Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

২০১৪ সালে বিশ্ব অর্থনীতির ১০ আলোচিত ঘটনা

economyতীর সামনে ছোড়ার আগে পেছনে টানতে হয়। অতীতের ওপর ভিত্তি গড়ে বর্তমান এবং বর্তমানের ওপর ভবিষ্যৎ। নানা ঘটনাবহুল ২০১৪ শেষে সময়ের চক্রে আগমন হয়েছে ২০১৫ সালের নতুন সূর্যের। কিন্তু অতীতের রেশ কখনই থামে না, প্রতিনিয়ত মিশে যায় ভবিষ্যতের প্রতিটি সময়কণায়। প্রতিটি বছর শেষের হিসাব-নিকাশে যোগ হয় নতুন বছরের আশা-আকাঙ্ক্ষা। তাই ভবিষ্যতের হিসাব কষতে বিশ্ব অর্থনীতির ১০টি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি নিয়ে বিদায়ী বর্ষকে ফিরে দেখতে আজকের এ প্রয়াস—

যুক্তরাষ্ট্র

chardike-ad

বছরের সবচেয়ে আলোচিত ছিল মার্কিন অর্থনীতির পুনরুত্থান। ২০১৪ সালের প্রথম প্রান্তিকে ২ দশমিক ১ শতাংশ সংকোচন নিয়ে বন্ধুর এক পথ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তৃতীয় প্রান্তিকেই সংশোধিত হিসাবে ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে দুর্দান্তভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে মার্কিন অর্থনীতি। শেষ ছয় মাসেই দেশটির অর্থনীতি ২০০৩ সালের পর সবচেয়ে ভালো ফল দেখিয়েছে। তবে বছরজুড়ে সবচেয়ে আলোচনায় ছিল দেশটির ক্রমহ্রাসমান বেকারত্বের হার। বছরের শুরুতে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ বেকারত্বের হার নিয়ে গত নভেম্বরেই তা নেমে এসেছে ৫ দশমিক ৮ শতাংশে। এ বছর দেশটির নিয়োগদাতারা প্রায় ৩০ লাখ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন, যা ১৯৯৯ সালের পর সর্বোচ্চ। অন্যদিকে শক্তিশালী হয়েছে ডলার, যা এখন ২০১০ সালের পর সর্বোচ্চ অবস্থানে উঠে এসেছে। সবদিক থেকে ইতিবাচক সংবাদ আসায় মন্দার সময়ে নেয়া আর্থিক প্রণোদনা কর্মসূচির সমাপ্তি টেনেছে ফেডারেল রিজার্ভ। এ পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন ধরে দশমিক ২৫ শতাংশে ধার্য করা সুদের হার বৃদ্ধি করতে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর।

গাড়ি প্রত্যাহার

তাকাতা এয়ারব্যাগ ও ইগনিশন সুইচে ত্রুটির কারণে বিশ্বজুড়ে বেশকিছু হতাহতের ঘটনায় গত বছরজুড়ে গাড়ি নির্মাতা কোম্পানিগুলোয় হিড়িক লেগেছিল তাদের পণ্য প্রত্যাহারে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই গাড়ি প্রত্যাহার করা হয় ৬ কোটির মতো। তাকাতা এয়ারব্যাগে ত্রুটির কারণে বেশ কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটলে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে যায় এয়ারব্যাগ নির্মাতা জাপানি প্রতিষ্ঠানটি। পদত্যাগ করতে বাধ্য হন প্রেসিডেন্ট স্টেফান স্টকার। অন্যদিকে সুইচে ত্রুটির কারণে ৩৫ মিলিয়ন ডলার জরিমানা দিতে বাধ্য মার্কিন গাড়ি নির্মাতা জিএমকে।

স্টক মার্কেটে উত্থান

আরেকটি বছর, আরেকটি রেকর্ড। ফেডের প্রণোদনা কর্মসূচি সমাপ্ত হওয়ার পরও টানা ছয় বছর ঊর্ধ্বগতির রেকর্ড ধরে রেখেছিল মার্কিন শেয়ারবাজারগুলো। বছরজুড়ে রেকর্ড অধিগ্রহণ ও একীভূতকরণের (এমঅ্যান্ডএ) চুক্তি তো ছিলই, এছাড়া অধিকাংশ বৃহত্তর প্রতিষ্ঠান তাদের প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ডলারের শেয়ার পুনঃক্রয় করে নেয়ার খবরে এসঅ্যান্ডপি৫০০ সূচকটি গত বছর ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ফেডের বন্ড ক্রয় কর্মসূচির ইতির পরও বন্ডের দাম ছিল ঊর্ধ্বমুখী।

ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি

যুক্তরাষ্ট্রসহ ধনী বিশ্বের আয় ও সম্পদবৈষম্য ছিল গত বছরের অন্যতম এক আলোচিত ইস্যু। ২০০৭ সালের পর মন্দার আঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের পরিবারগুলোর আয় কমা শুরু করে এবং ২০০৯ সালের পর থেকে ন্যূনতম মজুরি ৭ দশমিক ২৫ ডলারেই পড়ে ছিল। এ ব্যাপারে কংগ্রেস কোনো পদক্ষেপ না নিলেও নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ন্যূনতম মজুরি ১০ দশমিক ১০ ডলারে উন্নীত করেন। অন্যদিকে ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় ঢেউ লেগেছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয়। বাংলাদেশে রানা প্লাজা ধসে গার্মেন্ট শিল্পপ্রধান আসিয়ান দেশগুলোয় ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন জোরদার হয়। ভিয়েতনামের ন্যূনতম মজুরি ১৫ বছরের মধ্যে ১৭ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আজ থেকেই কার্যকর হচ্ছে। ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায়ও ন্যূনতম মজুরি বেড়েছে।

আইপিও এবং এমঅ্যান্ডএ

গত বছর ছিল বাম্পার আইপিওর বছর। ২০১৪ সালে মোট ১ হাজার ২০৫টি আইপিও বৈশ্বিকভাবে ২৫৮ বিলিয়ন ডলার পুঁজি সংগ্রহ করেছে, যা মন্দা-পরবর্তী সময়ে সর্বোচ্চ। আইপিওর ক্ষেত্রে শীর্ষে ছিল চীনের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলিবাবা, যা নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে রেকর্ড ২৫ বিলিয়ন ডলার পুঁজি সংগ্রহ করে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের মোট আইপিওর ৩৭ শতাংশই ছেড়েছিল স্বাস্থ্য সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো। এছাড়া অর্থনীতি নিয়ে আস্থা বাড়ায় ২০১৪ সালে বিশ্বব্যাপী এমঅ্যান্ডএ চুক্তির লেনদেনের পরিমাণ ছিল ২০০৭ সালের পর সর্বোচ্চ। ২০১৩ সালের তুলনায় গত বছর এমঅ্যান্ডএ লেনদেনের পরিমাণ ২০ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৪১ ট্রিলিয়ন ডলার।

ইউরোজোন ও জাপান

এবারো মন্দার ছোঁয়া থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি ইউরোপের অর্থনীতি। গত বছরের তৃতীয় প্রান্তিকেও দশমিক ৮ শতাংশের শ্লথ প্রবৃদ্ধিতে বিচরণ ছিল এ অঞ্চলের অর্থনীতির। বেকারত্বের হার পড়ে আছে ১১ দশমিক ৫ শতাংশে, অন্যদিকে সুদের হারও প্রায় শূন্যের কাছাকাছি দশমিক শূন্য ৫ শতাংশে। তৃতীয় প্রান্তিকে দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে কোনোমতে মন্দা ঠেকিয়েছে এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি জার্মানি। দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে জার্মানির মতোই একইভাবে মন্দা ঠেকিয়েছে ফ্রান্স। তবে অন্যান্য আঞ্চলিক প্রতিবেশীর তুলনায় তুমুলভাবে এগোচ্ছে ব্রিটেনের অর্থনীতি। তৃতীয় প্রান্তিকে বার্ষিক ভিত্তিতে ব্রিটেনের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক ৬ শতাংশ, যা আঞ্চলিক ভিত্তিতে সর্বোচ্চ। এছাড়া বেকারত্বের হার জানুয়ারির ৭ দশমিক ২ শতাংশ থেকে কমে নভেম্বরে ৬ শতাংশে নেমে এসেছে। তার পরও আঞ্চলিক মূল্যস্ফীতির হার দশমিক ৩ শতাংশে পড়ে থাকায় ক্রমে দীর্ঘমেয়াদি মূল্য সংকোচনের হুমকিতে আছে ইউরোপ।

অন্যদিকে মূল্য সংকোচনে থাকা জাপান মূল্যস্ফীতির হার বাড়াতে এপ্রিলে বিক্রয় কর বৃদ্ধি করে। কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হয়ে অভ্যন্তরীণ ভোক্তা ব্যয়ই কমে যায়। ফলে তৃতীয় প্রান্তিকেই মন্দায় পতিত হয় দেশটির অর্থনীতি। তৃতীয় প্রান্তিকে দশমিক ৫ শতাংশ সংকুচিত হয়ে মন্দায় পড়েছে এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিটি। ফলে নির্বাচন ডাকতে বাধ্য হন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। তিনি আবারো জিতলেও বিক্রয় কর আরেক দফা বৃদ্ধির সিদ্ধান্তকে পিছিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।

