই ইঙ্গিত করে।

যুগে যুগে শ্রমিকের অভিবাসন
শ্রমিকরা বেশী উপার্জনের আশায় দুর অতীত থেকেই দেশান্তরী হয়েছেন। বিলাতে মূলতঃ সিলেটি মানুষ নিজ চেষ্টায় কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। এর সাথে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে হাইলি স্কিলড ও স্টুডেন্ট ভিসায় আসা মানুষ। ইউকেবি’র ত্রুটিপূর্ণ পয়েন্ট বেজড সিসটেম এর আওতায় সংঘবদ্ধ জালিয়াত চক্রের সহায়তায় যুক্তরাজ্যে লেখাপড়ায় সম্পূর্ণ অসমর্থ একশ্রেণির মানুষ ইকনোমিক মাইগ্রান্ট হয়ে চলে আসেন যুক্তরাজ্যে। এ ছাত্র নামধারীদের টিকিয়ে রাখতে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠে প্রায় বাইশ’শ কলেজ। কলেজগুলোর মূল কাজই ছিল অর্থের বিনিময়ে ছাত্রদের ওয়ার্ক পারমিট – ভিসা বহাল রাখা। শেষের কবিতার অমিত আর শরৎবাবুর দেবদাস বিলাত ফেরত ব্যারিষ্টার ছিলেন। উপার্জনের লক্ষ্যে বিলেতে আসা ছাত্র নামধারী সে সব মানব সন্তানরা উপন্যাসের সে কাল্পনিক চরিত্রের থেকে পৃথক। তারা জমিদার নন্দন নয়, শোষক নয়। শোষিত।

ওদের গল্পটা এরকমঃ “অল্প বয়সী ছেলেটি স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে যুক্তরাজ্যে আসে। পরিবারের আর কোন সদস্য উপার্জনশীল নয়। তাই বিদেশে গিয়ে একাকী নিঃসঙ্গতায় হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে দেশে টাকা পাঠায় সে। খুব ভোরে উঠে কাজে যায়, কদিন আগেও মায়ের গভীর আদরের গণ্ডির ভেতরে থাকা ছেলেটি। কাজ থেকে ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে সে। অল্পবয়সী ছেলেটি পড়াশুনা করার সময় পায় না, অসময়ে সব আনন্দ বিসর্জন দিয়ে জীবন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আয়ের পুরোটাই দেশে পাঠাতে থাকে। উপরন্তু ধার-দেনা করেও পাঠায়। পরিবার থেকে ছিটকে পড়ে দূরে, হাজার মাইল দূরে। কত ঈদ আর কত আপনজনের আনন্দময় সময় থেকে তার দূরে থাকা -অনেক আপনজনের নিশ্চুপ চলে যাওয়া। কোটি ডলার রেমিটেন্স পাঠানো প্রবাসীর অপর পিঠে কত গোপন হৃদয়ে রক্তক্ষরণ। নির্ঘুম রাত, দীর্ঘশ্বাস, ঘামঝরা দুর্বিষহ কষ্ট জড়িয়ে।” (ছায়া অবলম্বনে)

সমুদ্রের বধূ গ্রেট ব্রিটেনের হাজার বছরের পুরোনো রাজপ্রাসাদে ফিলিপাইনের যে গৃহকর্মী আছে তাকেও দৈনিক ১২/১৪ ঘন্টা কাজ করতে হয়। বিনিময়ে নূন্যতম পারিশ্রমিকও মেলেনা। মধ্যপ্রাচ্যে অনেক আরবীয়রা গৃহকর্মীদের দিনরাত খাটিয়ে মারেন। এমনকি অনেক সময় সম্ভ্রম হারাতে হয় মা-বোনদের। মানবাধিকারের দেশ বৃটেনে হয়ত প্রকাশ্য নির্যাতনের স্বীকার কেউ হন না, কিন্তু গোপন বৈষম্যের স্বীকার তারা প্রতিনিয়ত।

আইনবহির্ভূতভাবে এ অভিবাসীদের যারা কাজে নিয়োজিত করেন তারাই আবার তাদের নূন্যতম মজুরী থেকে বঞ্চিত করেন। কখনো প্রশিক্ষণকালীন ভলান্টারি কাজের নামে, কখনো পেটে ভাতে, আবার কখনো মজুরীর এক দশমাংশ প্রদান করতে হয় বাধ্যতামূলক নিয়মে। একদল চীনা ছাত্র ঘন্টায় মাত্র পঞ্চাশ পেনির বিনিময়ে ঝিনুক কুড়াতে গিয়ে সমুদ্রে ডুবে প্রাণ হারালে নিন্দার ঝড় বয়ে যায় বৃটেন জুড়ে। এ শোষণ রোধে তাই বৃটেন সরকার ভলান্টারি কাজে আনছে নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু প্রবাসী এসব ছাত্র ভাই-বোনরা টার্ম টাইমে ২০ ঘন্টা আর ছুটিতে ফুলটাইম কাজ করে ন্যূনতম চার হাজার পাউন্ড টিউশন ফি দিয়ে বিশ্বের ব্যয়বহুলতম নগরে খেয়ে পরে বাঁচবেন কি করে তা কি অভিভাবকেরা একবার ভেবে দেখবেন?

নানামুখী চাপে তাই অনিবার্যভাবেই অবৈধ হয়ে পড়েন এ ছাত্ররা। তখন তাদের ঘিরে সক্রিয় হন এক শ্রেণীর বন্ধুবেশী দালাল। কমিশনের বিনিময়ে দালালরা গ্রাহক ধরে দেন এক শ্রেণীর আইনজীবীদের। জাল কাগজ তৈরী করে ভিসা পাইয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন তারা। বিনিময়ে হাতিয়ে নেন বিপুল অংকের টাকা। ভুয়া ওয়ার্ক পারমিট বেচে হাতিয়ে নেয় ১০/১২ হাজার পাউন্ড। আছে তথাকথিত কলেজ ব্যবসায়ীরূপী আদম ব্যবসায়ী। যারা কলেজ পরিচালনা করবে না জেনেও আপনার টাকা নিতে দ্বিধা করবে না। প্রতারকের খপ্পরে পড়ার পরিণাম ভিসা প্রার্থীর জেল, শেষে ডিপোর্টেশন। পরবর্তী যে কোন ভিসা আবেদন বাধ্যতামূলক প্রত্যাখান। দীর্ঘ সময়ের জন্য পরবর্তী ভিসা আবেদন থেকে ব্যান্ড। অতএব ভেবে দেখুন, আপনারা টাকা ঠিকভাবে খরচ করছেন তো ??