ইবোলা

নিঃসন্দেহে এ বছর আফ্রিকার সবচেয়ে বড় আতঙ্কের নাম ছিল ইবোলা। পশ্চিম আফ্রিকায় এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটার পর এখন রোগটি তার প্রতিবেশীদের ছাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও স্পেনেও আক্রান্ত করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, এ রোগে মৃত্যুর সংখ্যা এরই মধ্যে সাত হাজার পার হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে আঞ্চলিক অর্থনীতির। ইবোলার প্রকোপের কারণে লাইবেরিয়া, সিয়েরালিওন ও গিনির পর্যটন খাত ব্যাপকভাবে পর্যুদস্ত হয়েছে, যা ছিল দেশগুলোর অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ।

তেলের মূল্যপতন

এ বছরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল অপরিশোধিত তেলের ক্রমহ্রাসমান মূল্য। সেপ্টেম্বরের পর থেকে তেলের দাম প্রায় ৫০ শতাংশ মূল্য হারিয়ে এখন ৬৫ ডলারে নেমে এসেছে। মূল্যপতনের অন্যতম কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে শেল তেল খাতের উত্থান এবং চাহিদার         তুলনায় ওপেকভুক্ত দেশগুলোর বেশি সরবরাহ। সবচেয়ে বড় কথা, এ মূল্যপতনে বদলে গেছে বিশ্বের অনেক অর্থনীতির হালচাল। তেলের আমদানিকারক যুক্তরাষ্ট্র এখন আমদানি কমিয়ে এনেছে উল্লেখযোগ্য মাত্রায়। ফলে নাইজেরিয়ার মতো তেল রফতানিকারক দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে তেল রফতানি একেবারে শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। ভুক্তভোগী হয় ভেনিজুয়েলা, রাশিয়া ও আফ্রিকার তেল উত্তোলক দেশগুলো। অধিকাংশ তেল রফতানিকারক দেশ তাদের বাজেটে সংশোধন আনতে বাধ্য হয়। জেনেভায় ওপেকভুক্ত তেল উত্তোলক দেশগুলো উত্তোলন ও সরবরাহ না কমানোর সিদ্ধান্ত নিলে তেলের দাম আরো পড়ে যেতে থাকে।

রাশিয়া

প্রতিবেশী ইউক্রেনের ক্রাইমিয়া অঞ্চল দখল করে এক দীর্ঘমেয়াদি ও গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করে রাশিয়া। এর প্রভাব পড়েছে গোটা বিশ্বে। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়ার ওপর কয়েক দফা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে পশ্চিমা বিশ্ব। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে রাশিয়াও পশ্চিমা বিশ্ব থেকে খাদ্যপণ্যসহ অন্যান্য পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা, মুদ্রা রুবল ও অপরিশোধিত তেলের নিম্নমুখী গতির কারণে হুমকির মুখে পড়ে যায় দেশটির অর্থনীতি। তৃতীয় প্রান্তিকে দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে এখন প্রায় মন্দার হুমকিতে পড়েছে রাশিয়া।

চীন ও ভারত

চীন ও ভারতের কথা বলতেই হবে। এক দশক ধরে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রাখার পর তৃতীয় প্রান্তিকে চীনের বার্ষিক ভিত্তিতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। এ বছরই দেশটি দীর্ঘসময় ধরে অনুসরণ করা রফতানিনির্ভর প্রবৃদ্ধি মডেল থেকে সরে এসে ভোক্তানির্ভর অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাই ৭ শতাংশের প্রবৃদ্ধিকে ধরা হচ্ছে চীনের ‘নতুন স্বাভাবিক’ মানদণ্ড।

অন্যদিকে নরেন্দ্র মোদির হাত ধরে নতুন সরকার আসার পরই নতুন গতি পেয়েছে ভারতের অর্থনীতি। ক্ষমতায় আসার পর মোদি অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রতি ব্যাপক নজর দেন। এরই মধ্যে জিএসটি, কোল ইন্ডিয়ার একচেটিয়া খর্বসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার পদক্ষেপ নিয়েছে মোদির সরকার। তার উদ্যোগী কর্মকাণ্ডে আস্থা ফিরে এসেছে সমগ্র অর্থনীতি তথা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। ২০১২ সাল থেকে ৪ অঙ্কের ঘরে প্রবৃদ্ধি থাকার পর গত বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে তা বার্ষিক ভিত্তিতে ৫ অঙ্কের ঘরে প্রবেশ করেছে। বণিকবার্তার সৌজন্যে।